জোছনার কালো রোদে মেঘদূত । বদরুজ্জামান আলমগীরকে উৎসর্গীকৃত কবিতা

  
    

 

[ বদরুজ্জামান আলমগীর জন্মেছেন বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চল কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে। বহু বছর ধরে বাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায়। তিনি আমাদের সময়ের নন্দিত কবি, নাট্যকার ও অনুবাদক । ২১ শে অক্টোবরে বদরুজ্জামান আলমগীরের জন্মদিনে প্রশান্তিকার আয়োজন “ বদরুজ্জামান আলমগীর : জোছনার কালো রোদে মেঘদূত” এ লিখেছেন তাঁর নিত্য শুভার্থী কবি সিদ্দিক বকর, শিলু সুহাসিনী, আনিসুর রহমান অপু, অন্তউড়ি মেঘদূত, লালন নূর ]

নিমপাতার জল সহসা ফল
সিদ্দিক বকর
(উৎসর্গ: কবি বদরুজ্জামান আলমগীর)

গানের কথা ছোট ছোট ব্যথা
দোলে দোলে- মায়ের আঁচলে
চাবি এক গোছা।

গল্প অল্প স্বল্প কথা
ঝাটহীন উঠোন পাতা টাতা যথা
কানা বাউল
দোতারায় টুং টাং আঙুল

নিমপাতার জল সহসা ফল
ছিটানো ফুল
উপচিয়ে দুকূল
প্রাণ বিলিয়ে হেঁটে যায় কবি
মায়ের আঁচলে এক গোছা চাবি ।

কুমরো পোকার ঠোঁটে মাটির দানা
জৈব দৈব নয় সুর টানা টানা
পাতার লেজে সেজে বৃষ্টির ফোঁটা ফুল
বাতাসে দোলে বালিকার কানের দুল
নদী খালে বিলে ফুটে উঠে কবি
মায়ের আঁচলে এক গোছা চাবি।

অল্প স্বল্প কথা ছোট ছোট ব্যথা
বাউল টুং টাং আঙুল
মা দাদির ভুল কানের জয়ফুল
বাঁশের কড়ুল আদি অন্ত মূল
ঘোড়াউত্রা ঢেউ ঘোমটা উড়া বউ
ফুটে তুলে কবি
মায়ের আচলে এক গোছা চাবি।

উপেক্ষানামা-
শিলু সুহাসিনী

তারপর নীল জলে ধুয়ে যায় বারবার
ঋতুবতী উপেক্ষার লাল রঙ।

বাবার শেষ চাহনি ভেসে ওঠে
এক ঝলক কিংবা বারংবার
কৈশোরের বালখিল্য
লেপ্টে থাকে শরীরের আনাচকানাচ।

রঙের ছড়াছড়ি ফের
ব্লুটুথ উপছে ভেসে যায় ঘর, গানে
পুরাতন ঘ্রাণে-

অতঃপর শেষ নাকি শুরু
কখনো শচীন, কখনো সন্ধ্যা
অথবা লারা ফাবিয়ান
কী সিসারিয়া ইভোরা
হঠাৎ বদরুজ্জামান আলমগীর
কখনো জীবনানন্দ দাশ
শুধুই অস্থিরতা।

মার্চের শেষ ক’টা দিন
আসে আর ফিরে চলে যায়,
কেটে যায় উন্মূল অব্যাখ্যায়-

উপেক্ষার লাল রঙ
বারবার হাতছানি দেয়
উপেক্ষাই হোক বেঁচে থাকার নাম
এই যে কুহক, মাধুরি প্রণাম।

একজন বদরুজ্জামান আলমগীর
আনিসুর রহমান অপু

উৎখাত আর গোড়াপত্তনের মাঝ বরাবর
চারুচাঁদ আর এক চন্দ্রাহত কবি
কাগজের ক্যানভাসে লাঙল চালিয়ে আঁকেন বিমূর্ত ছবি-
দৈনন্দিনতার নানা রঙে দেশ-মাটি, যাপন-জীবন ;
মায়া-ঘোর, ঘর-বার , জগতসংসার
‘পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর’
নিরন্তর মাধুকরী অন্বেষণ,
বাস্তব ও পরাবাস্তবতার বিভোর ভুবনে অভিনন্দিত
অভিসার যাঁর ।

প্রণয় পংক্তিতে তাঁর মাথা তোলে রৌদ্রের বুদ্বুদ,
জোছনার ঘ্রাণ,
ধ্যানী বক কিংবা বনপোড়া হরিণের বিপন্নতার আকুতি !

একজন বদরুজ্জামান আলমগীর—
ফন্দিফিকিরহীন সাদাসিধা,
মুসাবিদা করেন কারুকথার
খুঁজে ফেরেন ক্ষরণ-বরণের খোয়াবনগর,
কী ভীষণ মনকাড়া সে আনন্দ আয়োজন !
মাটির কাছের মানুষেরা যেমন যেমন হয়-
পরোপকারী-নিরহংকার, নরমকোমল, সবুজ-সংবেদী,
কথা আর কাজে মিল-অন্ত্যমিল, যতোটা সম্ভব !
তৎসম-তদ্ভব আর দেশিবিদেশী শব্দরা খেলে তাঁর সাথে
দুধে-ভাতে পোষেন ঝড়োহাওয়া-ও পোড়োবাড়ি
কিংবা খেলান তাদের লেজ নেড়ে মসৃন মুন্সিয়ানায় ।
প্রচলিত ছন্দ রীতি মানেন না,
স্বরবৃত্ত-মাত্রাবৃত্ত কিংবা অক্ষরবৃত্তের নিয়মের কাছে
নতজানু হতেও নারাজ ;
তবুও স্বরাজ চালান নাটকে বা কাব্যকাসিদায় ,
অনুবাদে মাথা তোলে অন্তর্গত উদারতা,
ভিনভাষার অনুরণন—
‘ঢেউগুলো যমজ-বোন’ প্রকৃষ্ট উদাহরণ তারই ভিন্নমাত্রায়!

পড়লেই তাঁরে পেয়ে যাবে, ‘হৃদপেয়ারার সুবাস’
‘আবের পাঙ্খা লৈয়া ‘ শনশন দেবদারু মন
কী লিখেছে কিশোরগঞ্জের ছাওয়াল সেই, সবার আপন।

উজাগর রাত্তিরের ধ্যান যাঁর পংক্তিতে ফোটায়
নক্ষত্রের ফুল
নির্মেদ মাস্তুল সটান শিরদাঁড়ায়।
তুমুল নিষ্ঠায়, নির্মোহ বয়ানে ফোটান মার্কসবাদ
অথবা কোরআনের বিনম্র বিশ্বাস-
খুঁড়ে খুঁড়ে পড়ো যদি তাঁরে জেনে যাবে
কার প্রেমে এই কবি ফানা,
কোথায় লুকোনো থাকে সেই ‘দূরত্বের সুফিয়ানা’ –
প্রেমাস্পদের প্রকৃত পরিচয়, ঠিকানা-সাকিন,
সুফিবাদী অববাহিকায় যাঁর সুবিন্যস্ত হরপ্পাহৃদয়
খুলে দেয় মহেঞ্জাদারোর মনোভূমি –
জামী-রুমি, রাবেয়া বসরী তাঁরে পরান মাথায় তাজ
দরদী দীক্ষায় যেন ফানাফিল্লাহ মনসুর হাল্লাজ।

জন্মতিথির অঞ্জলি
অন্তউড়ি মেঘদূত

শুনেছি পূর্নিমা রাতে এসেছো তুমি
ধরনীর কোলে,
সেদিন খুশির হাট বসেছিল
তারার দেশে।

তোমার জন্যে পৃথিবীতে আজ
আলোর ধারা,
তোমার জন্যে বাগানে আজ
ফুলের মেলা,
তোমার জন্যে জোনাক জ্বলে
পুকুর পাড়ে,
তোমার জন্যে কাঁচপোকারা
গান গায় সুরে সুরে।

দক্ষিণের জানালায় বইছে
সুরেলা বাতায়ন,
পাখিদের ঠোটে আজ
উল্লাসের মাতম।
বৃষ্টিবিলাসী ধানের ক্ষেতে
সবুজের ঢেউ দোলে,
চিরদুঃখি কৃষাণির মুখে
হাসির খৈ ফুটে।
রূপালী চাঁদের মেলা বসেছে
তোমার উঠোনে,
নদীর বুকে জোয়ার এসেছে
তোমার আগমনে।

তোমার তরে রক্তজবা
হাজার ফুলের উৎসব,
তোমার তরে কোকিলের গান
দোয়েলের শীষ।

তোমার তরে কৃষ্ণচূড়া
তোমার তরে আকাশ নীল,
তোমার তরে রংধনু রং,
আজ তোমার জন্মদিন।

তোমার তরে শুভেচ্ছা আমার
নীল খামে রবে অমলিন।

ছড়িয়ে দাও তোমার সৌরভ
ছড়িয়ে দাও ভালবাসা,
রাঙিয়ে দাও তোমার পৃথিবী
বেঁচে থাকো নিয়ে আশা।

তোমার আলোয় ঘোচে যাবে
নিরাশার অন্ধকার,
তোমার আলো জ্বালিয়ে দাও
পৃথিবীর এপার-ওপার।

তোমার বুকে স্বপ্ন থাক, রাত্রি-দিন।
শুভ জন্মদিন।

হৃৎজোছনার প্যারাবল
লালন নূর
(বদরুজ্জামান আলমগীর: বাংলা প্যারাবল-এর প্রবর্তক)

জোছনার কালো রোদে মেঘদূত
আচমকা চমকালো বিদ্যুৎ
পথঘাট চোখে রেখে সাইকেল
ছুটে যাক রেলগাড়ি হুইসেল

ফিটফাট ফুল হাসে গাছময়
সুবাসিত বাঁকা ঢেউ পার হয়
মহিশের শিং নেড়ে যায় দিন
রাতভর গাছগুলো সঙ্গিন

খেলতেছে কার হাতে ট্রাম্প কার্ড
ঘুম-ঘুম সবকিছু অ্যাবসার্ড
দাদখানি চাল নাই, নাই আর
মন খুলে হাসে ধুধু হাহাকার

বোরহানি খেয়ে নাচি খিলখিল
ফুলেদের পাপড়িতে কালো তিল
পাল তুলে রাজপথে যায় ট্রেন
কেঁপে ওঠে অজানা সে মেমব্রেন

পিচকারি দিয়ে ফুল ছুঁড়ে দাও
ছাঁদ-মাটি যত পারো ফুঁড়ে যাও
বানচোদ বাগানের হুমকিতে
ঘোরে পাখি ঝমঝম চুমকিতে

মারো টান, টান মারো পুষ্পে
ফুলেদের আগুনে কে পুষবে
হাঁটবো না দৌড়াবো জানা নাই
লাশেদের ছবি তোলো মানা নাই

খুলে যাক ভূগোলের সিলসিলা
সীমানার কাঁটাচোখ হোক ঢিলা
বন্দুকে ফোটে ফুল ছারখার
আয় আয় দুই মুখী ডাক্তার

ডাক্তার বাবু লাশ কেটে কন
মানুষটা মেরেছে কে কখন
গৌতম বুদ্ধের নাম হোক
মানুষের গান, জয়গান হোক

হাত দিয়ে ধরো নিজ নফস
বাকসের বোকা কথা টক শো
আসলে তো সবকিছু ভনভন
পারো যদি খেয়ে আসো লটকন

দমকল বাহিনীকে কল করো
আগুনের ফুল দিয়ে ছল করো
সাগরের বুকে ফুল ভাসে কার
লাশগুলো হেসে হেসে ছারখার

সত্যটা দুই হাতে করো ভাঁজ
ফিরে আসে মনসুর হাল্লাজ
ধর্মের ঢাক মানে গ্যাঁড়াকল
বদরুজ্জামানের প্যারাবল।।

বদরুজ্জামান আলমগীর:
কবি, নাট্যকার, অনুবাদক।
প্রকাশিত বই।। আখ্যান নাট্য : নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে। আবের পাঙখা লৈয়া।
প্যারাবল : হৃদপেয়ারার সুবাস।
কবিতা : পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর। নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো। দূরত্বের সুফিয়ানা।
ভাষান্তরিত কবিতা : ঢেউগুলো যমজ বোন।
ছিন্নগদ্য : সঙ্গে প্রাণের খেলা।

প্রকাশিতব্য :
নিবন্ধ- আশ্চর্য বতুয়া শাক ও কাঁচা দুধের ডিসকোর্স।
ক্ষণগল্প, কবিতা, স্মৃতিগদ্য, ভাষান্তরিত পদ, প্যারাবল কোলাজ- দরজা খুলেই দেখি জেব্রাক্রসিঙ।
কবিতা- মরিয়মফুল দুনিয়া।
খোলা নাটক- যোজনগন্ধা মায়া।
ভাষান্তরিত আমেরিকান কবিতা- পানপাত্রে নক্ষত্র কুচি।
বর্তমান মোকাম- ফিলাডেলফিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

[ এই সংখ্যায় বদরুজ্জামান আলমগীর রচিত নাটক ‘নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে’ এবং ‘ পুণ্যাহ ‘ থেকে ছবিগুলো নেয়া হয়েছে। ]

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments