গৌরব আর অহংকারের শতবর্ষ আমার জ্ঞান দাত্রীর । শিউলি আফসার

  
    
শিউলি আফসার

গতরাতে প্রায় সারারাত জেগে, বসে, উঠে দাঁড়িয়ে কাটিয়েছি। ইউটিউবে দেখলাম কাঁঠালের খুব গুণ। স্বাস্থ্যের জন্য কাঠাল এবং এর বীজের গুনাবলী দেখে তাড়া সইলোনা।প্রথমে বিকেলে পাঁচ কোষ সাবার। আমরা হুজুগে বাঙালী! আমিতো বাঙালীই! সব ভাইটামিন আমার এই মুহূর্তে দেহে ইন্টেক করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। রান্নাঘরে পড়ে থাকা আধা শুকনা বীচি তাওয়ায় দিয়ে ভাজলাম।

আগের রাতে, বিকালে, সকালে প্রোটিনে ভরপুর কাঠালের হাইভাইটামিন পেটে পড়তে থাকলো।রাতে শোয়ার সাথে সাথে অস্বস্তি বোধ করতে থাকলাম। ঘুমানোর জো নাই। বিছানায় উঠে বসে রইলাম। জানালা খুলতেই দেখলাম আকাশে চাঁদ উঠেছে। আহ! কী চিত্তাকর্ষক বিষয়! ঢাকা শহরের চাদঁ আর গ্রামের চাঁদের বিস্তর তফাতখানি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। নদীর চাঁদ আর সমুদ্রের চাদঁ, যে না দেখবে তারে বুঝানো দায়। অসুস্থতার চাঁদ! আর সুস্থতার চাদঁ! আমি টের পেলাম। এই প্রথম মহামারীর এই চাঁদকে আমার বিষন্ন লাগতে শুরু করলো।চাঁদের দিকে তাকিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের কথা মনে পড়লো! মেমসাহেবের নিমাই বাবুর কথা মনে পড়লো! আহা! কতো কতো নক্ষত্রের নিমেষে পতন ! অনুক্ষণ মহামারী!

অপরাজেয় বাংলা

প্রায় সারারাত! ডিহাইড্রেটিং কষ্টে খারাপ লাগলো।শেষ রাতে আবার কাজী নজরুলের ‘লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া, মজনুগো আঁখি খোলো’ গানটি শুনতে ইচ্ছে করলো।এই গানের একটা জায়গায় ফিরোজা বেগমের কন্ঠের ঢেউ যতবার খেলে যায়,আমার ততোধিক হু হু করে কান্না পেতে থাকে।’বনের হরিন হরিনী কাঁদিয়া, পথ দেখায়েছে মোরে, হুর ও পরীরা ঝুরিয়া ঝুরিয়া পথ দেখায়েছে মোরে’, ফিরোজা বেগম যেনো আমার বিছানায় আমাকে দেখে দেখে গানটি গাইছেন। দীর্ঘ বন্দীত্ব আমাদের যেনো উত্তাল অস্থির করে তুলছে। না! আর ভালো লাগছেনা! সামাজিক দুরত্ব আর কতদিন! মহান আল্লাহ জানেন! মন যে আর মানেনা। মনে হয় জানালা দিয়ে ফুরুত করে উড়াল দেই! ‘ও তোতা পাখিরে, মাকে এনে দে’, অস্থির আর তোলপাড় হয়ে উঠছে ভেতরটা।

কার্জন হল

হেঁটে হেঁটে পায়চারী করতে থাকি। কাউকে ঘুম হতে জাগানোর মানে হয়না।কোনোরকমে জানালা বন্ধ করতে গিয়ে অনুভব করলাম হাস্নাহেনার সুগন্ধ আসছে। রাস্তাটা সুনসান! কারো কোনো বাঁশির সুর ভেসে আসছেনা। এই সময়টায় স্যার এ,এফ রহমান হলের গেট হতে ছাত্রদের নানা অনুষ্ঠানের শব্দ ভেসে আসে।প্রায়শই কেউ কেউ নিস্তব্ধতা ভেঙে কন্ঠ ছেড়ে গান ধরে। কেউবা আপন মনে পড়াশোনা আর বেকারত্বের অনিশ্চয়তা ভেবে করুণ সুরে বাঁশিতে সুর তোলে। আমার বাসাটা এই হলের বিপরীতে হওয়ায় আমি যেনো তাদের প্রতিটি অনুভূতির নিরব সাক্ষী হয়ে যাই। ওপাড়ের পায়ের শব্দের মতো, মোটরসাইকেল এর শব্দ, আযানের শব্দ, সব আমার পারিবারিক বন্ধনের ন্যায় আপন অতি আপন এক পরিবেশ। কতটা দিন ওপাড়ে কোনো শব্দ নেই! ঝিঝি শব্দ,পাখির কিচিরমিচির শব্দ, বাতাসে পাতায় পাতায় ঘষাঘষি শব্দটাও যেন ভূতুরে লাগে।

ক্যাম্পাসে প্রিয় শিক্ষার্থীদের ছাড়াই দু:খী এবং মায়াবী চাঁদ।

ক্যাম্পাসের এই গভীর রাতের চাঁদ শিক্ষার্থীদের ছাড়া আমার কাছে খুব কষ্টের অনুভুতি হচ্ছে।সবার সবগুলো দোয়া যদি আল্লাহ কবুল করে আমাদের দীর্ঘ এই কোভিড হতে মুক্তি দিতেন! চাঁদটা কতোই আনন্দের হতে পারত তখন। জগতে এই একটা জিনিস একা উপভোগের হয়না! আনন্দ! প্রতিদিনের চিরবিদায়ের সংখ্যাটায় এখন আর কেউ কান পাতেনা! অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর অবস্থা!

যাদের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়! তাদের ছাড়া হলের আবাসন গুলো খুবই অসহায় বোধ করছে।রাস্তাগুলো এতোটা ফাকাঁ! যেনো অন্য অচেনা ভুবনে বাস করছি।এরই মধ্যে মাতৃসম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর জন্মদিন এলো! ১ লা জুলাই! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর জন্মদিন! গৌরব আর অহংকারের শতবর্ষ আমার জ্ঞান দাত্রীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভালোবাসি তোমায়! ভালোবাসি যেমন লালসবুজের পতাকাকে! আমায় তুমি অশেষ করেছো! আমায় গ্রহণ করে ধন্য করেছো।
১ জুলাই ২০২০।

শিউলি আফছার: পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কর্মসূত্রে বাসও করছেন একই ক্যাম্পাসে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার। কাজের পাশাপাশি সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর বিচরণ। কবি, গল্পকার, লেখক এবং বিতার্কিক। 
প্রকাশিত গ্রন্থ: তস্তুরি বেগম (উপন্যাস); জল জোছনার গল্প (কবিতা), জলপাপড়ি (কবিতা); ব্যস্ত ঘুড্ডি ভো কাট্রি (রম্য প্রবন্ধ); সোহাগী (গল্প)।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments