জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকলে শতবর্ষী হতেন এবছর। ‘৭৫ এর ১৫ আগস্টে নির্মমভাবে নিহত হন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার ও স্থপতি।জাতীয় শোকদিবসে প্রশান্তিকার আয়োজন ‘রক্তস্নাত শোকাহত আগস্ট’ সংখ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া থেকে কবি ও নাট্যকার বদরুজ্জামান আলমগীরের নিবেদন- গুচ্ছ কবিতা ‘ওম গর্ভবতী পাথর কাতরায়।’
৫৬ হাজার বর্গমাইল
একটি মানব শিশু যে-মুহূর্তে জন্ম নেয় ঠিক সেই মুহূর্তেই তার সম্পূর্ণ জন্মগ্রহণের ঘটনাটি ঘটে না।
প্রত্যেকটি জন্মই একটি ইতিহাস ও পরম্পরার ঘনীভূত রূপ: সেখানে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত একবিন্দুতে এসে একান্নবর্তী হয়; ১৯৭১ সনের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ভিতর দিয়ে বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের অন্তরাত্মায় একবিন্দু আগুন ও অশ্রুকণার সম্মিলনে ভারতভাগের কাটা দাগের ক্ষরণের মধ্যে একটি আকাঙ্ক্ষার প্রসূন তার মুখ বাড়িয়ে ধরে। ফলে বাঙলাদেশ নাম ৫৬হাজার বর্গমাইল আয়তনের ক্ষুদ্রকায় এক উদিত দুঃখের দেশ- যে বটবৃক্ষের বীজের সঙ্গে তুলনীয়- দেখতে ছোট, কিন্তু ধারণ ও ব্যক্তিত্বে অসীম।
ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের ভিতর দিয়ে যে ভারতবর্ষের জন্ম হবার কথা ছিল- বাস্তবে সেই ভারত উত্থিত ও গঠিত হবার বদলে রক্তপাত আর খণ্ডবিখণ্ডতার আর্তনাদে পরিসমাপ্ত হয়।
বাঙলাদেশের জন্ম সেই অসমাপ্ত স্বপ্নের বাস্তব অভিব্যক্তি।
আকাঙ্ক্ষার এই সুবিশাল চাপের মধ্যে বাঙলাদেশ বুঝি পাথরের নিচে চাপাপড়া রাজকুমারের মত হাঁসফাঁস করে!
এই অগ্নিপরীক্ষা মোকাবেলায় লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা অঙ্গীভূত হোক একজন মুক্তিযোদ্ধায়, ২লক্ষ বীরাঙ্গনা মিলে ১জন বীরাঙ্গনাকে প্রার্থনার পবিত্রতায় আমরা যেন হৃৎস্পন্দনের উন্মিলনে গ্রহণ করি, ৩০লক্ষ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ১জন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে আমাদের সঙ্কল্পের দৃঢ়তায় একাকার হোক।
আমাদের আলাদা আলাদা কোন জন্মদিন নেই; আমরা সবাই জন্মেছি একদিনে – আমাদের একটাই জন্মদিন- ১৬ই ডিসেম্বর।
যেতে হবে দূর ঘুমিয়ে পড়ার আগে: এক পরিপূর্ণ শিশু, এক অপরিপূর্ণ জননী, তোমাকে প্রণতি জানাই!
অপেক্ষাসংহিতা
তুমি যে গেলা ঘাড়ের গামছাখান নিবারও সময় পাইলা না। প্রথম প্রথম বালিশের উয়ারের ভিতর গামছা থুইয়া রাখতাম- গামছার লাগি বকা দিও না- যেভাবে মাস যায়, বছর গড়ায় তুমি আসো না- তয় গামছা দিয়া কী হবে! তোমার লাগি- এক কড়াও মিছা কই না- খালি তোমার লাগি মন উতলা হয়! ক্যান এমন হয়, আমি তার এক গণ্ডাও কইবার পারি না; নয়া পানির লাহান ফিইরা ফিইরা তুমি বারবার কও- আমার শরীলে নাকি কামরাঙ্গা ফলের ঘেরাণ! আমি কই- না গো না,আমি মাটির ফুফাতো বোইন; যদি তোমার দুর্দিন হয়, নাওয়ের বাইনের লাহান কোনদিন ভাইঙ্গা ভাইঙ্গা পড়ো- আমার মইধ্যে ভরসা রাইখো- তুফানে টলুম না, ঠাডায় কাঁপি না- আমি আড়ালে আবডালে দুপচাপিয়ার বাইদ।
কতোদিন হইয়া গেল- কতো বছর- চোখের জ্যোতি কইমা গ্যাছে- কোনকিছু ভাল কইরা ঠাহর করি না! লোকে হাসাহাসি করে, তা-ও একখান চশমা নিছি; একটাই আশা- তুমি যখন আসবা চোখ ভইরা দেখুম! তুমি অবুঝ, ক্যান বোঝ না- কতোদিন ধইরা তোমার পথ চাইয়া থাহি। মানুষের মন কে বুঝিতে পারে- হাত্তিরও পিছলে পাও, সুজনেরও ডুবে নাও! চিনাইয়ের ছাপ-দেওয়া যে শাড়িখান দিছিলা-আজো আমি তার ভাঁজ খুলি নাই! পইরা কী লাভ- কারে দেখামু? আমার চুল সাদা হইয়া গ্যাছে বইলা তুমি বুঝি আমারে চিনতে পারো না? ভাবো, খেজুরদানা গাঙ্গের পাড়ে আরেকটা ঢেউ খাড়াইয়া থাহে! হ, হ, তোমারে ডুবানির লাগি আরেকটা ঢেউ খাড়াইয়া আছে! একটা ঢেউয়ের লগে যেমন আরেকটা ঢেউয়ের একজনম দেখা হয় না- তোমার লগে আমার- মনে তো কয় একলগেই আছি- খালি সামনাসামনি দেখা হয় না।
ওই যে ইকাত্তর- সংগ্রামের সন আইলো, মিলিটারি নামলো- উনিও ঘর থাইকা বাইর হয়!
বুড়া পাকুড় গাছের বাকল ফাইটা ফাইটা আমার কপালের লাহান হইয়া গেল- পাকুড় গাছের ভাঙ্গা ডালে বারি দিয়া কতোবার ঘুন্নিবাই আইলো- খালি তাইন আইয়ে না!
জগৎ সৃষ্টির আদি বিবরণ
শুনতাম এই তরুণ যুবা এলাকার নায়ক- কোঁকড়া চুল, সামনের চুল আবার ঢেউখেলানো- কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর থানার জ্ঞানপুরে তার বাড়ি। তাঁর মায়ের নাম আছিয়া খাতুন, সবাই ডাকে সূর্যের মা; তার বোন আম্বিয়া- আম্বিয়া খাতুন। আমি ছোটবেলায় শুনেছি তিনি রাবেয়া বসরী। রাবেয়া বসরী আমাকে সিন্ধুরিয়া গাছের আম খেতে দেয়। ওই আম দুনিয়াতে একবারই জন্মেছিল।
একাত্তরে যুদ্ধ শুরু হলে কোঁকড়া চুলের যুবক যুদ্ধে যায়- সত্যিসত্যিই মুক্তিযুদ্ধ করে- ওই যোদ্ধা নয়, যারা ইণ্ডিয়া থেকে- মুক্তিবাহিনী মেরে সাফ করার জন্য লিস্টি নিয়ে এসে এলাকায় হাজির হয়েছিল।
যুদ্ধের একদম শেষে মাঠের লড়াকু মুক্তিসেনা মিজবাহউদ্দিন আহমদ- সহযোদ্ধাদের হাতে প্রাণ দেয়।
বোয়াল মাছের সাথে, চিতল মাছের সিথানে তার ফোলা মৃতদেহ ভেসে ওঠে। গ্রামের লোকেরা কাঁধে কাঁধে ভাটির গাঙ থেকে মৃতের শব জ্ঞানপুরে নিয়ে আসে।
শহীদ মিজুর মা আছিয়া খাতুন বুকে থাবড় দিয়ে মাটি ছেঁচড়ে বিলাপ করে। মিজুর বোন আম্বিয়া খাতুন তার মা সূর্যের মা-কে বলে: আপনি কান্দেন কেন? আল্লার দরবারে সোজা হইয়া খাড়ান- খোদার ইচ্ছায় সবুর রাখেন, আগুন হইয়া জ্বলেন!
আড়ালে, পিছ দুয়ারে আম্বিয়া নারকেল গাছের পাতা- কেঁপেকেঁপে কাঁদে, সূর্যের মা আগুন হয়ে মেওয়া ফলে জ্বলে, আর মুক্তিবাহিনী মিজু অনড় মাটি- স্থির শুয়ে থাকে!
বদরুজ্জামান আলমগীর
নাট্যকার, কবি, অনুবাদক। জন্ম বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চল কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে। পড়াশোনা বাজিতপুরে, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ২৩ বছর ধরে রয়েছেন দেশের বাইরে- যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায়।