কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস মহামারিতে বিশ্বজুড়ে প্রায় প্রতিটা দেশের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এই লেখাটি প্রকাশ কালে সর্বশেষ করোনা আক্রান্তের তথ্য:
বিশ্ব: মৃতের সংখ্যা ৩৬,৪০০, মোট আক্রান্ত ৭ লাখ ৫৫ হাজার ৫৫১, সুস্থ ১লাখ ৪০ হাজার।
অস্ট্রেলিয়া: মৃতের সংখ্যা ১৯; মোট আক্রান্ত ৪৩৫৯; প্রয়োজন ছাড়া বাইরে গেলে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ডলার জরিমানা হতে পারে।
বাংলাদেশ: মৃতের সংখ্যা ৫, আক্রান্তের সংখ্যা ৪৯, সুস্থ ১৫ জন। গত ২৪ ঘন্টায় নতুন রোগী ১জন। (সূত্র: আইইডিসিআর এবং জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি)
করোনা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশান্তিকায় লিখছেন চিকিৎসক, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সচেতন নাগরিক এবং নিয়মিত লেখকেরা। করোনা নিয়ে ৬ পর্বের ধারাবাহিক লিখেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কবি এবং সাহিত্যিক ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন।
প্রশান্তিকায় আজ প্রথম দুই পর্ব প্রকাশিত হল।

শুরু হলো করোনা নিয়ে আমার লেখালেখি। সাধারণ মানুষের কথা ভেবে গল্পের মত করে লেখার চেষ্টা করেছি। এটা লিখতে গিয়ে আমি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত বড় কর্মকর্তা, তাদের ওয়েবসাইট আর একজন জনস্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষক হিসেবে আমার দীর্ঘ চব্বিশ বছরের অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করেছি।খুব ভারী কোন কথা বা তথ্য নেই, তবে লেখাগুলো দেশের নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে আমজনতার জন্য কাজে লাগবে বলে আমার ধারণা।
এক: জ্বর হলেই করোনা নয়
নভেল করোনা-১৯ ভাইরাস নিয়ে কেন এত ভীতি!
দুদিন আগে রূপা বাংলাদেশ থেকে ফোন করেছিল। সকাল থেকে ওর জ্বর, কাশি এবং গলাব্যথা। সে খুব ভয় পেয়েছে, পাছে নভেল করোনা-১৯ ভাইরাসে পেয়েছে বুঝি।সে ভয়ে অস্থির, তার কোভিড-১৯ হয়নি তো? খুবই ভয় পাওয়া গলায় আমারে জানালো। শুধু জ্বর নয় তার খুব অস্বস্তিও হচ্ছে।আমি জিজ্ঞেস করলাম, কবে তার জ্বর হয়েছিল অথচ অস্বস্তি লাগেনি? আমি দেশের বাইরে তার সাম্প্রতিক ভ্রমণের ইতিহাস জানতে চাইলাম, জানামতে কোন কোভিড-১৯ রোগীর সংস্পর্শে কিংবা অন্য কোন জ্বরেররোগীর সংস্পর্শে এসেছে কি না জানতে চাইলাম।সবগুলোর উত্তরই না হওয়ায় পরামর্শ দিলাম, আপাতত অফিস ও অন্যান্য কাজে বাইরে যাওয়া বাদ দিয়ে বাসায় থাকো।আর শ্বাসকষ্টসহ শারীরিক কোন সমস্যা হলে ডাক্তারের কাছে যেও। আজ সকালেরূপা ফোন করে জানিয়েছে, ওর জ্বর কমে গেছে।
সম্প্রতি আবিষ্কৃত নভেল করোনা-১৯ ভাইরাস নিয়ে সারা পৃথিবী তোলপাড়।গতকাল বুধবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক কোভিড-১৯ এর বর্তমান অবস্থাকে ‘প্যানডেমিক’ ঘোষণা করেছেন। কোন রোগ মহামারী আকারে যখন একাধিক দেশে হয়, বিশেষ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একাধিক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তাকে ‘প্যানডেমিক’ বলে।
কেন করোনা নিয়ে এই ভীতি?
নভেল করোনা-১৯ ভাইরাস নিয়ে সারা পৃথিবীতে জনমনে ব্যাপক ভীতি দেখা দিয়েছে।এই ভীতির কারণ কী? এর আগে একইরকমের সার্স, মার্স রোগ দেখা দিলেও তা করোনার মত এত ব্যাপ্তি পায়নি।চীন থেকে এই অসুখে যেভাবে আমরা মৃত্যুর খবর পাত্ছিলাম, তাতে শুরুতেই আতঙ্কিত বোধ করেছি। তারপর এই অসুখ ছড়িয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।তাছাড়া, এবারের ভীতির কারণ সমূহের মধ্যে অন্যতম হল, এই ভাইরাসটি আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে সংস্পর্শে আসা মানুষের শরীরে খুব দ্রুত ছড়ায়।চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা যাকে বলি ‘ব্যাসিক রিপ্রোডাকশন রেশিও (বিআরআর), যাএই ভাইরাসের ক্ষেত্রে অনেকবেশী।
দ্বিতীয়ত, কারো শরীরে নভেল করোনা ভাইরাস১৯ প্রবেশ করলে কী হয়? এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশের পর ওই ব্যক্তি কতটা আক্রান্ত হবেন, তা প্রধানত নির্ভর করে তার দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর।একজন সুস্থ সবল মানুষের দেহে এই ভাইরাস প্রবেশ করলে দেখা যায় তার শরীরে সামান্য জ্বর বা কাশি হতে পারে, যা অনেকটা ঠাণ্ডা জ্বরের মত।

সমস্যা প্রকট হয় যখন আক্রান্ত ব্যক্তির দেহের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়। যেমন কারো যদি অ্যাজমা বা হাঁপানি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ থাকে, বা ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী যাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের ক্ষেত্রে এই ভাইরাস নিউমোনিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের নানান জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। অনেক বয়স্ক মানুষদের সাধারণত এসব অসুখের কারণে দেহেররোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে।ফলে নভেল করোনা ভাইরাস এদের শরীরে ঢুকে বিভিন্ন জটিলতা তৈরী করতে পারে, এতে অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।যেসব দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেশী, সেসব দেশে তাই কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্তের মৃত্যুহার বেশী হবে।
তবে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, নভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত শতকরা আশিভাগ লোকই কোন চিকিৎসা ছাড়াই বা সামান্য চিকিৎসায়ই ভালো হয়ে যায়।বাকি ১৫-১৮ শতাংশ লোক হাসপাতালে বা চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে। আক্রান্তদের প্রায় চার-পাঁচ শতাংশ রোগির অবস্থা বেশ জটিল হয়, যাদের অনেকের চিকিৎসার জন্য আইসিইউর প্রয়োজন হতে পারে।কেবলমাত্র দুই শতাংশের মত মানুষে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে।
তবে নভেল করোনা ভাইরাসের ব্যাপারে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্যে জানা যাচ্ছে যে, এই ভাইরাস বারবার তার জীন বদলাচ্ছে এবং এর ফলে ক্রমাগত ভাইরাসটি আরো ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।বারবার পরিবর্তনের ফলে নভেল করোনা প্রতিরোধে কার্যকর কোন ভ্যাক্সিন তৈরী করাও কঠিন হয়ে পড়ছে।
দুই: নভেল করোনা ভাইরাস এবং কোভিড-১৯ নিয়ে সাধারণ মানুষের কতটুকু জানা দরকার?
নভেল করোনা ভাইরাস, বৃহত্তর করোনা ভাইরাস পরিবারের নতূনতম সদস্য বিধায় পরিপূর্ণ তথ্য এখনো বিজ্ঞানীরা জানতে পারেননি, তবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গবেষণা চলছে। কিছু কিছু প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা ইতিমধ্যে পেয়েছি।পাশাপাশি, অবাধ তথ্য প্রবাহের এই যুগে এই ভাইরাস নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তিকর তথ্যও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমএবং আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।যার ফলে মানুষের মধ্যে এক ধরণের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে।যে কোন রোগের মহামারী নিয়ন্ত্রণে এধরণের বিভ্রান্তিকর তথ্য ক্ষতিকর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।আজকের এই লেখায় তাই শুরুতেই কিছু ভুল তথ্যের ব্যাপার তুলে ধরছি।
নভেল করোনা ভাইরাস সব দেশে, সব অঞ্চলেই ছড়াতে পারে। গরম ও আর্দ্র জলবায়ুর (Hot and humid climate) এলাকায় ছড়াবেনা এমন কোন কথা নাই। শীত ও তুষারপাতের দেশেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। শীতের ঠাণ্ডা এই ভাইরাসকে মারতে পারে না।বাইরের আবহাওয়া যাই থাকুক না কেন, সুস্থ মানুষের শরীরের তাপমাত্রা সাধারণত ৩৬.৫ থেকে ৩৭ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যেই থাকে।
গরম পানিতে গোসল করলে নভেল করোনা ভাইরাসের আক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে কারো কারো মনে যে ধারণা জন্মেছে তা সঠিক নয়।এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, মশার কামড়েও এই ভাইরাস ছড়ায় না। নভেল করোনা ভাইরাস ধর্ম-বর্ণ-গোত্র চেনে না, যে কোন মানুষকেই আক্রমন করতে পারে।
এই কারণে, নভেল করোনা ভাইরাস কিভাবে ছড়ায় তা জানা জরুরী।ধারণা করা হয়, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহান শহরের কোন একটা সামুদ্রিক মাছ ও প্রাণীর বাজার থেকে ভাইরাসটি প্রাণীর দেহ থেকে কতিপয় মানুষের দেহে প্রবেশ করেছিল।তারপর থেকে এক মানুষের কাছ থেকে অন্য মানুষের কাছে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে।
যেভাবে ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে:
– সাধারণত এই ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংস্পর্শে এলে
– ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের হাঁচি-কাশিতে ছড়ানো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দানার (ড্রপলেটস) সংস্পর্শে এলে
– ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি নি:সৃত ড্রপলেট কোন বস্তু বা পৃষ্ঠতলে (surface) লেগে থাকলে অন্য কোন ব্যক্তি যদি তাস্পর্শ করেন এবং পরবর্তীতে ভাইরাসযুক্ত সেই হাত দিয়ে যদি নিজের নাক-চোখ-মুখ স্পর্শ করেন তবে সেক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির শরীরেভাইরাসটি প্রবেশ করতে পারে। সাধারণত কোন পৃষ্ঠতলে এই ভাইরাসটি এই ভাইরাসটি কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্তবাঁচতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নভেল করোনা ভাইরাস দ্বারা রোগের নামকরণ করা হয়েছে কোভিড-১৯।কারো শরীরে এই ভাইরাস প্রবেশ করলে কোভিড-১৯ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে ২ থেকে ১৪ দিন সময় লাগতে পারে।
কোভিড-১৯ রোগের লক্ষণসমূহ:
এই রোগের সাধারণ লক্ষণসমূহ হলো জ্বর, ক্লান্তি এবং শুকনো কাশি। এছাড়াও কিছু রোগীর ক্ষেত্রে গায়ে ব্যথা, সর্দি, নাক বন্ধথাকা, গলা ব্যথা বা পাতলা পায়খানা থাকতে পারে। লক্ষণসমূহ সাধারণত মৃদু আকারে শুরু হয় এবং আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। আক্রান্ত রোগীদের শতকরা আশি ভাগই তেমন কোন চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হয়ে ওঠেন। তারা লক্ষণভিত্তিক ওষুধ যেমন জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল, সর্দি-কাশির জন্য এন্টি হিস্টামিন জাতীয় ওষুধ খেতে পারেন। আক্রান্ত প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজনের অবস্থা জটিল হতে পারে এবং দেহে শ্বাসজনিত জটিলতা হতে পারে।বয়স্ক মানুষ কিংবা যাদের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার জাতীয় অসুখ আছে, তাদের ক্ষেত্রে এই রোগ জটিল হতে পারে। শরীরে নভেল করোনা ভাইরাস ঢুকলেই যে একজন কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হবেন, তা সত্যি নয়।
আমাদের মনে রাখা জরুরী, শরীরে এই ভাইরাস প্রবেশ করলেও সবারই শরীরে কোভিড-১৯ রোগের লক্ষণ দেখা যাবে না এবং অনেকেই সুস্থ থাকবেন।
আগামী পর্ব: নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমন থেকে কীভাবে রক্ষা পেতে পারেন?
ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কবি এবং সাহিত্যিক।
অধ্যাপক: পাবলিক হেল্থ, নরদার্ন ইউনিভার্সিটি; চেয়ারম্যান: ফাইন্ডেশন ফর ডক্টর্স সেফটি এন্ড রাইটস্, বাংলাদেশ।