গোলাপ ও গিলোটিনের কাব্য-শাখাওয়াৎ নয়ন

  
    

শাখাওয়াৎ নয়ন

“শাশ্বত প্রত্যাবর্তন” নামক একটি ধারণা আছে। ধারণাটি এমনিতেই রহস্যপূর্ন। তার উপরে নীটশেবাদী কয়েকজন দার্শনিক এই ধারণাটিকে আরো জটিল করে তুলেছেনঃ যেমন,শাশ্বত ধারণা আমাদের ভাবতে উৎসাহিত করে যে, জগতের সব ঘটনাই নাকি ইতোমধ্যে ঘটে গেছে। এখন কেবল সেই ঘটে যাওয়া ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এই পুনরাবৃত্তিটা আপনা আপনিই অনন্ত কালব্যাপী চলতেই থাকবে।
এই সব আবোল তাবোল কথা-বার্তার আদৌ কোনো মানে হয়? ধরে নিচ্ছি ধারণাটি নেতিবাচক। তবুও এই শাশ্বত প্রত্যাবর্তন ধারণার আসল কথা এমন যে, জীবন একবার হারানো মানে চিরতরে হারানো, প্রত্যাবর্তনের কোনোই সুযোগ নেই, জিন্দেগী না মিলেগা দোবারা। আপনি যদি আত্মার কথা বলেন, সে তো আসলে জীবন নয়, জীবনের ছায়া। যার কোনো ওজন নেই,আকৃতি নেই, জীবন্মৃত। কারণ মরার আগেই এই ছায়াজীবন মরে ভূত  হয়ে থাকে।

সর্বোপরি, এই ছায়াজীবনটা সুন্দর,কখনো মায়াময়, কখনো বিভীষিকাময় কিংবা মহৎ যেমনই হোক না কেন, এর কোনো কিছুরই কোনো অর্থ নেই। উদাহরণ হিসেবে চৌদ্দ শতকে দুই আফ্রিকান রাজ্যের মধ্যে ঘটে যাওয়া একটি যুদ্ধ আমাদের আলোচনায় সাহায্য করতে পারে। ঐ যুদ্ধে পৃথিবীর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি, যদিও এক লক্ষ কালো মানুষ মারা গিয়েছিল। এখন যদি শাশ্বত প্রত্যাবর্তন তত্ত্বানুযায়ী যুদ্ধটার বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে, তাহলে কেমন হবে?

ফরাসী বিপ্লবের যদি নিয়ম করে পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকত, তাহলে ঐতিহাসিকরা বিপ্লবীদের জন্য এত গর্বিত হতো না। প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনাহীন বিষয়গুলো নিয়েই কেবল ইতিহাসের দেন-দরবার চলে। তাই ফরাসী বিপ্লবের সেই রক্তঝরা দিনগুলো এখন কেবল তত্ত্ব আর আলোচনার বিষয়। গুরুত্বের বিচারে পাখির পালকের চেয়েও হালকা। বিপ্লবের বিভীষিকাও কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। সুতরাং বিপ্লব একবারই হয়েছে,আর কখনো হবে না। তাই বলে পৃথিবীতে যুদ্ধ থেমে গেছে? আর কোনো বিপ্লব হবে না? হবে,অবশ্যই হবে। বিপ্লবে আবারো অগণিত মানুষ মারা যাবে, কিন্তু তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হবে ভিন্ন। নতুন কোনো স্থানে নতুন প্রাণের বিসর্জনে নতুন কিছু অর্জিতও হবে।
আচ্ছা,আপাতত না হয় মেনে নিচ্ছি- শাশ্বত প্রত্যাবর্তনের ধারণাটি একটি বিশেষ অবস্থান,যেখানে সব কিছুই আমাদের চেনা-জানা পরিধির বাইরের কোনো চেহারা ধারণ করে। কিন্তু সেই চেহারাটার স্থায়িত্ব এত কম যে, আমরা কোনো উপসংহারে পৌঁছানোর আগেই তা হারিয়ে যায়। এই স্বল্পায়ু বিষয়টা হারিয়ে যাবার পর সবকিছু নস্টালজিয়ার আলোতে ঝলমল করে,সেটা গোলাপ হোক,আর গিলোটিনই হোক।
এই শাশ্বত প্রত্যাবর্তনের পুনরাবৃত্তিতেই আমরা কখনো কখনো কাউকে কাউকে গোলাপ (প্রেম, ভালোবাসা) দেই, অথবা আমাদের গলা বাড়িয়ে দেই কারো না কারো মায়াবী গিলোটিনের ভিতর। একইভাবে আমরাও মায়াবী গোলাপ এবং ধারালো গিলোটিন নিয়েই কারো না কারো জন্য অপেক্ষা করি…।

শাখাওয়াৎ নয়ন: একাডেমিক, স্কুল অফ পাবলিক হেলথ এণ্ড কমিউনিটি মেডিসিন, ফ্যাকাল্টি অফ মেডিসিন, ইউনিভার্সিটি অফ নিউ সাউথ ওয়েলস, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments