আপনাদের যার যেখানে ইচ্ছে চলে যান। আমি এই বৃষ্টিভেজা দুপুরে স্নাত শিরিষ গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকবো। বিকেল হবে। সন্ধ্যা নামবে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ তুলে শব্দহীন ফিরবে রাত।
আমি তবুও দাঁড়িয়ে থাকবো। আমার গায়ে অপেক্ষার শেকড় গজাবে। পাখি ঘুমাবে। ক্লান্ত পাতারা নেতিয়ে পড়বে ঘাড়ে পিঠে কাধে।
আমি তবুও দাঁড়িয়ে থাকবো। মিছিল যাবে। রিকসার টুং টাং। জানলায় আলো জ্বলবে নিববে। খানিকটা পর্দা সরিয়ে, ইতিউতি দেখে নেবে মেয়েটি। অন্ধকার নামবে। অন্ধকারের পিঠে অন্ধকার, আরো অন্ধকার, গভীর নিষ্কন্টক নিকষ অন্ধকার! আমি তবুও দাঁড়িয়ে থাকবো।
আজ আমাকে চৈতণ্যে পেয়েছে। গেরুয়া। মুণ্ডিত মস্তক। উপরে দু’হাত তুলে হরির নামগানে নৃত্যরত ছায়ামানব। বনপাংশুটে। ক্ষ্যাপা। মাঝরাতে বধু বিষ্ণুপ্রিয়াকে ঘুমঘোরে রেখে গৃহত্যাগী চৈতণ্য। কোথায়, কোন লোকালয়ে, নাকি লক্ষীপ্রিয়ার কাছে? লক্ষীপ্রিয়া!
তোমাদের যার যেখানে ইচ্ছে চলে যাও। আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইবো জলকাদা গায়ে এই এক হাঁটু পানি সরু গলিতে। নৌকা ভাসাবো। ছেড়া পলিথিন, ঠোঙা, কাগজের বাক্সের নৌকা। পাড়াপার হবে মানুষ-আধভাঙ্গা মানুষ, জলভেজা মানুষ, যাদের ঘরে ফিরবার তাড়া নেই্; আয়োজন নেই; সান্ধ্যমঙ্গলে যাদের জন্য বাজে না শঙ্খ।
এই যে শিরিষ গাছটা, এসবের ও সব জানে, অনেকখানি জানে। ইতিহাস, মানুষ, বৈকল্য, স-ব, স-ব ওর দেখা, মুখস্থ। চৈতণ্য যেদিন তর্ক জুড়েছিলো রাজ-রাজড়াদের সঙ্গে, মন খারাপের সাক্ষী হয়ে অঝর কেঁদেছিল গাছটি। অনুশাসন ভাঙলো। নিচু মানুষের গান হলো। হাতের তুড়িতে উড়ে গেল কত পুরনো প্রথা, বুলি, খিস্তিখেউর। শিরিষের মন ভালো হয়নি।
কে কাকে কবে ছাড়লো, কেন ছাড়লো, তার কোন সদুত্তর নেই শিরিষের। যে লোকটা মাঝরাতে খুক খুক কাশি নিয়ে বাড়ি ফিরতো, সে কোথায়- বলতে পারে না। দেয়ালে পোস্টার সাঁটানোর অপরাধে পুলিশ ভ্যান সেই যে তুলে নিয়ে গেল হতচ্ছাড়া কিশোরকে, ও এখন কোথায়? কেমন আছে? জানে না শিরিষ। রোজ পাশের জানালায় কাঁদতো যে কন্ঠ, হুল্লোড় জুড়তো, সেখানে এখন সুনশান। পর্দা নড়ে না, সরে না, বাতাসে বারি খায় শব্দহীন গল্প।
আমি তবুও তারই নিচে দাঁড়িয়ে থাকবো ঘন্টার পর ঘন্টা। বৃষ্টি থামবে। জল নামবে। কোলাহল বাড়বে। তবুও, তবুও আমি দাঁড়িয়ে রইবো। ছোট ছেলেটা হাতের আঙ্গুল টেনে বলবে, বাড়ি ফিরবে না? ও ঘরে আমার একা যেতে ভয় করে!
আমার চোখে জল নামবে। অন্ধকার নামবে। শিরিষ, কাদাজল, সব ঝাপসা হবে। মুখস্থ মুখ অচেনা হবে। ভুলে যাবো সব পদ্য-গদ্যপাঠ। কাঁদবে চোখ। চোখের জলে ভাসবে নৌকা, স্মৃতির নৌকা। জলভেজা কন্ঠে দূর মেঘে তখন হাঁটবে ভাসবে ছেলেটা, আদরের বিষ্ণুপ্রিয়া: ঘরে এসো! তোমার জন্য মঙ্গলাচরণ সাজিয়েছি। তুমি গাইলেই শেষ হবে আমাদের অর্চনা!
পশ্চিম মালিবাগ, ঢাকা।
১ অক্টোবর ২০১৯।
অলংকরণ: আসমা সুলতানা মিতা
“বিশ্ব ভারত বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক পরিষদ “এর পক্ষথেকে থেকে ও সকল সদস্য/ সদস্যা দের পক্ষ থেকে ও সকল অসম ও বাংলা ভাষী শিল্পী সমাজের পক্ষ থেকে আপনাদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন । আপনাদের সঙ্গি হতে পারলে, সত্যি আনন্দিত হব, প্রনাম।