ভাইসব! ভাইসব! আগামী ষোলোই ডিসেম্বর, শুক্রবার মাদারীপুর রোটারি ক্লাবের সহযোগিতায় দিনব্যাপী এক চক্ষুশিবিরের আয়োজন করা হইবে। স্থান : কুলপুদ্দি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়। সময় : সকাল দশ ঘটিকা হইতে বিকেল চার ঘটিকা পর্যন্ত। উক্ত চক্ষুশিবিরে দরিদ্র চক্ষুরোগীদের চোখ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিনা মূল্যে ব্যবস্থাপত্রসহ ওষুধ প্রদান করা হইবে। ছানিপড়া রোগীদের বাছাই করে সদর হাসপাতালে অপারেশন করে বিনা মূল্যে চশমা প্রদান করা হইবে। দুস্থ ও দরিদ্র চক্ষুরোগীদের উক্ত চক্ষুশিবিরে অংশগ্রহণ করিবার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হইল। ভাইসব! ভাইসব…!
ভরদুপুরে ছাদে বিপরীতমুখ করে বাঁধা দুটি মাইকওয়ালা একটা অটোরিকশা, চক্ষুশিবিরের প্রচার করতে করতে গহিনাকূল গ্রামের চান্দুর দোকানের সামনে এসে থামল। চক্ষুশিবিরের প্রচারকারী বেল্লাল অটোরিকশা থেকে নেমে চান্দুর দোকানের কাস্টমারদের দিকে তাকাল। চান্দু চা বানাতে ব্যস্ত। আট-দশজন কাস্টমারের মধ্যে কেউ ক্যারম খেলছে, কেউ ডিশের চ্যানেলে বাংলা সিনেমা দেখছে। দু-তিনজন যুবক ছাড়া বেল্লালের দিকে কেউ ভ্রুক্ষেপও করল না। অথবা যে কজন বয়স্ক মানুষ আছেন তারা কি করলেন, কি করলেন না, তা বেল্লাল বুঝতে পারল না। বেল্লাল যেখানেই যায়, বয়স্কদের খেয়াল করার চেষ্টা করে। সে দেখেছে, বয়স্করা ভ্রুক্ষেপের চেয়ে মনোঃক্ষেপ করে বেশি। তাই তাঁদের মনোভাব বুঝতে সময় লাগে। বেল্লাল চায়ের অর্ডার দিল। চায়ের প্রথম চুমুকটা দেয়ার সাথে সাথে একজন নিবু নিবু দৃষ্টিসম্পন্ন বয়স্ক লোক বেল্লালকে জিজ্ঞেস করলেন,
আফনেরা বিদেশি সংস্থা?
না, আবার হ্যাঁ…।
বেল্লাল আমতা আমতা করে উত্তর দিল। বয়স্ক লোকটি আবার জিজ্ঞেস করলেন,
আফনেগো কতা বোঝন বড় কষ্ট…যাউকগ্যা, তয় কি কি দিবেন কইলেন?
চোখ পরীক্ষা করে ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধ দেয়া হবে।
আর কি দিবেন?
ছানিপড়া রোগীদের অপারেশন করে চশমা।
ও আচ্ছা। তয় আফনেগো ডাক্তারগো কইয়েন, চোহের চিকিৎসা করে লাভ নাই, আর চশমা দিয়া কি অইব? প্যাডে ভাত না থাকলে কি মানুষ চোহে দ্যাহে?
বেল্লাল চমকে উঠল। এ কথার উত্তরে সে কী বলবে, বুঝতে পারল না। চা শেষ না করেই সে উঠে গেল। অটোরিকশা নিয়ে একটু দূরে গিয়ে আবার বলা শুরু করল,
ভাইসব! ভাইসব! আগামী ষোলোই ডিসেম্বর, শুক্রবার মাদারীপুর রোটারি ক্লাবের সহযোগিতায় দিনব্যাপী এক চক্ষুশিবিরের আয়োজন করা হইবে…। হঠাৎ কোত্থেকে যেন আইজ্জা পাগলা এসে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল,
আদা আছে?
বেল্লাল ভয় পেয়ে যায়। অটোরিকশা থামায়। আইজ্জা পাগলাকে অত্র অঞ্চলের সবাই চেনে, বেল্লালের না চেনার কোনো কারণ নেই। আইজ্জা পাগলা কখনো কাউকে তাড়া করতো না। আক্রমণও করতোনা। সে শুধু জিজ্ঞেস করতো–
আদা আছে?
কিন্তু কয়েক দিন আগে এই গ্রামের মাতবর বশির তালুকদারকে দা নিয়ে তাড়া করেছে। নাগাল পেলে হয়তো মেরেই ফেলত। তাই বেল্লাল ভয় পাচ্ছে। আইজ্জা পাগলা শান্তভাবে আস্তে আস্তে বেল্লালের কাছে এসে উঁকি দিয়ে দেখে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর হাসে। থেমে থেমে হাসে। কী মুশকিল! পাগলের হাসি, কান্নার চেয়ে বিপদজনক। বেল্লাল কি করবে কিছুই বুঝতে পারে না। তারপর আইজ্জা পাগলা কি যেন ভেবে এলোমেলোভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে পথ ছেড়ে দাঁড়ায়। বেল্লাল অটোরিকশা স্টার্ট দেয়। কিছুদূর গিয়ে দুই তিনটা মাঝারি ধরনের কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে আবার বলা শুরু করে,
ভাইসব! ভাইসব! আগামী ষোলোই ডিসেম্বর, শুক্রবার মাদারীপুর রোটারি ক্লাবের সহযোগিতায় দিনব্যাপী এক চক্ষুশিবিরের আয়োজন করা হইবে…ভাইসব…ভাইসব… ।
বেল্লাল একপর্যায়ে বিশ্রাম নেয়ার জন্য টিবি হাসপাতালের মোড়ে গিয়ে থামে। সারা দিনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা একের পর এক তার মনে পড়তে থাকে। বিশেষ করে গহিনাকূল গ্রামের নিবু নিবু দৃষ্টিসম্পন্ন সেই বয়স্ক লোকটি এবং আইজ্জা পাগলার কথা। বেল্লালের বাড়ি পাশের গ্রামে। উত্তর ব্রাহ্মন্দীর ছেলে। সে শুনেছে, বশির তালুকদারকে দা নিয়ে তাড়া করার পর নাকি আইজ্জা পাগলা গ্রাম ছেড়েছে। কিন্তু কই? সে তো ভরদুপুরে এসে হাজির। এই পাগলাকে নিয়ে অত্র অঞ্চলে অনেক রকম গল্প আছে। সে অন্য পাগলদের মতো নয়। ‘আদা আছে?’ ছাড়া আর একটি কথাও সে বলে না। বেল্লালের মনে আইজ্জা পাগলার ব্যাপারে অনেক কৌতূহল। পরদিন থেকে সে আইজ্জা পাগলা ও গহিনাকূল গ্রামের খোঁজখবর নেয়া শুরু করল।
আইজ্জা পাগলার ধাওয়া খাওয়ার পর থেকে বশির তালুকদারের ঘুম হচ্ছে না। তিনি নিজের মনে ভাবেন, আকাম-কুকাম তো জীবনে কম করেননি। কিন্তু এত দিন তো কেউ তাঁকে এত বড় অপমান করতে সাহস পায়নি। সালেহার বাড়িতে তিনি গিয়েছিলেন, তাতে কী হয়েছে? ভালোভাবেই আদর-সোহাগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু ওই বদ মাগী এক লাফে ঘরের বাইরে গিয়ে দিল দৌড়। আর তারে নিয়া ওই পাগলা হালার কেন এত মাথাব্যথা? আমাকে দা নিয়ে তাড়া করতে হবে? সারাক্ষণ মাথার মধ্যে একটাই চিন্তা, কি দিয়ে কী করা যায়? আইজ্জাকে ঠিকমতো শায়েস্তা করতে হবে। ভুল করা যাবে না। কারণ, পাগলের প্রতি মানুষের আবার সহানুভূতির অভাব নাই। তবে যা কিছু করার দ্রুতই করতে হবে। যেকোনোভাবেই হোক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। পাঁচ দিন পর গহিনাকূল গ্রামের ছাপরা মসজিদে জুমার নামাজের খুতবা শেষে ধলু তায়ানিকে দিয়েই বশির তালুকদার কথাটি তুললেন,
কি মিয়ারা, তুমরা কি মুখ বুইজ্জাই থাকবা? কয় দিন থাকতে পারবা?
মুসল্লিরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে কথাটি বোঝার চেষ্টা করেন, ধলু তায়ানী আসলে কি বলতে চান। রুস্তুম কাজী না বোঝার ভান করে জিজ্ঞেস করেন,
কি অইছে? ভাইঙ্গা কন।
আর ভাইঙ্গা কওনের কি আছে? গ্রামে তো মোগো এট্টা মানসরমান আছে, নাকি?
আরোজ আলী ছাড়া প্রায় সবাই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি প্রকাশ করেন। দু-একজন হুঁ, হ্যাঁ-ও বলেন। বশির তালুকদার নীরবতা ভেঙে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলেন,
এট্টা বেশ্যার কতায় কেউইর মানসরমান যায় না। এত্তো সোজা না।
ধলু তায়ানী সাথে সাথে বলেন,
এইডা অইল আসল কতা। তয় বেশ্যার তো বিচার অওন দরকার। নইলে আইজ বশির তালুকদার, কাইল অমুক, পরশু তমুকের মানসরমান লইয়া টান দিব।
এখলাছ উদ্দিন সরদার মাথা নাড়তে নাড়তে মুখ খুললেন,
হ। অবশ্যই বিচার অইতে অইব। ওই মাগি তো আবার অপারেশন কইরা লইছে। প্যাড বাজনের কুনু ভয় নাই। সোমাজটারে নষ্ট কইরা হালাইল। কার লগে কী কইরা এহন সরমানী মাইনষের সরমান নষ্ট করতাছে! এই মিয়ারা যা জানো সব কইবা। যার ভাতারের খবর নাই, তার ভাতারের কুনু অভাব নাই, বুঝলা?
মসজিদের ইমাম সাহেব সবকিছু শুনে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে শুদ্ধ ভাষায় সুরেলা কণ্ঠে বললেন,
নাউজুবিল্লাহ। নাউজুবিল্লাহ মিনজালেক। সে জাহান্নামের কাজ করেছে। এই মহিলা যেদিক দিয়ে হেঁটে যাবে, সেদিক দিয়ে কোনো ফসল হবে না।
ইমাম সাহেবের কথায় উপস্থিত মুসল্লিরা সবাই নামাজের সালাম ফেরানোর মতো করে একে অপরের দিকে তাকালেন। আরোজ আলী তাঁর ছেলে আনেছকে ইশারায় উঠতে বলে মসজিদ থেকে বের হয়ে গেলেন। মসজিদ থেকে একটু দূরে এসে তিনি উদাসভাবে বললেন,
এই জেবনে আরো কত্ত কিচ্ছু যে দ্যাখতে অইব! আল্লাহর চোহে কি ছানি পড়ছে? এসব দ্যাহে না?
আনেছ তার বাবার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে পেছন পেছন হাঁটতে থাকে। ইমাম সাহেব মসজিদে উপস্থিত সবার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে আবার বললেন,
এ বিষয়ে হাদিসে বর্ণিত আছে, সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং ব্যভিচার, অনাচার বন্ধ করা প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব। অন্যথায় আল্লাহ পাকের কাছে আমাদের সবাইকে জবাবদিহি করিতে হইবে। হে পরোয়ার দেগার! রাহমানির রাহিম! আপনি আমাদের ক্ষমা করুন। আমিন।
মুসল্লিরা সবাই আগামী শুক্রবার বাদজুমা সালেহার বিচারের দিন ধার্য করে আলোচনা শেষ করলেন। এর মধ্যে সালেহা যাতে কোথাও কোনো বাড়িতে এমনকি নিজ বাড়ির বাইরেও না যায়, সেটা তাকে জানানোর জন্য ধলু তায়ানীকে দায়িত্ব দেয়া হলো। গহিনাকূলের মানুষ ইমাম সাহেবের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। এ পর্যন্ত গহিনাকূল ছাপরা মসজিদে যতজন ইমাম নিয়োগ করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে বর্তমান ইমাম সাহেবই সেরা। খুবই পরহেজগার ও এলেমদার মানুষ। নিয়মিত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েন। সারাক্ষণ শুধু এবাদত-বন্দেগি-জিকিরের মধ্যে থাকেন। তিনি ভীষণ যুক্তিবাদী আলেম। সুমিষ্ট কণ্ঠে তিনি খুতবা পাঠ করেন, বয়ান করেন। তাঁর বয়ান শুনে অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। তিনি ইমামতির দায়িত্ব নেয়ার অল্প দিনের মধ্যেই মসজিদে মুসল্লিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আজকাল জুমার নামাজে একটু আগেভাগে না গেলে মসজিদের ভেতরে জায়গাই পাওয়া যায় না। মসজিদ প্রাঙ্গণে নামাজ পড়তে হয়। এলাকায় তাঁর সম্পর্কে নানা রকম জনশ্রুতি আছে। অমাবস্যা রাতে তিনি প্রায়ই জিন-পরি নামান। জিন-পরির সাথে কথা বলেন। পরিরা এসে তাঁর সাথে হাসে, কাঁদে।
ইমাম সাহেব ব্যভিচার প্রসঙ্গে আরো অনেক কথাই বলতে পারতেন, কিন্তু একটা বিশেষ কারণে এ বিষয়ে তাঁর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কেমন যেন গলা কাঁপে। বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে। তা ছাড়া সেই কখন থেকে ক্ষুধাটাও খুব জানান দিচ্ছে। শুক্রবার এলেই দুপুরবেলা তাঁর ক্ষুধা বেড়ে যায়। কারণ একটাই। গ্রামের সব বাড়ির রান্নাবান্না এক রকম নয়। কোনো কোনো বাড়ির রান্না খুবই ভালো। আবার কোনো বাড়ির রান্না মুখেই দেয়া যায় না। কিন্তু তার পরও খেতে হয়। গ্রামের একেক বাড়িতে একেক দিন তাঁর খোরাকি ধার্য করা আছে। শুক্রবার তিনি জয়নালের বাড়িতে খান। জয়নালের বউ শেফালী দেখতে যেমন রূপবতী, তেমনি গুণবতীও বটে। তার হাতের রান্না খুবই সুস্বাদু। সামান্য তরকারিও বেহেশতি খাবার মনে হয়। ইমাম সাহেব জয়নালের বাড়িতে প্রতি শুক্রবার অত্যন্ত তৃপ্তি সহকারে পেট ভরে খান, আর তার পরিবারের সবার জন্য দোয়া-খায়ের করেন।
ইমাম সাহেব জয়নালের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়ার পর ধলু তায়ানী সালেহার বাড়িতে যান। ধলু তায়ানীর কাছে সবকিছু শুনে সালেহা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। হায় রে কপাল! অপারেশনের কথা ওঠায় সালেহার মনে পড়ল, নিজের ইচ্ছায় সে লাইগেশন করায়নি। শফিক হাওলাদার আলমকে বলেছিল,
লাইগেশন করলে সরকার পাঁচশো টাকা ও একটি শাড়ি দেয়।
আলম প্রায় জোর করেই সালেহাকে লাইগেশন করাতে নিয়ে গিয়েছিল। লাইগেশনের পর সালেহা শুধু পাতলা ফ্যারফেরে একখানা সুতি শাড়িই দেখেছিল, টাকার মুখ দেখেনি। সবকিছুর পর এত দিন মনে হয়েছিল লাইগেশন করে ভালোই হয়েছে। এত অভাবের মধ্যে দুটি সন্তান নিয়েই তো বেঁচে থাকা দায়, আরো বেশি হলে আর উপায় ছিল না। কিন্তু জীবনের এই বিশেষ পরিস্থিতিতে সেই লাইগেশনও এখন তার বিপক্ষে চলে গেছে। নানা রকম অপবাদ দিয়ে তাকে একঘরে করা হয়েছে। দুটো ভাত জোগাড় করতে যাকে মানুষের দ্বারে দ্বারে একটু কাজকর্মের জন্য যেতে হয়, তাকে যদি ফতোয়া দিয়ে একঘরে করে ফেলা হয়, তাহলে সে বাঁচবে কী করে? সমাজের মানুষের কি একবারও তা মনে হলো না?
বশির তালুকদারের বাড়ির টিউবওয়েল থেকে সালেহা পানি এনে খেত। এখন উপায়? পুকুরের পানি ফুটিয়ে খাওয়া শুরু করে, কিন্তু সেই পানি বাচ্চারা খেতে চায় না। স্বাদ নেই। ভালো লাগে না। রিপন টিউবওয়েল থেকেই অল্প অল্প করে পানি নিয়ে আসত। কয়েক দিনের মধ্যেই গহিনাকূল গ্রামটি সালেহার জন্য আরো গহিন, আরো অকূল হয়ে গেল। নানা রকম সমস্যা শুরু হতে থাকে। গ্রামে তার বিরুদ্ধে নানা রকম কথা রটতে থাকে। বিভিন্নজনের কাছ থেকে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন রকম নতুন নতুন বিশ্রী কথা কানে আসতে থাকে সালেহার।
বশির তালুকদার গ্রামের বিরাট মাতবর। তাঁর অনেক ক্ষমতা। বিশাল মান-মর্যাদা। তাঁর চরিত্রে কলঙ্কের দাগ পড়েছে। তিনি কি ক্ষমা করবেন? করবেন না। তাঁর কথায় কারো বিয়ে হয়, কারো তালাক হয়, কেউ চেয়ারম্যান-মেম্বর নির্বাচিত হয়, কেউ গ্রামছাড়াও হয়। কিন্তু এই সমাজে সালেহার মতো একজন অসহায় নারীর সম্ভ্রমের কি মূল্য আছে? জীবনেরও কোনো মূল্য নেই। তার মতো কত মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে খুন হতে হয়! লাশের ময়নাতদন্তও হয় না, আত্মহত্যা বলে দাফন-কাফন করে ফেলা হয়।
ধলু তায়ানী দুঃসংবাদটি দেয়ার পর থেকে সালেহার আছিয়াকে খুব মনে পড়ে। যদিও সালেহার ঘটনা আছিয়ার মতো নয়। আছিয়া কফিলউদ্দীন জমাদ্দারের একমাত্র মেয়ে। এই গ্রামে কফিলউদ্দীন জমাদ্দারের মতো নিরীহ মানুষ আর একজনও নেই। কালবৈশাখী ঝড়ের কবলে পড়লেও তিনি দৌড় দিতে পারেন না। তাঁর পায়ের নিচে ব্যথা। সেই পা দুটি দিয়েই রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন। একদিন সকালে আছিয়ার মা মেয়েটাকে নিয়ে এসে বললেন,
মাইয়াডারে তো স্কুলে দিতে পারি নাই। দ্যাখতে দ্যাখতে বিয়ার লায়েক অইয়া যাইতাছে। তুমি ইট্টু দোয়া-কালাম হিগাইয়া দেও। নোমাজ-কালাম না জানলে মাইনষে কী কইব? বিয়া দেওন লাগব না?
সালেহা আছিয়ার দিকে তাকায়। বয়স চৌদ্দ-পনেরোর বেশি হবে না। গ্রামে সবাই এই বয়সটাকেই বিয়ের বয়স মনে করে। সালেহা তার বাড়ির মক্তবে আছিয়াকে আসতে বলে। মেয়েটার মাথা ভালো। দু-চার দিনের মধ্যেই নামাজ পড়ার জন্য যতগুলো সুরা-কেরাত দরকার, তার সবই আছিয়া শিখে ফেলে। সালেহা তাকে ছিপারা পড়া শিখিয়ে তারপর কোরআন শরিফ দেয়। মাত্র তিন মাসেই মেয়েটা কোরআন শরিফ পড়তে শিখে ফেলে। অল্প দিনের মধ্যেই কোরআন খতম দিল। আছিয়ার বাবা খুশি হয়ে সালেহাকে একখানা শাড়ি উপহার দিয়েছিলেন।
বছর খানেক পর চাপরাশিবাড়ির নীলচানের সাথে আছিয়ার বিষয়ে গ্রামে একটা কানাঘুষা শুরু হয়। আছিয়ার পেটে নাকি বাচ্চা। কিন্তু নীলচান নিজেকে নির্দোষ দাবি করে। এমনকি প্রেমের কথাও অস্বীকার করে। মালেক চাপরাশি তাঁর গোষ্ঠীর ছেলে নীলচানকে রক্ষা করার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। রুস্তুম কাজী নীলচানের বাপের দিকের আত্মীয়। তিনি বশির তালুকদারকে সঙ্গে নিয়ে নীলচানকে নির্দোষ প্রমাণ করে, শুধু আছিয়াকেই অপবাদ দিয়ে একশো দোররা মারার ব্যবস্থা করেন। দোররা মারার একপর্যায়ে আছিয়ার গর্ভপাত হয়ে যায়। গ্রামের সবাই শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে। কেউ কিছু বলেনি। আছিয়া তারপর মাসখানেক বেঁচে ছিল। কফিলউদ্দীন জমাদ্দার মামলা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা-ও পারেননি। মেয়ের শোকে তিনি দিন-রাত শুধু কাঁদতেন। কাঁদতে কাঁদতে একসময় চোখের পানি শেষ হয়ে গেলে, তিনি আর চোখে দেখতেন না। মনের দুঃখে ঘুমাতে না পেরে রাতভর সারা গ্রাম হেঁটে বেড়াতেন। কেউ যদি তাঁকে রাতে হাঁটাহাঁটির কারণ জিজ্ঞেস করত,তাহলে তিনি বলতেন,
মোর জিন্যে তো দিন-রাইত একই কতা। দিনে হাঁটতে ভালা লাগে না। ভালা লাগব ক্যামনে? আলোর মইধ্যে কি আন্ধার দ্যাখতে কেউইর ভালা লাগে? হেই জিন্যে রাইতের আন্ধারেই সোমাজের আন্ধার খুঁইজ্জা খুঁইজ্জা দেহি। সোমাজের আন্ধার, রাইতের আন্ধারের চেয়েও বেশি।
নাজিমউদ্দিন কলেজে একবার চক্ষুশিবিরের লোকজন এলে তাঁকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিনি তাঁর চোখের চিকিৎসা করাতে রাজি হননি। যারা তাঁকে চক্ষুশিবিরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, তাদের তিনি পরিষ্কারভাবে একটা কথাই শুধু বলেছেন,
মোর তো মাত্র দুইডা চোখ। এই দুইডার চিকিৎসা করাইয়া আর কী অইব? এই সোমাজের এতগুলা চোখের চিকিৎসা দরকার। তাগো চিকিৎসা করাইতে পারবা? যুদি পারো, তাইলে যাইয়া করো।
কফিলউদ্দীন জমাদ্দারের কথার কোনো উত্তর কেউ দিতে পারেনি। কিছুদিন পর রাতের অন্ধকারে, তাঁর দৃষ্টিহীন চোখের আলোতেই সস্ত্রীক কোথায় যেন চলে গিয়েছেন! আর কোনো দিন গহিনাকূল গ্রামে ফিরে আসেননি।