জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি এই সময়টা ঢাকায় উৎসবের মৌসুম। তারই অংশ হিসেবে এখন চলছে ২০তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ২০২২। রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি ১৯৯২ সাল থেকে প্রতি বছর ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করে আসছে। ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব খুবই মর্যাদাপূর্ণ একটি চলচ্চিত্র উৎসব। এই চলচ্চিত্র উৎসব ইতিবাচক ও সুস্থধারার চলচ্চিত্র সংস্কৃতি গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখে চলেছে এবং তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বৈশ্বিক শৈল্পিক ধারার সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে দিচ্ছে।
গত ১৫ জানুয়ারি শনিবার বিকেলে জাতীয় জাদুঘরের মূল মিলনায়তনে হলভর্তি দেশী-বিদেশী অতিথিদের উপস্থিতিতে জমকালো সব অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে উদ্বোধন হয়েছে ২০তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের। উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। লেবানন ও জার্মানির যৌথভাবে প্রযোজিত ও মারিয়া ইভানোভা জেড পরিচালিত বিভিন্ন উৎসবে প্রদর্শিত ও পুরস্কারপ্রাপ্ত সিনেমা ‘দ্য অ্যাংগার’ প্রদর্শনীর মাধ্যমে চলচ্চিত্র উৎসবের সূচনা হয়। রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ আয়োজিত এবারের উৎসবের প্রতিপাদ্য ‘বেটার ফিল্ম, বেটার অডিয়েন্স, বেটার সোসাইটি’। ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত উৎসবে ৭০টি দেশের ২২০টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে। উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্য অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কে দোরাইস্বামী, উৎসবের পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামাল প্রমুখ।
এবারের উৎসবে ১২৫টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ফিচার ফিল্ম এবং ৯৬টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ও স্বাধীন চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে, যেখানে ১৮টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ফিচার ফিল্ম ও ২২টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ও স্বাধীন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করা হবে। এশিয়ান প্রতিযোগিতা বিভাগ, রেট্রোস্পেকটিভ বিভাগ, ওয়াইড অ্যাঙ্গেল, ট্রিবিউট, বাংলাদেশ প্যানারোমা, সিনেমা অব দ্য ওয়ার্ল্ড, শিশুতোষ চলচ্চিত্র, উইমেন্স ফিল্মমেকার, স্বল্পদৈর্ঘ্য ও স্বাধীন চলচ্চিত্র এবং আধ্যাত্মিক চলচ্চিত্র- এই ১০টি বিভাগে চলচ্চিত্রগুলো প্রদর্শিত হবে।
এশিয়ান ফিল্ম কম্পিটিশনে ২১টি, রেট্রোস্পেকটিভে ৫টি, ট্রিবিউটে ২টি, বাংলাদেশ প্যানোরমাতে ৯টি, ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে ৬টি, সিনেমা অব দ্য ওয়ার্ল্ডে ৪৭টি, উইমেন ফিল্মমেকারস সেকশনে ২৭টি, স্পিরিচুয়াল সেকশনে ২৯টি, চিলড্রেন ফিল্ম সেশনে ১৮টি, শর্ট অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম সেকশনে ৬১টি সিনেমা দেখানো হবে। সিনেমা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে স্বাধীন ও সৃজনশীল নির্মাতাদের ছবিকে প্রাধান্য দিয়েছে উৎসব কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মূল মিলনায়তন ও সুফিয়া কামাল মিলনায়তন, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তন ডি ঢাকা, স্টার সিনেপ্লেক্স, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালা অডিটোরিয়াম ও নন্দন মঞ্চ, জাতীয় পাবলিক লাইব্রেরির শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তন এবং প্রথমবারের মতো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাডেমি মিলনায়তনেও চলচ্চিত্রগুলো প্রদর্শিত হবে। শুধু জাতীয় জাদুঘরের মূল মিলনায়তন ও শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে ছবি দেখতে ৫০ টাকার টিকিট কাটতে হবে। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র দেখিয়ে বিনা মূল্যে ছবি দেখতে পারবেন।
চলচ্চিত্র উৎসবে এবারেও থাকছে ‘চলচ্চিত্রে নারীর ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনার। ১৬ ও ১৭ জানুয়ারি দুই দিনব্যাপী এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে ঢাকা ক্লাবে। ঢাকা ক্লাবের স্যামসন লাউঞ্জে প্রথম দিন ‘অষ্টম ঢাকা আন্তর্জাতিক উইমেন ফিল্ম মেকারস্ কনফারেন্স ২০২২’ ও দ্বিতীয় দিনে আলোচনা হবে ‘রেহানা মরিয়ম নূর: আ ফেমিনিস্ট স্টোরি অ্যাজ টোল্ড বাই মেন উইথ ভিশন’ বিষয়ে। এবং ১৬ ও ১৯ জানুয়ারি ২০২২ অঁলিয়াস ফ্রঁয়েজ মিলনায়তনে ‘ওয়েস্ট মিট ইস্ট’ চিত্রনাট্য প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। উৎসবটি শুধু ছবি প্রদর্শনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। উদীয়মান চলচ্চিত্রকারদের সহযোগিতা করতে তৈরি করা হয়েছে ওয়েস্ট মিটস ইস্ট স্ক্রিনপ্লে ল্যাব। এবার ১১টি প্রকল্প স্থান পেয়েছে। সেখান থেকে তিনটি প্রকল্পকে পুরস্কার দেওয়া হবে। আর ১১ জনকে নিয়ে হবে চার দিনের কর্মশালা।
নানা দেশের নানা ঘরানার ছবির পসরা মেলে ধরবে এবারের উৎসব। তবে আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকবে চলচ্চিত্রের দুই মহারথীর সিনেমা। এবার জাপানি চলচ্চিত্রকার ইয়াসুজিরো ওজু ও ফরাসি পরিচালক জ্যঁ লুক গদারের সিনেমা দেখানো হবে।
‘রেট্রোস্পেকটিভ’ শাখায় ওজুর পাঁচটি ছবি ‘টোকিও স্টোরি’, ‘টোকিও টোয়াইলাইট’, ‘ইকুইনক্স ফ্লাওয়ার’, ‘লেট অটাম’ ও ‘অ্যান অটাম আফটারনুন’ দেখানো হবে। ‘ট্রিবিউট’ শাখায় দেখানো হবে ফরাসি চলচ্চিত্রকার জ্যঁ লুক গদারের ‘পিয়েরে লে ফু’ ও ‘ব্রেথলেস’ ছবি দুটি। ফরাসি নবতরঙ্গ আন্দোলনের অন্যতম অভিনেতা জঁ পল বেলমন্দো। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ফরাসি চলচ্চিত্রে নবতরঙ্গ আন্দোলনে তাঁর নামও জ্বলে ওঠে। গত বছর মারা যান এই বিখ্যাত অভিনেতা। মূলত তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতেই এই দুটি ছবি রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উৎসব পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামাল।
এশিয়ান ফিল্ম কম্পিটিশনে দেখানো হবে ভারতের তামিল ভাষার ছবি পি এস বিনোথরাজের ‘পেবলস’। ছবিটি রটারডম চলচ্চিত্র উৎসবে টাইগার অ্যাওয়ার্ড জিতেছে। প্রযোজনায় তামিল তারকা নয়নতারা ও ভিগনেশ শিব। আছে ইরানের মোহাম্মদ হোসেইন মাহদাভিয়ানের ‘ওয়ালনাট ট্রি’। ছবির পরিচালক ইরানের ফজর চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালকের পুরস্কার পায়। তরিনো চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা ছবি কাভেহ মাজাহেরির ‘বোটক্স’ দেখা যাবে এই উৎসবে। এই বিভাগে ইন্দ্রনীল রায় চৌধুরীর ‘মায়ার জঞ্জাল’ও দেখানো হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন শাখায় এমন কিছু ছবি আছে, যা বুসান, সিঙ্গাপুর, সাংহাই, কারলোভি ভ্যারিসহ বিশ্বের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছে।
বাংলাদেশ প্যানোরমা শাখায় দেখা যাবে বাংলাদেশের বেশ কিছু আলোচিত ও নতুন ছবি। আছে নূরুল আলম আতিকের ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’, প্রসূন রহমানের ‘ঢাকা ড্রিম’, সাইদুল আনাম টুটুলের ‘কালবেলা’, এন রাশেদ চৌধুরীর ‘চন্দ্রাবতী কথা’, শবনম ফেরদৌসীর ‘আজব কারখানা’ ইত্যাদি।
এ বছর নতুন একটি শাখা খোলা হয়েছে ওয়াইড অ্যাঙ্গেল নামে। মূলত মেধাবী নির্মাতাদের ছবি দেখাতে করা হয়েছে এই বিভাগ। এই শাখায় দেখানো হবে জার্মানিপ্রবাসী বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকার শাহীন দিল-রিয়াজের ছয়টি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। এ প্রসঙ্গে উৎসব পরিচালক বলেন, ‘অনেক মেধাবী ও যোগ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা রয়েছেন, যাঁরা পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে পারেননি বা হয়ে ওঠেনি, তাঁদের ওপর আলোকপাত করাই এই বিভাগের উদ্দেশ্য।’ এই নির্মাতার সব কটি ছবি দেখা যাবে বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সে।
২৩ জানুয়ারি সমাপনী অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ২০তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ২০২২ এর পর্দা নামবে।
নির্তেশ সি দত্ত
প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা
ঢাকা, বাংলাদেশ।