জননী
শাহাদাত সাঈদ
করিমন বিবি বসে আছেন। ঢাকার পাশের শহরে, বড় একটি কারখানার প্রধান ফটকের সামনে।চারদিক অন্ধকার করে প্রচন্ড ঝড় বইছে। কাল বৈশাখী ঝড়। একটু অদূরে ধূলাবালি গোলক বেধে আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে । মানুষজন দোকানপাট বন্ধ করে এদিক সেদিক ছুটে চলেছে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য।গাছ গাছালি ভেঙে পড়েছে। বৈদ্যুতিক খাম্বা উপড়ে গেছে।করিমন বিবির সেইদিকে কোন খেয়াল নেই।তার চোখ কারখানার গেইটের মুখে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কে বের হচ্ছে, কে ঢুকছে তা দেখছেন। আজ এক সপ্তাহ যাবত এই কারখানাতে দিন একবেলা খেয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকেন এই করিমন বিবি। বয়স পঞ্চাশ চোখে ভালো করে ঠাহর করতে পারেনা। দিনশেষে সারাদিনের পাওয়া ভিক্ষাগুলো নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে পাশের খুপড়িতে গিয়ে রাত কাটান।আজ তিনদিন যাবত ঝড় বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা বাধিয়েছে।গলার টনসেল ফুলে গেছে,খুল্লুড় খুল্লুড় কাশছেন, তবু বসে বসে এই ঝড়বৃষ্টিতে ভিজে’ একটুও নড়েনা।
বাইরের ঝড়ের চাইতেও যে বড় ঝড় বইছে করিমন বিবির মনে।লোকচক্ষুর অন্তরালে সন্তানের জন্য হাহাকারের অনবরত রক্ত বৃষ্টি হচ্ছে বুকের ভেতর।সেই বৃষ্টি এই ঝড়বৃষ্টির চাইতেও কতটা ভয়ানক। তা শুধু করিমন বিবিই জানে।
বরিশালে এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে করিমন বিবির বাড়ি।কত সুন্দর সাজানো সংসার দুই ছেলে এক মেয়ে। ছেলেদের বউ, নাতি, নাতনি নিয়ে ভালোই দিন কেটে যাচ্ছিলো তাঁর। গ্রামে নতুন ইজি বাইক এসেছে পুকুরের দুইপাড়ের গাছ বিক্রি করে। মাছ ভর্তি পুকুর লিজ দিয়ে। ছোট ছেলেকে একটা ইজি বাইক কিনে দিয়েছেন।টানাপোড়নের সংসারে যদি একটু আয় উন্নতির আলো জ্বলে খারাপ কী? করিমন বিবির বড়ছেলের নাম রফিক। রফিকের বাবা মারা যাওয়ার সময় কিছু ধানি জমি, বাড়িতে ঘরের ভিটা এবং বড় পাড়বাঁধা পুকুর ছাড়া আর কিছুই রেখে যায়নি। করিমন বিবির সংসারে আর্থিক অস্বচ্ছলতা থাকলেও ভালোবাসার কোন কমতি ছিলোনা।
তখন ছিলো আষাঢ় মাস ঝুম বৃষ্টির ভেতর কোথাও গরুর জন্য ঘাস পাওয়া যাচ্ছিলোনা।করিমন বিবির ছোট ছেলে মাজিদ। গরুর জন্য ঘাস কেটে এনে গোয়াল ঘরে জমিয়ে রাখে।মাজিদের বড় চাচা তার গরু দিয়ে মাজিদের কেটে আনা ঘাসগুলো গো চর্বন করে দেয়।মাজিদ এসে দেখে বৃষ্টির ভেতর কষ্ট করে কেঁটে আনা ঘাসগুলো চাচা তার গরুকে দিয়ে সাবাড় করে দিয়েছে।মাজিদের মাথা গরম হয়ে যায়। চাচা মুরুব্বি মানুষ। রাগে তখন এতসব তার মাথায় ছিলোনা।মাজিদ ঠাস করে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয় চাচা হাবু মিয়ার বাম গালে।এই নিয়ে সেইদিন পুরা বাড়ি তোলপাড় হয়ে গেছে। হৈচৈ চিল্লাপাল্লা ঝগড়া চেঁচামেঁচিতে দশ বাড়ি খবর করে ফেলেছে হাবু মিয়া।
করিমন বিবি মাজিদ কে চাচার পায়ে ফেলে মাফ চাওয়াইছে।ভাইজান ও ছোট মানু বুঝেনাই। ওরে মাফ কইরা দ্যান।আম্নেগো পোলা।বাপ চাচাগো মতন শরীরের রক্ত গরম।মাফ চেয়ে মাজিদ কে নিয়ে করিমন বিবি ঘরে ঢুকে। হাবু মিয়া গোপনে তার ঢাকায় থাকা পাঁচ পুত্রকে খবর পাঠায়। তারা যেন খুব দ্রুত গ্রামে চলে আসে।
হাবু মিয়ার ছেলেরা খবর পেয়েই ব্যাগ ঘুছিয়ে বাড়ি আসে।অন্যদিনের চাইতে আজ বৃষ্টির মাত্রা অনেক বেশি। আকাশ অন্ধকার করে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। একটু পর পর আকাশের গুড়ুম গাড়ুম শব্দে মাটির পাটাতন কেঁপে উঠে।মুরগি গুলো ঘরের ঢিবিতে বসে পাকনার পইরের পানি ঝারে।হাসের ছা গুলোকে দেখা যাচ্ছেনা।পচিশটা হাসের ছা ডিম থেকে ফুঁটেছে মাত্র ‘ক’ দিন হলো।করিমন বিবি তাঁর ছোট মেয়েকে ডাকলেন নূরী ও নূরী -তেরো বছরের মেয়ে নূরী ফোকলা দাঁতে জবাব দিলো জ্বী মা..। দ্যাখতো হাসের ছা কোনদিকে গেছে। উঠানে নাই।নূরী কিছুক্ষন এদিক সেদিক চোখ ঘুরিয়ে মাকে নিয়ে এই তুমুল বৃষ্টির ভেতরে হাসের ছা খুঁজতে বের হইছে।নূরী বললো মা তুমি আসে পাশের ধান ক্ষেত গুলোতে খুঁজো আমি বরং নদীর পাড়ের দিকে যাই।
নূরী হাসের ছানা খুঁজতে খুঁজতে নদীর কাছে হাটু পানিতে দাঁড়ানো হোগলা গাছের ঝোপঝারের আড়ালে একদম নির্জন জায়গায় চলে এসেছে।
হাবু মিয়ার ছোট ছেলে নৌকায় বসে আছে ঘাসের বোজা নিয়ে। নূরী ডাকদিয়ে বললো ভাই আমাগো হাসের ছা দেখছেন?
হ দেখছি এই ঝোপের শেষ মাথায়। তুই নৌকায় উঠ। আমি তোরে হাসের ছার কাছে নিইয়ে যাবো।খবির মিয়া নূরীরে নৌকায় করে দ্রুত ঝোপের ভেতর আড়ালের দিকটায় নিয়ে যাচ্ছে। আকাশে গুড়ুম গুড়ুম করে দুুইটা বজ্রপাত হলো। ঝোপঝারের আড়ালে ভারী একটা পিটানো শরীর নূরীর ছোট্ট শরীরটাকে দুমড়ে মুছড়ে দিচ্ছে। নূরীর চিৎকার আকাশের গর্জনে চাপা পরে যায়। চোখের পানি বৃষ্টির পানিতে মিলিয়ে যাচ্ছে।নূরীর চোখের সামনে বার বার ভেসে ওঠে মা করিমন বিবির মুখখানা।
নূরী শক্ত হয়ে গেলো। প্রচন্ড এক ঘুষি হাকালো খবির মিয়ার মুখে।খবির মিয়া আঁতকে উঠতেই ঘাসের উপর থেকে ধারালো কাঁচি দিয়ে খবির মিয়াকে নাস্তানাবুদ করে নৌকা তীরে ভিড়াতে বাধ্য করে নূরী।খবির মিয়া আর শক্তি খাটাতে যায়নি।ততক্ষনে অনান্য নৌকা কাছা কাছি চলে এসেছে। নূরী বাড়ি চলে আসে। আতঙ্কে লজ্জায় এইকথা নূরী কাউকে জানায়নি।নূরীর পায়জমা পায়ের দিকটাতে ছিঁড়ে আছে।মা জিজ্ঞেস করতেই নূরী বলে ঝোপের গাছের সাথে লেগে ছিঁড়ে গেছে। করিমন বিবি বিশ্বাস করতে চায় না নূরীর এ কথা।নূরী ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদে।করিমন বিবির মনটা ভালোনা। ইদানিং সংসারে কেমন যেনো অশান্তির পূর্বাভাস লেগে আছে।আকাশের মতই আলো অন্ধকার খেলা করছে তাঁর সংসারে । রাতে হঠাত খবর এলো মাজিদরে কারা যেনো মেরে রাস্তায় ফেলে রেখেছে।মাজিদ বৃষ্টির ভেতর একটা খেপ নিয়ে দূরে গিয়েছিলো। যাত্রী নামিয়ে ফেরার পথে সন্ধ্যার পর এই ঘটনা ঘটে।করিমন বিবি বিলাপ দিতে দিতে দৌড় দেয়।অন্ধকারে ছুটে যায় রফিক, নূরী।মাজিদের বউ মাজিদের পাঁচ বছরের ছোট মাইয়াটাকে কোলে নিয়ে দৌড় দেয়। অন্ধকার বৃষ্টির রাতে যেন শোকপরী নেমে এসেছে এই ঘরটায়।মাজিদের দুইহাত মাথা থেতলানো।পাশেই রক্তেভেজা ইট পরে আছে। সন্তানের লাশ নিয়ে করিমন বিবির সে কি বিলাপ।ও বাছাধনরে আমার চোখের মানিক রে।ভাইয়ের লাশ ধরে বিমূর্ষ বসে আছে রফিক। মূর্ছা যাচ্ছে মাজিদের বউ।ছোট মেয়েটা এর কিছুই বুঝেনা।চোখে পানি নেই শুধু নূরীর।নূরী শুন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
ঐ রাতেই হাবু মিয়ার পাঁচ ছেলে এলাকা ত্যাগ করে। রাতের আঁধারে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে।
রফিক হাবু মিয়ার বড় ছেলেকে প্রধান আসামি করে থানায় মামলা করে।গরুর ঘাস নিয়ে চাচ
চাচাকে থাপ্পড় মারাতে চাচা তার ছেলেদের ঢাকা থেকে ডেকে এনে সুপরিকল্পিত ভাবে এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন ।
খুনিদের ছবি সহ পোস্টার করে রফিক গ্রামের প্রতিটা বাজারে বাজারে লাগিয়ে দিয়েছে।খুনিদের ধরিয়ে দিন। খুনিদের ফাঁসি চাই। ফাঁসি দিতে হবে।সেই সব পোষ্টার ভর্তি নাানান স্লোগানে। খুনিরা পালিয়ে থাকায় পুলিশ কাউকেই গ্রেফতার করতে পারছিলোনা।এর ভেতরে কয়েকবার রফিক ভাইয়ের খুনিদের ঠিকানা জানতে ঢাকায় এসেছিলো,বিভিন্য ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়িয়েছে।অবশেষে রফিক হাবু মিয়ার বড় ছেলে খুনি করিম মিয়ার সন্ধান পেয়েছে।এই কারখানার ইঞ্জিনিয়ারিং পদে চাকরী করে করিম মিয়া। ভালো টাকা বেতন পায়।সবাই তারে স্যার স্যার বলে ডাকে।সাড়ে চোদ্দহাজার শ্রমিকের এই কারখানাতে করিম মিয়াকে খুঁজে পাওয়া বড় কঠিন কাজ।তার উপর রফিক তার ঠিকানা জেনে গেছে টের পেলেই পালিয়ে যাবে।
তাই আজ এক সপ্তাহ যাবত
রফিক অদূরে টং দোকানের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে। করিমন বিবি বড় ঘোমটা টেনে বসে থাকে ছেলের খুনিকে ধরার আশায়। লোকে ভিক্ষুক মনে করে টাকা ফালায় সামনে রাখা স্টিলের প্লেটে।
ঝড় থেমে গেছে। দোকান পাটে আবারো লোক আড্ডা জমতে শুরু করেছে।ঠিক তখনই লম্বা, কালো করে, চোখে সানগ্লাস, পায়ে শো জোতা পরা এক ভদ্রলোক সিগারেটে টান দিয়ে কারখানার গেইট দিয়ে বের হলো।
করিমন বিবি এক লাফ দিয়ে জড়িয়ে ধরে বিলাপ শুরু করে দিয়েছেন। তুই আমার ছেলেরে কেন মারলিরে।ও বাছাধনরে তো আর পাবোনারে।
রফিক আড়াল থেকে এসে ঝাপ্টে ধরেছে করিম মিয়াকে।করিম মিয়া ছুটার জন্য ধস্তা ধস্তি শুরু করে দিয়েছে। ততক্ষনে চায়ের দোকানের লোকজন জমা হয়ে হুলুস্হুল শোরগোল পড়ে গেছে। করিম মিয়া ঝাড়ি মেরে বলে। কে আপনারা? আমি আপনাদের চিনিনা। রফিক সাথে সাথে ব্যাগ থেকে খুনিদের ছবির সেইসব পোস্টার।ও মামলার কাগজ বের করে উপস্হিত সবাইকে দেখায়। জনতার হাতে ধরা পরে যায় করিম মিয়া।করিমন বিবি বিলাপ দিয়ে বলে তোমরা আমার সন্তান। তোমরা ওরে ধরো ও যাতে পালাইয়া যাইতে না পারে।স্হানীয় কিছু লোকাল মানুষ করিম মিয়াকে শক্ত করে ধরে ফেলে।করিম মিয়া জোর খাটানো বাদ দিয়ে বুদ্ধির খেলা খেলতে চেষ্টা করে।উনি আমার চাচি, আমার চাচাতো ভাই। পারিবারিক ঝামেলা আপনারা এর ভেতর আইসেননা এই বলে করিম মিয়া ।তার এক কর্মচারিকে ফোন করে টাকা নিয়ে আসতে। টাকা বিশ হাজার এনে করিমন বিবির হাতে দেয়ার চেষ্টা করে ।সন্তান হত্যা বাবদ বিশ হাজার টাকা।আজকে একসপ্তাহ যাবত ঝড় বৃষ্টিতে ভিজে। ভিক্ষা করার কৌশল অবলম্বন করে। ছেলের খুনিকে বহু কষ্টে হাতে পেয়েছেন।করিমন বিবি রুদ্রমূর্তি ধারন করে। টাকা হাতে দিতেই কষিয়ে একথাপ্পড় বসিয়ে দেয় করিম মিয়ার মুখে।
রফিক ঢাকায় এসে ছদ্মবেশে যখন জানতে পারে খুনি এই এলাকায় থাকে। মামলা তখন-ই বরিশাল থানা থেকে এই স্হানীয় থানায় হস্তান্তর করে নিয়ে আসে।পুলিশকে ফোন করেছে রফিক। আর আধঘন্টা লাগবে এখানে এসে পৌছাতে। ততক্ষন যে করেই হোক করিম মিয়াকে আঁটকে রাখতে হবে। যাতে কোনো ক্রমেই পালিয়ে যেতে না পারে। টেনশনে করিম মিয়ার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে।সিগেরেটের পর সিগারেট ফুঁকছে। কোনক্রমেই পালানো যাবেনা। দৌড় দিলে জনতার হাতে চ্যাংধোলাই খেয়ে জানটাই খোয়া যাবে।থানায় গেলে বড়জোর টাকা দিয়ে যদি বাঁচা যায়।
পুলিশ চলে এসেছে করিমন বিবি দৌঁড়ে গিয়ে পুলিশের পা ধরে বলছে স্যার, স্যারগো আমার সন্তানেরে শেষ করে দিছে, ও যাতে না ছুটতে পারে কোনদিনও না।আপনারা টাকা খাইয়া ছাইড়া দিয়েননা। পুলিশ করিম মিয়াকে হ্যান্ডক্যাপ পরিয়ে গাড়িতে তুলেছে। করিমন বিবি শূন্য দৃষ্টিতে গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে তার চোখে মুখে অবিশ্বাস খেলা করছে। তিনি এই মুহূর্তে কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেননা।বিচার হবেতো? নাকি খুনি মোটা অংকের টাকা দিয়ে ছাড় পেয়ে যাবেন। ন্যায় বিচার হলে খুনির ফাঁসি বা মৃত্যুদন্ড হবে।আর যদি ছাড়া পেয়ে যায়, তবে করিমন বিবি নিজ হাতে পুত্র হত্যার শোধ নিবেন।হাবু মিয়ার বাকি চার ছেলেকে খুঁজে বের করতে হবে, হয়তো লুকিয়ে আছে এই শহরের কোথাও।সি এনজি নিয়ে পুলিশের গাড়ির পেছন পেছন থানার দিকে রওনা হলেন করিমন বিবি ও রফিক।গাড়ির চাকার চেয়ে দ্রুত গতিতে ঘুরছে করিমন বিবির দৃষ্টি।রফিক আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো আলহামদুলিল্লাহ।