
সূর্য কোথা থেকে এমন খেলা পাগল হলো এই প্রশ্নের উত্তর যখনই খুঁজতে যাই, ফিরে যাই নিজের ছেলেবেলায় বা মেয়েবেলায়। এক সময়ের এমন খেলা পাগল মানুষটি কিভাবে এমন নিস্পৃহ হয়ে গেলাম নিজেকে কতবার যে এই প্রশ্নটি করেছি! উত্তর পাইনি। বুঝতেও পারিনি কখন যে এমন হয়ে গিয়েছি! বয়স ১২-৩০। পাগলের মতো খেলা দেখতাম। ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস। বাবা – মা বলতো, “এতো খেলা দেখবার দরকারটা কি! খবর রাখলেই তো চলে!” তখন তো বুঝিনি যে তাঁরা তখন আমাদের আজকের মতো জীবনের স্তরে বসবাস করছেন! আমি ছিলাম ব্রাজিলের অন্ধ ভক্ত, টেনিসে আর্জেন্টিনার সাবাতানি, জার্মানির বরিস বেকার, সুইডেনের স্টেফান এডবার্গ, ক্রিকেটে তো বলাই বাহুল্য – শচীন টেন্ডুলকার। কলকাতা থেকে শচীনের জীবনী অনিয়েছিলাম বাবাকে বলে। খুব সহজলভ্য ছিলো না তবু বাবা খুঁজে সেই বই কিনে এনে দিয়েছিল! সে কি খুশী আমার! বিশ্ববিদ্যালয় এ বাইরের লোকজনও শুরু করেছিল আমাকে জিজ্ঞেস করা – তোমার রুমে নাকি শচীনের ১০০ টা Posters আছে! হ্যাঁ, পোষ্টারের century করেছিলাম। রাত – বিরেতে উঠে রোকেয়া হলের দাদুদের কনভিন্স করে গেটের তালা খুলে tv রুমে গিয়ে খেলা দেখেছি কতদিন! কুয়াশাঢাকা ভোরে বন্ধুরা মিলে ঢাকা স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখেছি। আর সেই আমি বিশ্বকাপ হচ্ছে, ছেলের কাছ থেকে খবর নিচ্ছি কখন খেলা, কার খেলা, কারা ভালো খেলোয়াড়! হাতে গোনা খেলোয়াড়দের নামও জানি না। ভাবতেই পারি না, ভাবতে চাইও না কারণ ভাবলেই নিজেকে মূর্খ মনে হতে থাকে। জীবনে শুধুই ছুটছি। কিসের জন্য, কার পেছনে জানি না। সেই ছোটবেলায় সামাজিক গণযোগাযোগমাধ্যম ছিলো না। মাধ্যম বলতে খবরের কাগজ, দূরদর্শন বা বিটিভি। ব্রাজিলের বড়ো ভক্ত কিন্তু ইতালির ব্যাজিওর খেলা দেখেও মুগ্ধ। পেপার কাটিং করতাম আবার সেই গুলো মলাট বাঁধানো খাতায় তারিখ দিয়ে আটকে রাখতাম! কি না করেছি! খুঁজে, খুঁজে কবে কখন ইউরোপীয় কাপ ফাইনাল, কোপা আমেরিকার খেলা, কে কোন ক্লাবে খেলছে… সব মুখস্ত! তো ছেলেও হবে না কেনো! সূর্যর মাঝে নিজের প্রতিবিম্বই দেখি আর অবাক হই। এভাবেই কি সময় ফিরে, ফিরে আসে!
সে যাই হোক! বিশ্বকাপ দেখবো না কিন্তু যেদিন ব্রাজিলের প্রথম খেলা, থাকতে না পেরে চুপি, চুপি ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে কারও ঘুম না ভাঙিয়ে পা টিপে, টিপে টেলিভিশনের শব্দ বন্ধ করে খেলা দেখলাম। সকালে দুই ছেলেই মা – র পাগলামোর কথা জেনে যারপরনাই পুলকিত! বড়োজন তো মহা খুশী! খেলা একবার দেখা আরম্ভ করলেই তো সমস্যা! ভালোবাসা আর প্রত্যাশা – দুটো তো হাত ধরাধরি করে চলে। তাই প্রিয় দল ব্রাজিলের এরকম অপ্রত্যাশিত বিদায়ে হৃদয় ভেঙ্গে চুরমার। ভেবে তো ছিলাম যে হৃদয় বোধহয় মরে গেছে। কিন্তু আবিষ্কার করলাম খেলা দেখতে বসে এখনও আন্দোলিত হই, নিজের অজান্তেই নানা রকম সংস্কারের আশ্রয় নেই – সেই আগের মতোই। আরও মজা লাগে যখন দেখি ছেলেরাও এগুলো করে। Good luck jersey পরে খেলা দেখতে হবে নইলে আর্জেন্টিনা হেরে যাবে। এই সোফায় বসলে গোল হবে, উঠলেই গোল খেয়ে যেতে পারে – এরকম নানা রকম অদ্ভুতুড়ে সব কুসংস্কার পুরোনো দিনের কথাই মনে করিয়ে দেয়। নস্টালজিক হয়ে পড়ি।
ব্রাজিল না থাকুক কিন্তু বিশ্বকাপ ফাইনাল তো দেখতেই হবে। ভাগ্যিস খেলা রাত ১১ টায় ছিলো! রাতও বেশি জাগতে পারি না আজকাল! ছুটি চলছে তাই সকালে অফিসে যাবার নেই তাড়া। মেসি, মেসি করে দুই ছেলেই অস্থির। আমি ভাবছি এরকম কতোই তো শুনেছি এবং দেখেছি স্টার খেলোয়াড়দের! ফাইনালে এসে সবাই কেমন নিষ্প্রভ হয়ে যায়। চাপ সহ্য করতে পারে না। ফ্রান্সেরও স্টার খেলোয়াড় আছে – এমবাপে (গত ওয়ার্ল্ডকাপ এ নাকি আমি এর খেলা দেখে বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলাম! ছেলে মনে করিয়ে দিল 🙄) আর আর্জেন্টিনার তো মেসি! অনেক আশা নিয়ে বসলাম যে ভালো একটা খেলা যেনো হয়! একতরফা যেনো না হয়! প্রথমার্ধে ফ্রান্সের খেলা দেখে ভাবছি ঘুমাতেই যাবো কিনা! দ্বিতীয়ার্ধে ও খানিকটা একই যখন অবস্থা, তখন নিজেকেই নিজে বলছি এরকমই তো হওয়ার ছিলো! কোথায় এম্বাপে! সবে বলেছি যে তাকে তো মাঠে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না! বলতে, বলতেই পেনাল্টি আর কি অসম্ভব একটা গোল! এবার back to reality! যতো যাই হোক লাতিন আমেরিকার ভক্ত! কিন্তু এ যে আবার জিততে, জিততে হেরে যাওয়ার অবস্থা! সবাই মিলে শুধূ ভাবছি এই ৮ মিনিট অতিরিক্ত সময়টা যেনো কোনোভাবে পার হয়ে যায়! হলো ভালোয়, ভালোয়! আবার ড্রামা! এবার মেসি! এমবাপে আর মেসি – দুজনেই যে এভাবে পুরোনো সব ভুল ভেঙ্গে দেবে এই খেলা যে না দেখেছে তার পক্ষে অনুধাবন করা অসম্ভব! অসাধারণ বিশ্বকাপ ফাইনাল, অসাধারণ ফুটবল – পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা খেলাটা দেখে আর দুই ছেলের বিজয় আনন্দ দেখে ভুলে গেলাম ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ থেকে হারানোর শোক।
জয় হোক ফুটবলের।
জয় হোক লাতিন আমেরিকার ফুটবলের।
জয় হোক সেই সব মস্ত খেলোয়াড়দের যারা তাদের শৈশব, কৈশোর ভুলে গিয়ে নিজেদের তৈরী করেছে দেশের হয়ে খেলবে বলে, দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে বলে আর বিশ্বের কোটি মানুষের দুঃখ ভুলিয়ে দেবে বলে। তাদের আত্মত্যাগ, বীরত্ব, দীর্ঘদিনের অনুশীলন যুগে, যুগে যেনো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের মানুষকে অনুপ্রেরণা দেয়।