আমাদের দীর্ঘ জীবদ্দশায় কোনদিন ভুলক্রমেও ভাবিনি- মানুষ, সারাদুনিয়ার তামাম মানুষ সত্যিই এতোটা পরিপ্রেক্ষিতের দাসদাসী হয়ে উঠতে পারে।
মনে হয়, মানুষ ও প্রকৃতি নুহ নবী কালের সবথেকে বড় প্লাবনের সামনে এসে পড়ে।
ঝড় জল মৃত্যু ভেদ করে সবার তরে এসো হে নুহের নৌকা- ২০২১!
বিপদজনক নিরাপত্তা
দুই জেন গুরু ম্যাঙ গঙ আর কিয়ঙ হো এক বনের ধার ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাৎ অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে। তাঁরা বৃষ্টিজলের হাত থেকে বাঁচার জন্য দ্রুত বনের কিনারে একটি ঘরে আশ্রয় নেয়। পুরো ঘরটি পাথর বসিয়ে বানানো।
একটু বাদেই কিয়ঙ হো বারবার ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখে। ম্যাঙ গঙ তাতে কিছুটা শঙ্কিত আর উৎসুক বোধ করে, ম্যাঙ গঙকে জিজ্ঞেসই করে বসে- এই ঘর খুব শক্ত সাবুদ- তুমি বারবার উপরের দিকে কী দেখো?
ম্যাঙ গঙ বলে- তুমি ঠিক বলেছো। পাথরের চাঁইগুলো খুব পোক্তভাবে লাগানো, তাই এই ছাউনিও খুব নিরাপদ।
কিন্তু নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা বিপদজনক।
জেন প্যারাবল
ভাষান্তর : বদরুজ্জামান আলমগীর
নৈঃশব্দ্যের নন্দনতত্ত্ব
সব যুগেই সময় নিজে মরমিয়ার একটি নোতুন রূপ পরিগ্রহ করে। এই মরমিয়া মানুষের কল্পনা, চিন্তা ও আশার আকার ভাষাবিন্যাসে দ্বান্দ্বিকভাবে জমাট বাঁধে- যা চেতনাধারার এক নোতুন বিকশিত গড়ন।
সুজেন সনট্যাগ
বাঙলা ভাষান্তর : বদরুজ্জামান আলমগীর
এক চিলতে বিবমিষা
এটা আমার মুখের ছাপ। মাঝেমধ্যেই এই নিষ্ফলা দিনগুলোতে ব্যাপারটা ভেবে দেখি : আমি নিজের মুখমণ্ডল থেকে কিছুই উদ্ধার করতে পারি না। অন্যদের মুখাবয়বের তা-ও কিছু একটা অর্থ আছে, আছে কিছু স্পষ্টতা। আমারটা একদম ফাঁকা, অর্থহীন।
আমি সুদর্শন, না কিম্ভুত- সেটিও বুঝে উঠতে পারি না। মনে হয় কুৎসিত- আমি এমনই শুনে আসছি। কিন্তু এতে আমার কিছুই যায় আসে না।
মনে মনে আমি বরং অবাকই হই- যা হোক একটা কিছু তো ঠাওরেছো আমাকে, অন্তত তুমি একটা মাটির ঢেলাকে, বা ইটের টুকরাকে সুন্দর বা কুৎসিত বলেছো।
জাঁ পল সার্ত্রে
বাঙলা ভাষান্তর : বদরুজ্জামান আলমগীর।
তরলা বেওয়া
তরলা বেওয়া কিছু খোঁজে। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে জানে না- কী খোঁজে আসলে।
তার একটা বকনা বাছুর ছিল। অনেক কূলকিনারা করে বাছুরটা কিনেছিল তরলা বেওয়া। একদিন স্বপ্নে দেখে বকনা বাছুর গর্ভবতী হয়- একটা বাচ্চা বিয়োয় সে, তার বাচ্চাটা কেমন লিকলিকে পায়ে উঠে দাঁড়ায়। সব দেখে তরলা, আর একটু একটু করে ঠোঁটের কোণায় হাসে।
একদিন আকুরপাকুর বকনা বাছুর তরলার পায়ের সামনে বিছিয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে পড়ে, আর ওঠে না- ওখানেই তড়পাতে তড়পাতে মরে।
সেই থেকে বাছুরটিকেই খোঁজে তরলা। এতোদিনে নিজেও কেমন ভয় পায়, মনে হয় মালেকুল মওত তার পিছু নিয়েছে : যে-কোনো দিন তাকেও শুইয়ে দেবে।
অদিশা তরলা পালাতে যায়। এবার দুটি ঘটনা ঘটে:
তার পালানোর পথে প্যাঁককাদায় ডোবা একখণ্ড জমি দেখতে পায়। এই জমিকে চাষিরা বলে জো-এর জমি, বীজধান ফেলবে। কিন্তু কীভাবে যে তরলার কাছে মনে হয়, এটি বুঝি তার বাছুর- কেমন অনাথ, হামাগুড়িতে তার পায়ের সামনে বিছিয়ে আছে।
তরলা মনপ্রাণ খুলে আমূল কাদামাটির উপর হাতপা মেলে বসে পড়ে। কেমন আরামে, নির্ভাবনায়, হারিয়ে যাওয়া বকনা বাছুরটির স্পর্শে চোখ লেগে আসে তার!
এবার স্বপ্নে দেখে তরলা- মালেকুল মওত তাকে মারতে আসে। ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে ওঠে তরলা- কোনদিক দিয়ে, কেমন করে সে ছোটবেলার কাদামাটির ভিতর লুকাতে থাকা উগল মাছ হয়ে যায়- আর প্রাণ নিঙড়ে, মুখ ঠেসে অবিরাম কাদামাটির ভিতর মরণের কামড় থেকে বাঁচার আশায় লুকাতে থাকে।
কাদামাটি আউলে উগল মাছ তরলা বেওয়া সাতপুরুষের শক্তিতে মুখ লুকাতে থাকে- যেন মালেকুল মওত তাকে খুঁজে না পায়।
সারাদুনিয়ার কেন্দ্রে নিজেকে পুঁতে তরলা বেওয়া অতঃপর ওঙ্কার ধ্বনি তোলে!
বদরুজ্জামান আলমগীর
কবি, নাট্যকার, অনুবাদক
প্যানসিলভেনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।