চিৎকার করো মেয়ে -অনীলা পারভীন

  
    

বাঙালী নারীর বুক ফাটে তো মুখ ফোটেনা, লজ্জাই নারীর ভূষণ- এমন সব প্রবাদ আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত। এসব প্রবাদ কতখানি ঠিক? এসবের প্রচলনই বা কে করেছিল? তা আজ আর হয়তো জানা সম্ভব নয়। আসলেই কি নারীদের মুখ ফোটে না? লজ্জায় অবনত থাকে তাদের মস্তিষ্ক? তারা নিজের কথা কি আসলেই বলতে চায় না? প্রতিবাদ করতে চায় না বা তাদের প্রতিবাদের কোনোই ভাষা নেই? নাকি তাদেরকে বলতে দেয়া হয় না বা বলার মত অবস্থা তাদের থাকে না?

১৮১৯ সালে রাজা রামমোহন রায় বলেছিলেন, ‘মহিলাদের মেধা বা বুদ্ধি আছে কিনা, পুরুষরা তার কোনো পরীক্ষা নেননি। তা সত্বেও মহিলাদের তাঁরা নির্বোধ বলে সাব্যস্ত করেন এবং মনে করেন যে, তাঁদের লেখাপড়া শেখার বা কোনো কথা বলার কোনো ক্ষমতা নেই।
রাজা রামমোহন রায়ের কথার সত্যতা মিলে এর কিছু বছর পরেই, যখন বাংলা ভাষার প্রথম আত্মজীবনী রচয়িতার উদ্ভব হয় একজন নারীর মাঝে। উনিশ শতকের শুরুতে, ইংরেজি ১৮৭০ ও বাংলা সন ১২৭৫ সালে, বাংলা ভাষায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী কোনো পুরুষ লেখক নয়, বরং গ্রামের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্চিত মহিলা লিখেছিলেন- তিনি রাসকুমারী দেবী। যে দেশে আত্মজীবনী লেখার কোনো রেওয়াজ ছিল না, সেই দেশের অজপাড়াগাঁর, যিনি সবেমাত্র লিখতে শিখেছেন, তিনি আত্মজীবনী লেখার ধারণা এবং উৎসাহ কোথায় এবং কিভাবে পেলেন? তার মানে কি এই নয় যে, নারীও তাঁর নিজের কথাটি বলতে চায়, জানাতে চায়?

বেগম রোকেয়া

১৮৬৩ সালে কৈলাসবাসিনী দেবী প্রবন্ধের বই বের করেন। এটাই কোনো বাঙ্গালি নারীর লেখা প্রথম প্রবন্ধের বই। তাঁর বইতে সেকালের বাঙ্গালি মহিলাদের জীবনচিত্র অসাধারণভাবে তুলে ধরেন। এছাড়াও বৈধবের যন্ত্রণা ও বাল্যবিবাহের সমস্যা নিয়ে তিনি তাঁর লেখনির মাধ্যমে জোর প্রতিবাদ জানান। যা কিনা সেই সময়ের হিসেবে অসীম সাহসিকতারই প্রমান পায়।
১৯০৪ সালে, মাত্র ২৬ বছর বয়সে বেগম রোকেয়া লিখেছিলেন, “প্রবল সব বাধা আগ্রহ করে যখনই কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলন করিয়াছে, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে”। তিনি আরো বলেছেন, পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষরা কেবল গায়ের জোরে মেয়েদের বঞ্চিত করেছেন সকল ন্যায্য অধিকার থেকে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে। এ তো গেল লেখনীর মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করা ও সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এছাড়াও সেই যুগে নারীরা আত্মহুতির মাধ্যমেও সমাজের অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এমনি একজন নারী ‘নাঙ্গেলি’।

১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দে কেরালার ত্রাভানকোর অঞ্চলে নাঙ্গেলি নামের অসম সাহসী, প্রতিবাদী নারী, মুলাক্করম কর আইন অগ্রাহ্য করে, স্তনকে আবৃত করেন। যেখানে বলা হয়েছিল, ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য কোনো হিন্দু নারী তাদের স্তনকে কাপড় দ্বারা আবৃত করে রাখতে পারবে না। যদি আবৃত করে তবে কর প্রদান করতে হবে। নাঙ্গেলি এই কর দিতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু শুল্কবিভাগের কর্মচারীরা জোরজবদস্তি করলে, নাঙ্গেলি ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের দুটি স্তন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে ফেলেন এবং একটি কর্তিত স্তন কলাপাতায় মুড়ে শুল্ক সংগ্রাহকের হাতে তুলে দেন। এর কিছু পরে রক্তক্ষরণে নাঙ্গেলির মৃত্যু হয়। নাঙ্গেলির মত অতি সাধারণ, গ্রামের একজন নারী এতখানি সাহস কিভাবে অর্জন করলেন, তা আজও একটি বিস্ময়! মানুষের অধিকার আন্দোলনে, নারীর মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নাঙ্গেলির নাম অগ্রভাগে থাকা উচিৎ ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা হয়নি। কারণ, ইতিহাস রচয়িতারা অধিকাংশই পুরুষ কিনা!

নাঙ্গেলি ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের দুটি স্তন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে ফেলেন এবং একটি কর্তিত স্তন কলাপাতায় মুড়ে শুল্ক সংগ্রাহকের হাতে তুলে দেন।

আরেকজন বীর নারী কমলা ভট্টাচার্য, বিশ্বের একমাত্র ‘মহিলা ভাষা-শহিদ’। ১৯ মে, ১৯৬১, অসমের শিলচরের এগারো জন বাঙালি, মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য এবং মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্মগত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম কমলা। শিলচর রেল স্টেশনে মাতৃভাষা অর্থাৎ বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষার দাবিতে একটি পিকেটিংএ কমলা অংশগ্রহণ করেন। এলোপাথাড়ি লাঠিচার্জে অবস্থানকারী জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ছোট বোনকে বাঁচাতে গিয়ে কমলা গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরন করেন। বিস্মৃত বিশ্বের একমাত্র নারী ‘ভাষা-শহিদ’ কমলা ভট্টাচার্যের নাম আমরা ক’জন জানি?

এমন বহু নারী যুগে যুগে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন। সেজন্য হয়েছেন অত্যাচারিত, অপমানিত। দিয়েছেন আত্মহুতি। তবু আজও আমাদের নারীদের গলায় পড়িয়ে দেয়া হয় কিছু প্রবাদ, কিছু সংস্কার, কিছু বাধ্যবাদকতার ফাঁস। দুঃখজনক হলো বহু শিক্ষিত, স্বাবলম্বী নারীরাও এখনো এইসব রাহুর প্রভাব থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারেন না।

রুমানা মনজুরকে আমাদের মনে আছে নিশ্চয়ই। যিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষিকা। তার মতো শিক্ষিত, স্বাবলম্বী একজন নারীকে স্বামী দ্বারা নির্যাতিত হতে হয়েছিল, যা খুবই হতাশাজনক। রুমানা যদি সমাজের তোয়াক্কা না করে, শুরুতেই প্রতিবাদ করতেন, তবে তাঁর মূল্যবান চোখ দু’টি হারাতে হতো না। শুধু কি রুমানা? এমনকি অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরের মতো মুক্ত-নিরাপদ জায়গায়ও নারীকে স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত হয়ে খুন হতে হচ্ছে। সম্প্রতি সিডনিতে দুজন নারীকে এভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
আমাদের সমাজে এমন অনেক হতভাগী নারী আছে, যারা প্রতিনিয়ত নানা রকম অত্যাচার, নির্যাতন, পাশবিকতার শিকার হচ্ছে। কারো খবর মিডিয়াতে আসে, কারোটা আসে না। কেউ অকালে প্রাণ হারাচ্ছে, নয়তো কেউ সারা জীবন ধুকে ধুকে জীবন পার করছে। এর মূল কারণ আর কিছুই নয়, লোকলজ্জার ভয়ে মুখ বন্ধ রাখা, প্রতিবাদ না করা। সুতরাং সন্তানের দিকে তাকিয়ে কিংবা সমাজের কারণে আর একটি দিনও সহ্য করা উচিৎ নয়। ভীতি কিংবা সহনশীলতা কোনোভাবেই নারীকে মুক্তি দিবে না। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, কেউই এখনো নারীর বান্ধব হয়নি। নারীর বান্ধব শুধুমাত্র নারী নিজেই। মা-বোনদের জেগে উঠতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

আমরা যেন ভুলে না যাই, আমাদের সমাজে রাসকুমারী দেবী, কৈলাসবাসিনী দেবী, বেগম রোকেয়া, নাঙ্গেলি বা কমলা ভট্টাচার্যের মত সাহসী নারীর জন্ম হয়েছিল। যারা আমাদেরকে নিজেকে প্রকাশ করার, প্রতিবাদ করার পথ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। এই সমাজ যেন আর কোনো কিছু দিয়ে দিয়ে নারীকে বেঁধে রাখতে না পারে। ‘বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’ আর নয়, বরং বুক ফাটা চিৎকারে তছনছ হয়ে যাক নারীর উপর সকল সহিংসতা, সকল অন্যায়, সকল অত্যাচার।

অনীলা পারভীন
লেখক; কর্মকর্তা, ইউনিভার্সিটি অফ সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments