ছোট গল্প । মুখোশহীন কয়েকটি প্রহর । শারমিন সুলতানা রাশা

  
    
শারমিন সুলতানা রাশা

অফিসে যাওয়ার সময় যে মুখোশটা রোজ পরে সেটি আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দীপন ভীষণ চিন্তিত। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। গতকাল রাতে বারান্দায় ধুয়ে শুকোতে দিয়েছিল আর সকালে উধাও। বারান্দা থেকে উড়ে যাওয়ারও কোন সুযোগ নেই। শিল্পীকে ডাকলো গলা ছেড়ে। শিল্পীও খুঁজে পেল না। আজ কি তাহলে অফিস যাবে না? সে কি করে হয়। গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং রয়েছে। আর আজই মুখোশটা হারালো। মুখোশ ছাড়াই বের হতে হবে। মুখোশবিহীন একটা দিন কেমন কাটবে- ভাবতে ভাবতে ঘুমন্ত মেয়ে টাপুরের কপালে চুমু খেয়ে অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়লো দীপন।
স্নেহা এ অফিসে নতুন । অনেক কিছুই এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। মিটিং শেষে দীপনের ডেস্কের সামনে গিয়ে দাঁড়াল । দীপন তার কাছে আসার কারণ জানতে চাইল। স্নেহা কাজ করতে গিয়ে একটা জায়গায় আটকে গেছে আর সেজন্যই…। দীপন স্নেহার ডিরেক্ট বসকে তার কাছে ডেকে পাঠাতে বললো, আর জানাল স্নেহার সাথে কোন কথা বলতে চায় না সে। স্নেহা ভীষণ অবাক । গতকালই দীপন বলেছিল যেহেতু তাদের প্রজেক্টের প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা কম তাই যে কোন সমস্যায় যে কেউ সরাসরি তার কাছে আসতে পারবে নির্দ্বিধায়। তবে আজ কেন এমন আচরণ?

স্নেহার ডিরেক্ট বস অতুল এল । অতুলকে দীপন যা বলল, স্পষ্ট শুনতে পেল স্নেহা। স্নেহা যা বুঝতে পারছিল না তা অতুলকে বুঝিয়ে দিয়ে বললো স্নেহাকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। স্নেহা ভাবছে ‘হাইরারকি’ মেইনটেন করা আর বৈষম্য কি আলাদা? নিজের শিক্ষাকে অসম্পূর্ণ মনে হতে থাকে স্নেহার।
অফিস আওয়ার প্রায় শেষ। দীপন চিনিছাড়া কফি খাচ্ছিল, আর ভাবছিল মুখোশ ছাড়া একটা দিন কোন রকম পার করা গেল। বাসায় গিয়ে মুখোশ খোঁজাটাই হবে প্রথম কাজ। ঠিক সেই সময় অতুল এল দীপনের কাছে। হাতে একখানা খাম।
‘কি ওটা?’
‘ রেজিগনেশন লেটার। ’
‘কার?’
‘ স্নেহার।’
দীপন রেজিগনেশন লেটারটা ড্রয়ারে রেখে দিল। যেন স্তূপে ছুড়ে ফেলা ময়লা।
‘যতসব আনপ্রফেশনাল’ – বিড়বিড় করে নিজের কথায় নিজেই হাসলো।
কলিংবেল বাজতেই টুপুর দরজা খুলে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে গেল। দীপন বাধা দিয়ে বলে, ‘আগে বাবা ফ্রেশ হয়ে আসি’। শিল্পীকে চায়ের কথা বলেই স্নানঘরে গেল। স্নানঘরের আয়নায় দেখলো বাসায় পরার মুখোশটাও কেমন নোংরা হয়ে গেছে। দীপন ভাবলো একটু পরিস্কার করে নেয়া দরকার। যথারীতি তাই করলো। ভেজা মুখোশটাকে শুকোতে দিয়ে মুখোশ ছাড়াই বেরিয়ে এল।

শিল্পীর বানানো চায়ে চুমুক দিয়ে বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠলো দীপন। ‘যাক অন্তত এই চায়ের জন্য হলেও তোমাকে দরকার । এর বাইরে তোমার যতটুকু প্রয়োজন এতদিনে ফুরিয়ে গেছে।’ – দীপনের কথায় শিল্পীর চোখ ছলছল করে উঠলো।
‘মাথাটা একেবারে গেছে?’- শিল্পী ঠাট্টা হিসেবেই ধরে নিয়ে বললো। কিছু ঠাট্টাও আঘাত করে খুব। দীপন শিল্পীর প্রশ্নের উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। বরঞ্চ পাল্টা প্রশ্ন করলো-
‘মুখোশটা খুঁজেছিলে?’
‘না’
‘কেন? মুখোশটাকে তোমার ফেলনা জিনিস মনে হয়? নাকি টাপুরের খেলনা? আজ একটা হারালে কাল আরেকটা?’
‘এমনভাবে বলছো যেন আমি হারিয়েছি!’
‘আমি হারিয়েছি। কিন্তু হারান জিনিস খুঁজে দিতে না পারলে তোমাকে আমার দরকার কিসের ? ’
টাপুরের ঘর থেকে প্রচন্ড আওয়াজ হচ্ছে। টাপুরের ঘরে গিয়ে দেখলো সব খেলনা এলোমেলো। দীপন সবসময় নিজেই গুছিয়ে দেয়। আজ তা করলো না।
‘টাপুর! তুমি এখনও দুই বছরের শিশু আছ? গোছাও সব। আর একটা শব্দও শুনতে চাই না এ ঘর থেকে।’
বাবার এমন ব্যবহারের সাথে একেবারেই পরিচিত নয় টাপুর। বাবার সামনেই সবগুলো খেলনা গুছিয়ে রাখছিল। হঠাৎ দীপনের চোখ পড়লো খেলনার স্তূপে পড়ে থাকা মুখোশটার দিকে। এটাই সেই অফিসে পড়ার মুখোশটা!
‘এটা এখানে কে এনেছে টুপুর, তুমি?’
টুপুরের মৌনতাকে সম্মতি ধরে নিয়ে প্রথমবারের মত গায়ে হাত তুললো বাবা। শিল্পী ছুটে এল। টুপুর মায়ের হাঁটুতে মুখ লুকিয়ে কাঁদলো। শিল্পী কিছুই বললো না।
ফিরে পাওয়া মুখোশটি কেমন স্বস্তির নিঃশ্বাস এনে দিল। মুখোশটি খেলতে খেলতে কেমন ময়লা করে ফেলেছে টুপুর। পরিস্কার না করলেই নয়। স্নানঘরে গিয়ে পরিস্কার করলো। মুখোশটা ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা বোঝার জন্য একবার পরে দেখলো। পরতেই একরাশ চিন্তা চোখের ভাঁজে ঠাই নিল। আজ স্নেহার সাথে এক অদ্ভুত ব্যবহার করেছে সে! এমনকি স্নেহার দেয়া রেজিগনেশন লেটারটা খুলেও দেখে নি! না এক্ষুণি স্নেহাকে বোঝাতে হবে।
রাত অনেক। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দীপন স্নেহাকে কল করলো। ভেবেছিল স্নেহা হয়তো রিসিভ করবে না। কিন্তু করলো। স্নেহাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বললো-
‘ স্নেহা। অতুল বোধ হয় আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারেনি বিষয়টি। কাল আমরা একবার বসতে পারি?’
স্নেহা একদিনের অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যবহার ভুলে সম্মতি জানাল। দীপন নিশ্চিন্ত হয়ে ফোন রাখলো।
মুখ থেকে খুলে ভেজা মুখোশটা শুকোতে গিয়ে দেখলো ঘরে পড়ার মুখোশটা ঝুলছে। দীপন কেমন ঘাবড়ে গেল। দ্রুত ঘরের মুখোশটা পরে নিয়ে শিল্পী আর টুপুরের কাছে গেল। টুপুরের ঘরে মা মেয়ে কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। এক পলক তাকিয়েই মনে হয় ওদের জন্য সব করতে পারে। ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে হয়। কান্না সংবরণ করতে মুখোশটাকে খানিক্ষণের জন্য খুলে রাখে। তারপর আবার তাকায় নিশ্চিন্তে চোখ বুজে থাকা চেনামুখ দুটির দিকে। দীপন ভাবে, ‘মুখোশ না পরে এমন নিশ্চিন্তে কি করে ঘুমানো যায়?’

স্কেচ ও অলংকরণ: দীপংকর গৌতম। 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments