চলছে পবিত্র মাহে রমজান। রমজান শেষে আসছে আমাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। সাথে সাথে চলছে আমাদের প্রস্তুতিও। প্রস্তুতি পর্বে ঈদ কেনাকাটা তো থাকছেই। আরও থাকছে খাবারের বৈচিত্র্যময় আয়োজনের পরিকল্পনাও। পরিকল্পনায় সর্বাগ্রে ঈদ উৎসব আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ থাকে মিষ্টিজাতীয় খাবার। তাই আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু নির্বাচন করছি খাবারে চিনির ক্ষতিকারকতা নিয়ে।
আমাদের জীবনে সব সুখানুভূতির মধ্যে সবচেয়ে আনন্দময় বস্তুটি হলো সুস্বাস্থ্য। সেজন্য শরীরের পরিচর্যা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বস্তুত মানব দেহ বেড়ে ওঠে, টিকে থাকে এবং যাবতীয় ক্রিয়াকর্মে সক্রিয় থাকে একমাত্র খাবারের গুণেই। একটি গাড়ির ইঞ্জিনের জন্য জ্বালানি তেলের যে ভূমিকা, মানবদেহের জন্য খাদ্যের সেই ভূমিকা।
সুতরাং বাঁচতে হলে খেতে হয়। কিন্তু অতি খাওয়াজনিত অসুস্থতা এমনকি মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। তাই স্বাস্থ্য সচেতনতার কোন বিকল্প নেই।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশুরোগ বিভাগের প্রফেসর রবার্ট এইচ লাস্টিগ ও তাঁর একদল সহকর্মী অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার ফলাফল নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেন। তারা দেখেছেন যে, অতিরিক্ত চিনি গ্রহণের ফলে বিপাকজনিত রোগগুলোর মানবদেহে তরান্বিত হওয়ার সাথে চিনির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে যেমনঃ উচ্চরক্তচাপ, কোলেস্টেরলের আধিক্য, ফ্যাটি লিভার, ডায়াবেটিস, মেদস্থুলতা ও বার্ধক্য। আর এই কারণেই বিশ্বজুড়ে চিনির আরেক নাম “হোয়াইট পয়জন”।
ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে অপুষ্টিতে আক্রান্ত মানুষের চেয়ে মেদবহুল মানুষের সংখ্যা শতকরা ৩০ ভাগ বেশি। মূলত এই মেদস্থূলতার অন্যতম কারণ চিনি। তাই চিনি খাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনা করে তারা এখন সোচ্চার হয়ে ওঠেছেন চিনির বিরুদ্ধেও। কারণ, খোদ আমেরিকাতেই শুধু বিপাকজনিত অসুস্থতার চিকিৎসায় বছরে ব্যয় হয় ১৫০ বিলিয়ন ডলার, যা আমেরিকার স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়িত মোট অংশের ৭৫ ভাগ। ফলে আমেরিকার সাবেক তিনজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও ইউএস জয়েন্ট চীফ অব স্টাফ -এর বর্তমান চেয়ারম্যান মেদস্থুলতাকে অভিহিত করেছেন ‘জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি’ হিসাবে।
সাম্প্রতিক একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, চিনিতে থাকা ফ্রুক্টোজ যকৃতে বিষক্রিয়া ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের কারণে মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। এসব রোগ তাৎক্ষণিকভাবে টের
পাওয়া না গেলেও ব্যক্তিস্বাস্থ্যের পাশাপাশি সামাজিক বিপর্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই জনস্বাস্থ্য রক্ষায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো চিনির উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
এক দশকও বেশি সময় আগে সমাজ মনোবিজ্ঞানী টমাস বিবার ও তার সহযোগীরা সামাজিক স্বাস্থ্যের ওপর এলকোহলের প্রভাব নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা পরিচালনা করেন। এর ভিত্তিতে ২০০৩ সালে একটি উল্লেখযোগ্য বইও প্রকাশ করেন তারা। বইটিতে বলা হয়েছে, এলকোহলের মতো চিনিও একইরকম সামাজিক দুর্গতি ঘটাতে পারে। এখন প্রায় সব ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাবারেই প্রচুর পরিমাণ চিনি ব্যবহৃত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যকৃতের ওপর ফ্রুক্টোজের বিষক্রিয়া এলকোহলের মতোই। কারণ, চিনির গাঁজনের মধ্যেই এলকোহল তৈরি হয়। চিনি এলকোহলের মতোই বিপদজনক ও আসক্তি সৃষ্টিকারী। চিনি যত খাওয়া হয়, তত এটি মস্তিষ্ককে উদ্দীপ্ত করে আরও খাওয়ার জন্যে। চিনি খাওয়ার ফলে গ্রেলিন, লেপটিন,ডোপামিন ইত্যাদি হরমোনের স্বাভাবিক প্রবাহ-ছন্দ কিছুটা হয়, যা মস্তিষ্কে ক্ষুধার অনুভূতি বাড়িয়ে দেয় এবং আমরা অতি পরিমাণ খাবার গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে উঠি।
এভাবেই আমাদের কাছে ভোগ্যপণ্য হিসাবে প্রায় সব খাবারেই চিনি একটি অন্যতম অপরিহার্য উপাদান হয়ে ওঠেছে। তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ এবার সরাসরি – তা হলো, চিনি এবং চিনিযুক্ত সকল প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় যেমন বিভিন্ন ধরনের কোমল পানীয়, সোডা, বোতলজাত জুস স্পোর্টস ড্রিংকস ইত্যাদি পণ্যেবিক্রয় কর ও মূল্য সংযোজন কর বাড়ানো। যেমনটি করা হয়েছে তামাক ও এলকোহলের ক্ষেত্রে। সম্প্রতি কানাডা, ইউরোপের কিছু দেশ এমন কি আমেরিকাও ইতোমধ্যে এ পদক্ষেপ অনুসারে কাজ শুরু করেছে। শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার যেমনঃ ফাস্টফুড, বিভিন্ন ব্রান্ডের কোমল পানীয় বোতলজাত জুসের ব্যাপারে শিশু-কিশোরদের নিরুৎসাহিত করে তুলতে উন্নত বিশ্বে অনেক স্কুল কলেজ তাদের ক্যাফেটেরিয়ার ভেন্ডিং মেশিন থেকে এসব খাদ্যপণ্য সরিয়ে নিয়েছে।
আমি আবারো বলছি, চিনি শরীরের জন্য এলকোহলের মতোই বিপদজনক। তাই এটি আসক্তি সৃষ্টিকারীও। বিজ্ঞানীরা চিনিতে দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ার সরাসরি সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছেন। শুনে অবাক হবেন যে, জাতিসংঘের সাম্প্রতিক ঘোষণা অনুযায়ী, ভবিষ্যতে এ রোগগুলো বছরে ৩৫ মিলিয়ন মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ভাবা যায়?
রসনা বিলাসী বাঙালি মাত্রই ভোজনপটু। তবে অতিভোজন জনিত কারণে স্বাস্থ্যহানী ঘটুক এটাও কারো কাম্য হতে পারে না। তাই গড়পড়তাভাবে দুকুল রক্ষাকরে চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই এখনি সময় বিষয়টা নিয়ে নতুন করে ভাববার।
হ্যাঁ, চিনি নিয়ে পাশ্চাত্যের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি আমাদেরকে এ ইঙ্গিতটিই দিচ্ছে যে, আমরা যাতে সময় থাকতে যেন সচেতন হই। সুতরাং আজকের শিশু আগামীর বাংলাদেশ। সুতরাং আগামী সুস্থ ও সবল প্রজন্ম গঠনে তাই একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আগে নিজেরা নিজের পরিবারকে সচেতন করে তুলব। পাশাপাশি যে যার যার অবস্থান থেকে কর্মক্ষেত্র, স্কুল-কলেজ এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়সহ চারপাশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা অতিরিক্ত চিনি গ্রহণের ব্যাপারে সবাইকে জোরালোভাবে সচেতন করে তোলায় সচেষ্ট থাকব। আপনার আমার সচেতনতাই পারে আমাকে, আপনাকে আমাদের পরিবাবারের সবাইকে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকরী ভূমিকা রাখতে। উল্লেখ্য যে,আমরা ইচ্ছে করলে সাদা চিনির পরিবর্তে লাল চিনি বা আখের গুড় ব্যবহার করতে পারি। তবে নিজ নিজ স্বাস্থ্যের পক্ষে তা কতটুকু গ্রহণ করা বিধেয় তা চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক করাই উচিত।
পরিশেষে বলব, চিনির মিষ্টতা যেন তিক্ততা হয়ে কারো জীবনে অভিশাপ হয়ে দেখা না দেয় এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
পিয়ারা বেগম : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক, বাংলাদেশ।