এই লেখাটি প্রকাশ কালে সর্বশেষ করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য:
বিশ্ব: মৃতের সংখ্যা ৫৮,৫০০; মোট আক্রান্ত ১০ লাখ ৯৯ হাজার, সুস্থ ২ লাখ ২৬ হাজার। সবচেয়ে অধিক মৃত্যু ইতালীতে ১৪,৭০০।
অস্ট্রেলিয়া: মৃতের সংখ্যা ৩০, মোট আক্রান্ত ৫৫২৯। নিউ সাউথ ওয়েলস আক্রান্ত ২৪৯৩, ভিক্টোরিয়া ১১১৫, কুইন্সল্যান্ড ৯০০, ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া ৪২২, সাউথ অস্ট্রেলিয়া ৩৯৬।
বাংলাদেশ: মৃতের সংখ্যা ৬, আক্রান্তের সংখ্যা ৬১, গত ২৪ ঘন্টায় নতুন রোগী ৬ জন। (সূত্র: আইইডিসিআর এবং জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি)
করোনা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশান্তিকায় লিখছেন চিকিৎসক, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সচেতন নাগরিক এবং নিয়মিত লেখকেরা। করোনা নিয়ে ৬ পর্বের ধারাবাহিক লিখেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কবি এবং সাহিত্যিক ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন।
আজ প্রকাশিত হলো চতুর্থ পর্ব।

পূর্বে প্রকাশের পর:
নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় কার কী করণীয়?
এই পর্বের লেখাটি লিখতে গিয়ে বারবার বাংলাদেশের পরিসংখ্যানটি মনে পড়ছে।সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে মাত্র ৬১ মানুষের শরীরে নভেল করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি সনাক্ত করা গেছে।পরিসংখ্যানটি আশাব্যঞ্জকহলেও এটি আসলেই বাস্তবতার কতটুকু প্রতিফলন, সেটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।যে দেশে মানুষের শরীরে নভেলকরোনা ভাইরাসের উপস্থিতি সনাক্ত করার সুযোগ খুবই সীমিত, সেখানে ঠিক কতজনের শরীরে এই মুহূর্তে ভাইরাসটি আছে তা নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব।পরিসংখ্যানের হিসেবে না গিয়েও তাই বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, বাংলাদেশও নভেল করোনা ভাইরাস জনিত রোগ কোভিড-১৯ এর মহামারীর ঝুঁকির মধ্যে আছে। এই সম্ভাব্য ঝুঁকির চিন্তা মাথায় রেখেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমাদেরকার কী করণীয় তা নির্ধারণ করতে হবে।
নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব কার জিজ্ঞেস করলেইসবাই আঙ্গুল উচিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দেখিয়েদেবে।কিন্তু আসলেই কি তাই? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেযাবার আগে আমরা নভেল করোনা ভাইরা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের কিছু মৌলিক বিষয় জেনে নেই।নভেল করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রমকে আমরা প্রধানত দুইভাগেভাগ করে নিতে পারি। তা হলো ভাইরাস সংক্রান্ত করণীয় এবং এটির নিয়ন্ত্রণে মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম।
প্রথমত, মানুষকে নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত সঠিক তথ্য জানাতে হবে।অবাধ তথ্য প্রবাহের এই যুগে যেখানে অসংখ্যভুল তথ্য সোশাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেখানে কাজটা খুবই চ্যালেঞ্জিং। এই তথ্য জানানোর কাজটি সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগেই হতে হবে।এখানে মূলধারার মিডিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।মানুষকে জানাতে হবে, কিভাবে এই ভাইরাসটি ছড়াতে পারে, একজনের কাছ থেকে কিভাবে আরেকজনের কাছে যেতে পারে? সেই সাথে কিভাবে এই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিহত করা যেতে পারে সেটাও সবাইকে জানাতে হবে, যাতে স্ব স্ব অবস্থান থেকে মানুষ তার করণীয় সম্পর্কে জানতে পারে। এমনিতে আমাদের দেশের গণমানুষের পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতা অনুশীলনের বিষয়টা খুব উন্নতমানের নয়। রাস্তাঘাটে থুথুফেলা, নাক ঝাড়া, জনসন্মুখে নাক খোঁটা, পর্যাপ্ত সংখ্যক বার হাত না ধোওয়ার মত ব্যাপারগুলো অনেকটা আমাদের জাতীয়অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অথচ নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে এই ক্ষতিকর অভ্যাসগুলো বদলাতে হবে। আর গণমানুষের অভ্যাসে কাঙ্খিত পরিবর্তন আনতে হলে দেশব্যাপী ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।

মাঠ পর্যায়ের অপারেশনাল কার্যক্রম নির্ধারণে আমাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হবে, মানুষ থেকে মানুষে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি কমানো। এ লক্ষ্যে মানুষের সচেতনতা বাড়ানো, নিয়মিত হাত ধোয়াসহ ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস নিশ্চিত করার পাশাপাশি আমাদের ‘সামাজিক দূরত্ব’ (সোশাল ডিসট্যান্সিং) নিশ্চিত করতে হবে। শুরুর দুমাসের মধ্যেইচীন কোভিড-১৯ মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও ইটালীর মত উন্নত দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি দেখে আমাদের নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকবার সুযোগ নেই।এখনই বাংলাদেশে সকল ধরণের গণজমায়েত আপাতত বন্ধ রাখতে হবে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই তাদের সমাবেশ আপাতত বন্ধ রেখেছে, যাশুভ লক্ষণ।গত ১৭ মার্চের মুজিব জন্মশতবার্ষিকীর মত গুরুত্বপূর্ণ এবং আবেগঘন অনুষ্ঠানের জনসমাবেশ আপাতত স্থগিত করে স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি দৃষ্টান্তমূলক কাজ করেছেন।পাশাপাশি বিয়ে, জন্মদিন, আলোচনা সভার মত সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতেও জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, প্রয়োজনে সরকারী ভাবে ঘোষণা দিয়ে সাময়িকভাবে এসবঅনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকলশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা ছিলো খুবই দরকারী। সরকার এসব বন্ধ করে কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছে।
ঘনঘন বাজারে যাবারও দরকার নাই।আগামী আরও তিন-চার সপ্তাহের জন্য সারা দেশব্যাপী আমাদের চলাচলসহ বিভিন্ন কার্যক্রম সীমিত করতে হবে যাতে অনেক মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা যায়।অন্যথায়, করোনা পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।একটি বৃহত্তর সম্ভাব্য বিপর্যয় চার সপ্তাহ থেমে থাকা এমন কঠিন কোন কাজ নয়।বিশেষ করে সেই জাতির জন্য, যারা ন্যূনতম প্রস্তুতি ও সামর্থ্য নিয়ে একাত্তরের মতএকটি অসম যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল।করোনার বিরূদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য আমাদের প্রধান প্রয়োজন একটি সঠিক নেতৃত্ব ওকতিপয় সময়োপযোগী নির্দেশনা। কথা প্রসঙ্গে সেদিন জেনেভায় কর্মরত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় কর্মরত একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাআমাকে ফোনে বলেছিলেন, ‘তোমাদের প্রধানমন্ত্রীই সেই মানুষ, যার উপরে অনায়াসে আস্থা রাখা যায়’।ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আমিও জানি, ‘শেখ হাসিনা পারে, শেখ হাসিনাই পারছেন’।
কেবল ঢাকা শহরে নয়, সারাদেশব্যাপী আমাদের হাসপাতালগুলোকে কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে।সেখানে ভাইরাসের উপস্থিতি সনাক্তকরণের সুবিধা, প্রয়োজনে রোগীকে অন্যদের থেকে আলাদা (আইসোলেশন) করার ব্যবস্থাথাকতে হবে।রোগীর ফুসফুস আক্রান্তসহ অন্যান্য জটিলতা দেখা দিলে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এই চিকিৎসার বিষয়ে এবং প্রদানকালে ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা বিষয়ে পরবর্তী পর্বে বিস্তারিত লিখবো।
প্রিয় পাঠক, এতক্ষণে নিশ্চয়ই অনুধাবন করতেপারছেন, কেবল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবেলায় স্বাস্থ্যসহ সরকারের প্রায় প্রতিটা মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা রাখতে হবে, বিশেষ করে শিক্ষা, তথ্য, পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, আইনমন্ত্রণালয়, বানিজ্য মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে।বিমানবন্দরসহ আমাদের সকল সীমান্তএলাকায় সম্ভাব্য রোগী সনাক্তকরণের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইতিমধ্যে মহামারী রোগ নিয়ন্ত্রণে আইনেরসংশ্লিষ্ট ধারা প্রয়োগসংক্রান্ত নোটিশ জারি করেছেন।এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা অযাচিতভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে জন জীবনকে যেন বিপন্ন করে তুলতে না পারে, সেদিকে আইনশৃংখলা বাহিনীকে নজরদারি করতে হবে। জাতির এই সম্ভাব্যদু:সময়ে সেনাবাহিনীকে মাঠে রয়েছে, এটি আশার কথা। এই দু:সময়ে দেশব্যাপী হতদরিদ্র মানুষদের উপার্জন ক্ষতিগ্রস্ত হতেপারে, সে ক্ষেত্রে তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা জরুরী।
সরকারের একার পক্ষেও এই সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবেলা এড়ানো দু:সাধ্য, এ ক্ষেত্রে বেসরকারী খাতসহ পুরো দেশকেই এগিয়ে আসতে হবে, কেতাবি ভাষায় যাকে বলে ‘হোল কম্যুনিটি অ্যাপ্রোচ’। নাগরিক হিসেবেও সমষ্টিগত এবং আত্মরক্ষার স্বার্থে আমাদের সবাইকে নাগরিক দায়িত্বসমূহ পালন করতে হবে, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অনুশীলন যার মধ্যে অন্যতম।কারো শরীরেনভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমনের ঝুঁকি থাকলে প্রয়োজনে কিছু মানুষের চৌদ্দদিন নিজ দায়িত্বে স্বগৃহে স্বেচ্ছা নির্বাসনেথাকতে হবে। দেশব্যাপী গণসচেতনতা বাড়াতে একটি সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন, এনজিওগুলো যেখানে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রকৃত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে জনস্বার্থে প্রয়োজনীয় আরো অনেক পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
এমনিতেই বাংলাদেশ ঘনবসতির দেশ, তার উপরে আমাদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের সক্ষমতা এখনো বেশ পিছিয়ে।পর্যাপ্তআইসিইউ সেবা প্রদানের সুযোগ আমাদের নাই। টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প কিংবা দেশের বিভিন্ন বস্তির কথা ভাবলে আমি খুবআতঙ্কিত বোধ করি। ঢাকা শহরেও মানুষের বিশাল ভীড়।এই পরিস্থিতিতে অসুখ হবার পরে চিকিৎসার চেয়ে অসুখ হবারআগেই প্রতিরোধ করাটা আমাদের জন্য উত্তম।আমাদের জন্য অধিক প্রযোজ্য হলো ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর’।
পরবর্তী সংখ্যায় শেষ (৫ম এবং ৬ষ্ঠ পর্ব)।
ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কবি এবং সাহিত্যিক। অধ্যাপক: পাবলিক হেল্থ, নরদার্ন ইউনিভার্সিটি; চেয়ারম্যান: ফাইন্ডেশন ফর ডক্টর্স সেফটি এন্ড রাইটস্, বাংলাদেশ।