জ্বর হলেই করোনা নয় (তৃতীয় পর্ব) -আবুল হাসনাৎ মিল্টন

  
    

এই লেখাটি প্রকাশ কালে সর্বশেষ করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য:
বিশ্ব: মৃতের সংখ্যা ৪৭,২০০; মোট আক্রান্ত ৯ লাখ ৪৬ হাজার, সুস্থ ১লাখ ৯৪ হাজার।
অস্ট্রেলিয়া: মৃতের সংখ্যা ২৪, মোট আক্রান্ত ৫১৩৩।
আমেরিকা: মৃতের সংখ্যা ৩১৬৫, আক্রান্ত ১ লাখ ৬৫ হাজার। বাংলাদেশীর মৃত্যু ৫৩।

বাংলাদেশ: মৃতের সংখ্যা ৬, আক্রান্তের সংখ্যা ৫৬, গত ২৪ ঘন্টায় নতুন রোগী ৪ জন। (সূত্র: আইইডিসিআর এবং জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি)

করোনা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশান্তিকায় লিখছেন চিকিৎসক, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সচেতন নাগরিক এবং নিয়মিত লেখকেরা। করোনা নিয়ে ৬ পর্বের ধারাবাহিক লিখেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কবি এবং সাহিত্যিক ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন।
আজ প্রকাশিত হলো তৃতীয় পর্ব।

ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন

পূর্বে প্রকাশের পর:

নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে কীভাবেরক্ষা পেতে পারেন?

হাত ধোয়া
প্রতিদিন কয়েকবার করে কব্জি পর্যন্ত দুই হাতে সাবান মেখে পানি দিয়ে কিংবা অ্যালকোহল বেজড্ হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে দুই হাত সঠিকভাবে (আঙ্গুলের ভেতরে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ভালো করে কচলিয়ে এবং দু হাতের সবটুকু জায়গা) ধুতে হবে। এরফলে যদি হাতের তালুতে ভাইরাস লেগে থাকে, তবে তা মরে যাবে।হ্যান্ড স্যানিটাইজারে অ্যালকোহলের পরিমান কমপক্ষে ৬০% হতে হবে। নন-অ্যালকোহল বেজড হ্যান্ড স্যানিটাইজারে এই ভাইরাস মরবে না। যদি কোন কারণে ধারে-কাছে সাবান বা হ্যান্ডস্যানিটাইজার না থাকে, তাহলে অন্তত পানি দিয়ে আঙ্গুল কচলিয়ে ভাল করে কব্জি পর্যন্ত হাত ধোবেন। কলুষিত কোন কিছু স্পর্শ করার পরেও ভালো করে হাত ধুতে হবে।বাইরে থেকে ঘরে ফিরে অবশ্যই হাত ধোবেন।

হাঁচি
কাশিতে আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন।এর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর নি:সৃত ভাইরাসসবাহী ড্রপলেটগুলো সহজে আপনার নাকে-মুখে প্রবেশ করতে পারবে না।

স্পর্শ
হাত দিয়ে বারবার নিজের চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করবেন না।কারণ নভেল করোনা ভাইরাস দূষিত (কন্টামিনেটেড) বিভিন্ন পৃষ্ঠতল (সারফেস) স্পর্শ করার ফলে আপনার হাতের তালুতে নভেল করোনা ভাইরাস লেগে থাকতে পারে, যা পরে চোখ, নাক বা মুখ দিয়ে আপনার শরীরে প্রবেশ করতে পারে।

কনুইয়ের ব্যবহার
প্রতিবার হাঁচি বা কাশি দেবার সময় হাতের কনুইয়ে বা টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ ঢাকুন।ব্যবহারের পরে টিস্যু পেপারটি ডাস্টবিনেফেলে দিন। হাঁচি-কাশি দেবার সময় হাতের তালু দিয়ে মুখ ঢাকবেন না।সেক্ষেত্রে অন্যের সাথে হাত মেলানোর সময় কিংবাভাইরাস কলুষিত হাত দিয়ে পরবর্তীতে কিছু স্পর্শ করলে, আপনার হাতের তালু থেকে সেখানে ভাইরাসটি ছড়াতে পারে।

পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা
নিয়মিত ঘরের দরজা, সিড়ির রেলিং, মোবাইলফোনের স্ক্রিন এবং যেসব স্থান ঘনঘন স্পর্শ করা হয়, সেগুলো জীবানুনাশক ব্যবহার করে নিয়মিত পরিস্কার রাখুন।

খাদ্য
বেশী করে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার যেমন কাঁচা মরিচ, লেবু, পেপে, কমলা, সরিষা শাক, ইত্যাদি খান।এর কারণ হলো, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে।

তথ্য
নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত সঠিক তথ্যের জন্য নিয়মিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট ভিজিট করুন।ফেসবুকে যা দেখবেন, তাই বিশ্বাস করবেন না, অন্যের ইনবক্সে ফরোয়ার্ড করবার আগে কয়েকবার ভাববেন।

আপনার জ্বর, কাশি বা ঠাণ্ডা লাগলে কী করবেন?

জ্বর-কাশি বা ঠাণ্ডাজনিত অসুস্থতায় সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ঘরে অবস্থান করুন। যদি আপনার জ্বর, কাশি এবং শ্বাসকষ্ট থাকে, তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সম্ভব হলে আগে ফোনে ডাক্তারের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিন।বাংলাদেশে আইইডিসিআরের অনেকগুলো হটলাইন নম্বর দেওয়া আছে। নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত যে কোন তথ্য ওপরামর্শের জন্য এসব ফোন নম্বরেও কথা বলা যেতে পারে। জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ের স্বাস্ব্য কর্তৃপক্ষের পরামর্শগুলো মেনেচলুন।

আক্রান্ত লোকের সংস্পর্শে এলে বা আক্রান্ত এলাকা থেকে আসার পরে কী করবেন?

প্রথমত, উপরে বর্ণিত করণীয়গুলো নিয়মিতভাবে পালন করুন।

এবার একটা সত্যি ঘটনা বলি।কদিন আগে বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ফারহার (ছদ্মনাম) সাথে তার এক তরুণী ভক্ত দেখা করতেএসেছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ তারা একসাথে ছিলেন। দেখার শুরুতে হ্যান্ডশেক এবং যাবার সময় ভক্তের সাথে আলিঙ্গনও করেছেন। দুদিন পরে ফোন করে ফারহাকে ভক্তটি জানালেন, তার নভেল করোনা ভাইরাস পজিটিভ হয়েছে এবং কোভিড১৯রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। ফোন পাবার পর নিজের মেয়ে দুটিকে আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে পরবর্তী চৌদ্দদিন তিনি নিজ গৃহেস্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকলেন। এসময়ে তিনি বাইরে বের হননি, বাসায়ও কাউকে আসতে দেননি। অফিসসহ প্রয়োজনীয় সব কাজফোনে আর ইমেইলে সেরেছেন। চৌদ্দদিন পরেও তিনি অসুস্থ বোধ করেননি, তার রক্ত পরীক্ষায়ও নভেল করোনা ভাইরাস পাওয়া যায়নি।

আরেকটি ঘটনার কথা বলি।জনৈক ব্যবসায়ী এক বিদেশীর সাথে মিটিং করার পর কদিন পর থেকেই জ্বর ও প্রচণ্ড গলা ব্যথাশুরু হলো। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, বিদেশীর শরীরেও নভেল করোনা ভাইরাস পাওয়া গেছে এবং তিনিও কোভিড১৯ এআক্রান্ত হয়েছেন।ফোনে ডাক্তারের পরামর্শমত ব্যবসায়ী লোকটি প্যারাসিটামল আর এন্টিহিস্টামিন ট্যাবলেট খেলেন।চৌদ্দদিন ঘরে নিজের রুমে স্বেচ্ছা নির্বাসনে কাটালেন। অসুস্থতার এই সময়ে অনেকগুলো সিনেমা দেখলেন, বই পড়লেন।চৌদ্দদিনের মধ্যে তিনি পুরোপুরি সুস্থও হয়ে উঠেছেন।

নভেল করোনা ভাইরাসটি নতুন, তাই এ সংক্রান্ত অনেক প্রশ্নের উত্তরই আমাদের এখন পর্যন্ত জানা নাই। আপাতত প্রাপ্ততথ্যের ভিত্তিতে আক্রান্ত বা সন্দেহজনক ১৪ দিনের এই স্বেচ্ছা নির্বাসনকেই গ্রহণযোগ্য পরামর্শ বলেই আমরা মেনে নিচ্ছি। এরকারণ হলো, কারো শরীরে এই ভাইরাসটি প্রবেশ করলে দুই থেকে ১৪ দিনের মধ্যেই কোভিড১৯ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতেপারে।

*পরবর্তী পর্বটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই পর্বে সরকার ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে করণীয় বিষয়ে লিখব। 

ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন
: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কবি এবং সাহিত্যিক।
অধ্যাপক: পাবলিক হেল্থ, নরদার্ন ইউনিভার্সিটি; চেয়ারম্যান: ফাইন্ডেশন ফর ডক্টর্স সেফটি এন্ড রাইটস্, বাংলাদেশ।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments