‘জীবন নদী’ মারুফা গাফফার রচিত প্রথম বই। বইটি সম্প্রতি পড়ে শেষ করলাম এবং আজ বসেছি আমার একান্ত পাঠ প্রতিক্রিয়ায় কিছু শেয়ার করবো বলে।
তার আগে একটা ছোট ভূমিকা দিয়ে নিতে চাই। অস্ট্রেলিয়া পরবাস জীবনে এসেছি এক যুগ। এই জীবনে পুরো অভ্যস্ত হতে অনেকের মতো আমারও সময় লেগেছে এবং বলা যায় এখনও প্রতিদিন শিখছি নূতন কিছু। তার অল্প কিছুই হয়তো নূতন করে ধারণ করছি। কিন্তু দীর্ঘ দিনের লালন করা চিন্তা চেতনায় লেগেছে ধাক্কা অনেকবার এবং শেষমেশ অস্ট্রেলিয়ার মতো একটা সভ্য মাল্টিকালচারাল দেশ অনেক কিছুতেই আমাকে শিখিয়েছে অন্যরকম এক ইতিবাচক মানসিকতায় বিশ্বাস করতে, এটা দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করতে চাই।
যে বিষয়টা এই বই আলোচনায় প্রাসঙ্গিক, সেটুকু বলি।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দেখেছি, বয়োজৈষ্ঠ মানেই জীবন হয়ে যায় স্থির এবং গতিহীন। ধর্ম, কর্ম পালন করা আর কারো কারো পরিবারে কখনও কখনও কোন সিদ্ধান্তে মতামত রাখার বাইরে শুধুই অসুখ বিসুখ নিয়ে আলাপ আলোচনাটাই হয়ে যায় মুখ্য।
বিশেষ করে খুব কম মহিলা বয়োজৈষ্ঠ্যই আছেন যারা জীবনের একভাগ কাটিয়ে, একটু নির্ভার হয়ে শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা জাতীয় বিষয়ে কোন আগ্রহ রাখেন। বই পড়া বা টাকা উপার্জনের জন্যে কোন কাজে নিজেকে নিযুক্ত করার মতো বিষয়ে মনোনিবেশ করা তো অনেকটাই ধারনার বাইরে। বা শিক্ষিত হলেও, কেউ কেউ হয়তো পড়েন কিন্তু লেখালিখির সাথে সখ্যতা থাকে এমন দেখা যায় খুবই কম দেশে। হয়তো সময় বদলেছে তারপরও বলার মতোন অবস্থা আজও হয়নি।
এই বইটি লিখেছেন যিনি, মারুফা গাফফার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন এবং স্বামী নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন এই অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী জীবনে। এরপর দুই পুত্র নিয়েই আছেন এখন সাউথ অস্ট্রেলিয়ার এডেলেইড শহরে।
কর্মজীবি, স্বাবলম্বী এবং পরিশ্রমী এক নারী। তিনি একজন বাংলাদেশী অস্ট্রেলিয়ান এবং পরবাস জীবনে আছেন দুই যুগেরও বেশী সময়।আমার দেখা একজন শিল্প সাহিত্য এবং সঙ্গীত প্রেমী মানুষ, আমুদে মানুষ। আমার দেখা বললাম, বলেই নিই ছোট করে উনার সাথে আমার পরিচয়ের যোগসূত্রটুকু।
২০০৯ এ আমি নিজেও আসি মাইগ্রেন্ট হয়ে সাউথ অস্ট্রেলিয়াতে পরিবার নিয়ে। বছর দেড় যেতেই এডেলেইড, সাউথ অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশী দুইজন ভাইয়ের উদ্যোগে প্রথমবারের মত কমিউনিটি রেডিও কার্যক্রমে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। শুরু হয় ‘’রেডিও বাংলা এডেলেইড’’ যাত্রা। শুরুর অল্প কিছু সময় পরই আমার যুক্ত হওয়া এবং লম্বা একটা সময় ধরে নিরলস ভাবে কাজ করার সুযোগ আসে। এই কাজটি করতে যেয়েই অনেক শ্রোতার ভালোবাসার পাশাপাশি রেডিও বাংলা এডেলেড এর একজন শুভাকাংখী হিসেবে পাই একজন ‘’মারুফা গাফফারকে’’। যাকে আমি বলি ভালোবেসে আন্টি।

আমাদের প্রতিটি অনুষ্ঠানের আলোচনা, সমালোচনা, পরামর্শ এবং যেকোন পূর্ব নির্ধারিত বিষয়ে উনার থাকতো স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। আমি সেই শহর ছেড়ে অন্য শহরে চলে এসেছি। কিন্তু ফেসবুক এবং অন্যান্য মাধ্যমে যোগাযোগটা ছিলোই। ২০১৯ থেকেই আন্টি ফেসবুকে উনার ব্যক্তিগত স্মৃতিকথন লিখছিলেন। লিখছিলেন মাঝে মাঝে পেন্সিল অস্ট্রেলিয়া পেজটিতেও। উনি ভালোবাসেন বাগান করতে, ভালোবাসেন প্রকৃতির ছবি উঠাতে। এই সব বিষয়ে উনার ব্যাপক আগ্রহ আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করতো বা করে।
উনার এই বই প্রকাশিত হবার বিষয়টা উনি উল্ল্যেখ করেছেন ওভাবে কোন প্ল্যান ছিলোনা। ফেসবুকে যে লেখাগুলো লিখছিলেন সেগুলো উনার আত্মীয় একসাথে করে এই উদ্যোগ নিয়েছেন এই বছরেরই বই মেলা উপলক্ষ্যে এবং এই প্রথম প্রকাশনা।
বইটিতে মারুফা গাফফার, উনি আসলে তাঁর শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য এবং বিয়ে… এই সময়ের মাঝের একেবারেই টুকরো কিছু গল্প উঠিয়ে এনেছেন উনার স্মৃতি থেকে।
গল্পগুলো পড়তে যেয়ে আমার মনে হয়েছে আমি যেন সেই ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের সময়ের কিছু মানুষ থেকে প্রায় ১৯৭৭ পর্যন্ত পারিবারিক কাঠামো, সমাজ ব্যবস্থা, গ্রামবাংলার আবহ এবং বিশেষ করে মেয়েদের জীবন যেভাবে কাটতো তারই টুকরো চিত্র দেখছি, অনুভব করছি।
না, উনার আত্নজীবনী এটি নয় তবে উনার জন্মের পর তাঁর অকালে হারানো বাবার পর একজন সেই আমলের অল্পবয়েসী স্কুল শিক্ষক মা কী ভীষণ ত্যাগ এবং পরিশ্রম দিয়ে উনাদের তিন বোনকে সুশিক্ষিত করে তুলেছেন তারই কিছু সময় উনি চেষ্টা করেছেন উনার মত করেই সহজ প্রাঞ্জল ভাষায় লিখতে। উনার নানী একবার এক চোরকে কিভাবে তাড়াতাড়ি চলে যেতে সাহায্য করেছেন এই গল্প পড়তে গিয়ে একটু চমকে গেছি কারণ এমনই এক গল্প আমি নিজে শুনেছি আমার দাদাকে নিয়ে। উনি বলেছেন উনার নানী ছিলেন মাটির মানুষ, আমারও মনে হচ্ছিল আহা সেই সময়ের মানুষদেরই বুঝি কেউ কেউ এমন সোনার মানুষ, সহজ মানুষ ছিলেন।
লেখকের ভাষ্যমতে ভীষণ দুষ্টু ছিলেন তিনি, মাকে জ্বালাতেন যখন তখন… সেই দুষ্টু মেয়েই যখন স্মৃতিচারণে লিখছেন, “ এখন বুঝি মা’র তখনকার অবস্থাটা। সব আদর ভালোবাসা, এত সুন্দর মোমের মতো ফর্সা, ভয়ঙ্কর এক গাম্ভির্যের মুখোশের আড়ালে কিভাবে লুকিয়ে রাখতেন নিজেকে?’’ পড়তে যেয়ে আমিও যেন চোখের সামনে দেখছিলাম উনার সেই মহিয়সী মাকে। ’
পাড়ার হিন্দু মুসলিম বসতি, নিজেদের মাঝের পারস্পরিক সম্পর্ক এই সব কিছু ছোট ছোট অনেক বর্ণনা আন্টি এমনভাবে উঠিয়ে এনেছেন যেন চোখের সামনেই ভেসে উঠে অনেক চরিত্র।
নিজের বড় বোনদের সাথে করা অনেক খুনসুটির গল্প পড়তে গিয়ে অনেকবার ফিক করে হেসেছি। কোথায় যেন নিজের মায়ের করা তাঁর শৈশবের গল্পের মিলও খুঁজে পেয়েছি। এইসব গল্পগুলো পড়তে গিয়ে অনেককিছুই আমি আমার নিজের মায়ের সাথেও শেয়ার করছিলাম।
কী ভীষণ রকমের এক সাংস্কৃতিক আবহই না উনি বেড়ে উঠার সময়টাতে পেয়েছেন। পড়তে যেয়ে অনেকবার থমকে ভেবেছি এই সময় এবং সেই সময়ের মাঝে মেয়ে জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো রূপরেখা। আমার অনেকবার মনে হয়েছে উনি আসলেই আশীর্বাদপুষ্ট এমন একটা জীবন পেয়েছেন সেইসব স্মৃতি খুব যতনে উনি আজও লালন করে চলেছেন বলেই আমরা আজ তাঁকে পড়ছি।
আপাদমস্তক একজন শিল্পানুরাগী মানুষ উনি। নিজে ছোটবেলায় গেয়েছেন, স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে সিনেমা দেখেছেন, একবার নাটকেও অভিনয় করেছেন এবং এখন একজন অস্ট্রেলিয়ান হয়ে দুই যুগেরও বেশী সময় পরবাসে কাটিয়েও ধর্মপ্রাণ এবং সেই বাঙ্গালি সংস্কৃতিই ধারণ করছেন মন ও মগজে। রবীন্দ্র প্রেমীও বটে তিনি। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে চিঠি উনার জীবন সংগীর কাছ থেকে পেয়েছিলেন সেটিতেও ছিল এমনই এক প্রকাশ ‘’খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি আমার মনের ভিতরে’’।
আন্টি হারিয়েছেন তাঁর জীবনসঙ্গীকে এই বছর পাঁচ আগেই। জীবনের যে সময়গুলো পার করে এসেছেন গত বছর থেকে তা লিখতে গিয়ে যে আন্টিকে আমরা পেলাম, আসলে আমার ধারণা অন্যরকম এক জীবন যাপন করছেন এই একা সময়ে এসে, যা উদাহরণ হবার মতন। এই লেখাটার শুরুতে ভুমিকায় আসলে আমি বলতে চাইছিলাম, আমাদের জীবন এক বয়ে চলা নদী। কখনও কখনও খরস্রোতা, কখনও একটু গতিহীন বা শ্যাওলা কুচুরীপানা যায় জমে… কিন্তু আমাদের এই জীবন নদীর মত বয়েই চলে। চলাই জীবনের ধর্ম।
একটা বয়েসের পর আমরা সেই নদীকে আর সচল রাখতেই চাইনা বা জানিইনা অনেকে সচল রাখার উপায়। এই বইটি পড়ে আমার সব ছাপিয়ে এটাই বারবার মনে হয়েছে। উনি জানেন জীবনকে কিভাবে সচল রাখতে হয়, উনি বয়ে যাচ্ছেন, ছুটে যাচ্ছেন।
তাই বুঝি বইটির নামও দিয়েছেন ‘’জীবন নদী’’
লেখক মারুফা গাফফার, আমার আন্টি মারুফা গাফফার দুইজনের জন্যেই শুভকামনা ভালোবাসা।
বিঃদ্রঃ ঠিক সমালোচনা না কারণ আন্টি নিজেই বলেছেন এই লেখাগুলো বই বের করার উদ্দ্যেশে লেখা ছিলোনা। তারপর একটা লম্বা সময়ের খন্ড চিত্র উঠে এলেও ঠিক মুক্তিযুদ্ধের সময়টারই কোন গল্প ওভাবে নেই। আশা করি আবার বই প্রকাশের উদ্যোগী হয়ে লিখলে আন্টি সেই সময়ের গল্পও নিয়ে আসবেন।
নাদেরা সুলতানা নদী
সহযোগী সম্পাদক, প্রশান্তিকা
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।