ভাল খাবার কে না খেতে চায়?
ভাল সুযোগ কে না পেতে চায়?
ধরুন আপনি গান গাইতে চান। গান তো আর একা একা গাইলে হয় না। সাথে সঙ্গত দরকার। ঠিক আছে আপনাকে রিদেমিষ্ট দেয়া হলো, সাথে আর কিছু বাদ্যযন্ত্র দেয়া হোল। আর যারা ওগুলো বাজাবে তাঁরাও তুখোড়। আপনি তো খুশীতে ডগবগ করবেন।
থামুন। থামুন। এখনও তো সব কিছু দেয়া শেষ হয়নি।
সেই দক্ষ দলের সাথে চমৎকার সাউন্ড সিস্টেম দেয়া হোল। এবার বাকি রইল একটি স্টেজ। আহা আপনাকে শুধু স্টেজ দেই কি করে? ওখানে তো কিছু আলো দরকার। ঠিক আছে। মামুলী কিছু আলো না দিয়ে আপনাকে প্রফেশনাল লাইটের সেটআপ দিলাম। আপনি নিশ্চয়ই ভাববেন – এতো কিছু যখন দিলাম তাহলে হল ভর্তি দর্শক কেন দিব না?
ঠিক আছে। ঠিক আছে। হল ভর্তি দর্শকও দিলাম। বোনাস হিসাবে একজন চৌকস উপস্থাপক দিলাম। আর কি চাই? আর কিছু দেবারও নেই। এখন আপনার পালা। আপনি এখন গান গাইবেন। এই গানটি কিন্তু আয়োজকগন গাইবেন না। কারন উনারা তো গানের শিল্পী নন। উনাদের কাজ উনারা করেছেন। এবার শিল্পীদের কাজ শিল্পীদের করতে হবে।
পথ প্রোডাকশন এই আয়জনের কাজটি করল। আর গানগুলো তৈরি করার জন্য উজ্জ্বল একটানা রিহার্সাল করলো। সাথে যোগ দিল একদল শিল্পী।

সেদিন আবহাওয়া ছিল চমৎকার। বৃষ্টি নেই। তবে ভীষণ ঠাণ্ডা ছিল।
আমি আর মৌসুমি সেই জলসায় যাবার আগে ঠিক করে নিয়েছিলাম যে হয়ত নতুন, তরুণ এবং তুখোড় কয়েকজন শিল্পী ১৫ থেকে ২০ টি গান গাইবে। ওখান থেকে পাঁচটি গান মনে ধরলেই আমরা খুশী হবো।
জলসা শুরু হোল।
আমি ধারণা করেছিলাম ক্রিকেটে যেমন ওপেনিং বোলারকে প্রথম কয়েকটি বল – দারুন ভাবে করতে হয় যেন ব্যাটসম্যান একটু সচেতন হয়, ঠিক তেমনি গানের অনুষ্ঠানেও প্রথম কয়েকটি গান দিয়ে দর্শকদের বুঝিয়ে দিতে হবে, ‘মনোযোগ দিন, ফোন বন্ধ করুন, গাল গপ্পো বাদ দিন। এবার আমাদের গান শুনুন’।
প্রথম ওভারটি ভাল হোল। ‘এ শুধু গানের দিন’ দিয়ে বুঝিয়ে দিল আমরা এখন কেবল গান শুনবো। কিন্তু দ্বিতীয় ওভারে কেমন ওলট পালট হয়ে গেল। সবাই প্রত্যাশা নিয়ে ‘পাম্পড’ হয়ে বসে আছে। তখন কি আর হালকা বল ভাল লাগবে? খেলার শুরুতে তো আর লেগ বাই বা নো বল দেয়া যাবে নারে ভাই।
জলসার খেলায় পুরো টান টান ওভার করলো উজ্জ্বল। ‘হারানো দিনের কথা’ দিয়ে। চমৎকার গায়কী আমাদের আবার খেলায় নিয়ে এলো। উজ্জ্বল মঞ্চে এলে মঞ্চটি উজ্জ্বল হয়ে যায়। এ বছর উজ্জ্বল আরো অনেক জ্বলে উঠেছিল। তাই পুরো জলসা ধরে রেখেছিল। সেই সাথে যোগ দিয়েছিল রুপসা। জলসায় মাঝে মাঝে যে দু একটা বাউন্ডারি হয়নি তা নয়। যেমন লামিয়ার গাওয়া ‘ময়না গো’ চমৎকার লেগেছে। জিঊ বিশ্বাসের ‘চন্দনা গো ‘ , নিলাদ্রির শেষের গানটি , নাবিলার আমি বনফুল – ভাল লেগেছে। সব কিছু ছাপিয়ে যে দুটা গান আমার কানে আটকে ছিল – উজ্জলের ‘তারাপকে তারাপকে’ আর রূপসার ‘ মেরে ঢোলনা / আমি যে তোমার।’ গানের সাথে কোরিয়গ্রাফির চেষ্টাটা ভালো লেগেছে।

আর একটি কথা বলা হয়নি। গান যেমন উপভোগ করেছি – সেই সাথে বোনাস হিসাবে পেয়েছিলাম শুভজিৎ এর ‘উইটি উপস্থাপনা’। কয়েকটি গানের সুত্র চমৎকার করে ধরিয়ে দিয়েছিল বলেই গানগুলো শুনতে ভাল লেগেছে।
সিডনিতে পরিশীলিত, পরিকল্পিত অনুষ্ঠান খুব কম দেখা যায়। গানের অনুষ্ঠান যখন মঞ্চের ওয়ারকিং লাইট দিয়ে হয় তখন আমার আর আগ্রহ থাকে না। অনুষ্ঠানের আগে যখন সাইন্ড ঠিক করে, আর অনুষ্ঠানের মাঝখানে গান থামিয়ে বলতে হয় – কিছু শোনা যাচ্ছে না, তখন সেই অনুষ্ঠানের জন্য কোন ভালবাসা জন্মায় না। জলসার অনুষ্ঠান ভাল লেগেছে কারন – গানগুলো একের পর এক হয়েছে। বুঝা গেছে – সবাই প্রস্তুত। গান তো কেবল শোনার নয় – কি ভাবে গানটি গাওয়া হোল মঞ্চে সেটাও একটি ব্যাপার।
মঞ্চে যারা অনেক বাদ্যযন্ত্র নিয়ে ছিল – তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ। নিলাদ্রির পরিপক্কতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আর ওই যে ছেলেটি যে বাঁশী আর সেক্সোফোন বাজাচ্ছিল – বাঙালী নয়, কিন্তু বাংলা গানে ঠোট মিলাচ্ছিল। আমার কিন্তু দারুন লেগেছে। তবলা যে বাজিয়েছে – উনার বাজনা আগে মনে হয় শুনিনি। কি দুর্ভাগা আমি!

জলসার সাউন্ড ব্যালেন্স চমৎকার ছিল। আর হলটি ছিল পারফেক্ট। আমি একটি হিসাব বুঝিনা। আমি ভাল বাজার করলাম, বাজারের সবচেয়ে দামী জিনিস কিনলাম। তারপর রান্না করার জন্য ভাল চুলা ভাড়া করলাম না। আমার রান্না কি ভাল হবে? টিম টিম করা চুলায় তো আর ভাল রান্না হবে না। ভাল অনুষ্ঠান করার জন্য ভাল হল ভাড়া নিতে হবে। জলসা তো তাই করে দেখাল। এই অনুষ্ঠানটি যদি একটি কমিউনিটি হলে হতো – তাহলে এই অনুষ্ঠান আমি দেখতে যেতাম না। কারন আমি জানি ওখানে অনুষ্ঠানের নামে একটি মেলা হবে। যেখানে গান শোনার আগ্রহ থাকবে না। দর্শক ছবি তুলবে আর গল্প করবে যত আগ্রহ নিয়ে – গান তত আগ্রহ নিয়ে শুনবে না। আমি মনে করি আমরা ছবি তুলব, গল্পও করবো – কিন্তু মন দিয়ে গান শুনবো। আর দর্শকদের ধরে রাখার দায়িত্বটি হচ্ছে শিল্পীর। ওই যে বললাম, আপনাকে সব দেয়া হোল – কিন্তু গানটি আপনাকে গাইতে হবে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় – কারো কারো জন্য এই সুযোগটি কি ‘টু আর্লি?’ জীবনে অনেক কিছু নেগোসিয়েট করতে হয়। কিন্তু শিল্পীর কাছে ‘শিল্প’ হচ্ছে প্রার্থনা। এই প্রার্থনায় পবিত্র হওয়া ভীষণ জরুরি। নেগোসিয়েসন এর জায়গা নেই তো।

জলসার জন্য পথ প্রোডাকশন এর দরদ, উজ্জলের কমিটমেন্ট দেখে আমি একটি স্বপ্ন দেখছি। অস্ট্রেলিয়াতে অনেক বাঙালী চমৎকার বাংলা/ ইংরেজি গান গায়। এমন দশজনকে নিয়ে – জলসার এই প্ল্যাটফর্মে আগামী সিজেনটি করলে – সিডনি থমকে যাবে। আর সেই অনুষ্ঠানটি হয়ত প্রবাসে ‘কোক-স্টুডিও- বাংলা – সিডনি’ হিসাবে দাড়িয়ে যাবে। দলাদলি, রেশারেশি, হিংসা-হিংসি তো অনেক হোল। আমি গান গাইতে পারলে – উজ্জ্বল কে গিয়ে বলতাম, ‘তোমাদের মঞ্চে আমাকে একটি গান গাইতে দাও’।
পথ প্রোডাকশন ভাল কাজগুলো করে যাক।

জন মার্টিন
নাট্যজন, নির্দেশক, অভিনেতা
প্রিন্সিপাল সাইকোলজিস্ট
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।