সর্বশেষ করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য:
বিশ্ব: মৃতের সংখ্যা ৬৫,১০০; মোট আক্রান্ত ১২ লাখ ৪ হাজার, সুস্থ ২ লাখ ৪৮ হাজার।
অস্ট্রেলিয়া: মৃতের সংখ্যা ৩৫, মোট আক্রান্ত ৫৬৮৭। নিউ সাউথ ওয়েলসে আক্রান্ত ২৫৮০। প্রমোদ তরী রুবী প্রিন্সেস থেকে আক্রান্ত ৩৪২, যার মধ্যে মৃত্যু বরণ করেছেন ১২ জন।
বাংলাদেশ: মৃতের সংখ্যা ১৩, আক্রান্তের সংখ্যা ১১৭সুস্থ: ২৬। আজ ভোরে একজন সহ গত ২৪ ঘন্টায় মৃতের সংখ্যা ৪। (সূত্র: আইইডিসিআর এবং জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি)
করোনা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশান্তিকায় লিখছেন চিকিৎসক, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সচেতন নাগরিক এবং নিয়মিত লেখকেরা। করোনা নিয়ে ৬ পর্বের ধারাবাহিক লিখেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কবি এবং সাহিত্যিক ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন।
আজ প্রকাশিত হলো ৫ম এবং শেষ পর্ব।

পূর্বে প্রকাশের পর:
৫:করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় ডাক্তারসহ সকলস্বাস্থ্যকর্মীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে
আমি পেশায় একজন এপিডেমিওলজিস্ট। প্রায় তিন দশক পরেও বাংলাদেশে এই বিষয়টা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের তেমন কোন ধারণা নাই। ডাক্তার মানেই অধিকাংশ মানুষের কাছেই বড় বড় ডিগ্রী করা আর রোগী দেখা। এর বাইরেও যে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক বিস্তৃত, সেটা নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে শুরু করে জনগণের অনেকেরই অজানা। এই যে পৃথিবী জুড়ে কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক মহামারী চলছে, এটি নিয়ন্ত্রণে অন্যতম মূখ্য ভূমিকা রাখছে এই এপিডেমিওলজিস্টরাই। যদিও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এপিডেমিওলজিস্টদের তেমন কোন ভূমিকা কার্যকরভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। আইইডিসিআর নামের সরকারী যে এপিডেমিওলজির প্রতিষ্ঠানটি আছে, তাকে ব্যর্থ বলা হলেও কম বলা হবে। নিজেদের কর্মকাণ্ডে ইতিমধ্যে এটিকে একটি অথর্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে।
কয়েকদিন আগে উপজেলা হাসপাতালে কর্মরতএকজন ডাক্তার খুব ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ফেসবুকের ইনবক্সে আমাকে জানালেন, নভেল করোনা ভাইরাস নিয়ে তারা খুব উদ্বিগ্ন।প্রতিদিন বহির্বিভাগে অনেক জ্বরের রোগী দেখতে হয়, এর মধ্য কারো শরীরে করোনা ভাইরাস আছে কি না তা নিশ্চিত নয়।নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য মাস্ক, গ্লাভস বা কোনরকমেরই পোশাকও নাই। তারা কী যে একটা আতঙ্কের মধ্যে আছেন! ঢাকা থেকে একজন ডাক্তার জানালেন, ডাক্তারদের কাছে জ্বরসহ নিউমোনিয়াররোগী বাড়ছে। কোভিড-১৯ রোগের ল্যাবরেটরি টেস্ট করার সুযোগ খুবই সীমিত। হাতে গোনা কয়েকটা ল্যাবরেটরিতে এইকনফার্মেটরি টেস্টটা করা যায়। এছাড়া, কোভিড-১৯ ডিটেক্ট করার টেস্ট কিট তেমন ভাবে দেশে এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। পর্যাপ্ত টেস্ট করার সুযোগ না থাকার কারণে দেশে নভেল করোনা ভাইরাসের প্রকৃতঅবস্থা জানাটা প্রায় অসম্ভব।এমতাবস্থায়, শুধু এই ডাক্তাররাই নন, ডাক্তারসহ পুরো স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারীরাই কর্মক্ষেত্রেতাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।

করোনার প্রাদুর্ভাবে সবকিছু বন্ধ করা গেলেও হাসপাতালগুলো বন্ধ করা যাবে না।ডাক্তারসহ স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী সকলকেইহাসপাতালে-চেম্বারে গিয়ে রোগী দেখতেই হবে।জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে সরকারকে তাই ডাক্তারসহ স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারীদের শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সাথেই ভাবতে হবে। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার্থে একটা প্রটোকল তৈরী করে অবিলম্বে সকল ডাক্তারের কাছে পৌছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।সেখানে রোগ নির্নয়ের বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।স্বাস্থ্যখাতের বিদ্যমান বাস্তবতায় সন্দেহজনক রোগী (সাসপেক্ট কেস) আর নিশ্চিত রোগী (কনফার্মড কেস) কিভাবে চিহ্নিত করবেন সে ব্যাপারে একটা গাইডলাইন থাকা দরকার।কোভিড১৯ রোগীদের চিকিৎসার ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ইতিমধ্যে গাইডলাইন তৈরী করেছে।এই গাইডলাইনের আলোকে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ কর্তৃক চিকিৎসকদের জন্য একটাট্রিটমেন্ট প্রোটোকল তৈরী করা এখন সময়ের দাবি।
এই প্রেক্ষিতে আমি আমার দীর্ঘনিজস্ব কিছু ভাবনার কথা বলতে চাই।প্রথমেই প্রতি জেলায় জেলায় করোনাবিষয়ক পরামর্শপাবার জন্য হটলাইন টেলিফোন নম্বরের সংখ্যা বাড়াতে হবে।বর্তমানে আইইডিসিআরের যে কটি হটলাইন নম্বর আছে, তাপ্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সারাক্ষণই নম্বরগুলো এনগেজড পাওয়া যাচ্ছে।দ্বিতীয়ত, ঢাকার মত প্রতি জেলায়-উপজেলার হাসপাতালে একটা করোনা ওয়ার্ড বা কর্ণার চালু করা উচিত, যেখানে সন্দেহজনক কোভিড১৯ রোগীরা চিকিৎসার জন্য যাবে।সন্দেহজনক কোভিড১৯ রোগে ঢালাওভাবে যে কোন হাসপাতালে বা ডাক্তারের কাছে যাবার চেয়ে এভাবে নির্দিষ্ট করে দিলে সবারজন্য মঙ্গল।রোগীদের জন্য দেশব্যাপী একটা নির্দেশনা জারী করা জরুরী হয়ে পড়েছে, সেটা হলো শরীরে কোন কোন লক্ষণ হলে রোগীরা করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে যাবেন। কেবল জ্বর হলেই করোনা হয়েছে ভেবে ভয় পেয়েডাক্তারের কাছে যাবারপ্ প্রয়োজন নেই।জ্বর ও শুকনো কাশির সাথে যদি আপনি সম্প্রতি কোন নভেল করোনা ভাইরাস আক্রান্ত কোন অঞ্চলে ভ্রমণকরে থাকেন, বা জ্ঞাত কোন নভেল করোনা ভাইরাসবাহির সাথে দেখাসাক্ষাত করে থাকেন, কিংবা কোন কোভিড-১৯ রোগীর সংস্পর্শে আসেন এবং সাথে শ্বাসকষ্ট থাকে, তাহলে অবিলম্বে নির্দিষ্ট হাসপাতালে যান।কারো যদি শ্বাসকষ্ট ব্যতীত উপরের লক্ষণগুলো উপস্থিত থাকে, তাহলে আপনি ফোনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন, প্রয়োজনে নির্ধারিতহাসপাতালে যান।যদি উপরোল্লিখিত ভ্রমণ ও সংস্পর্শের ইতিহাস না থাকে তাহলে জ্বর হলে ঘরে থেকে জ্বরের সাধারণ চিকিৎসা যেমন প্যারাসিটামল, এন্টিহিস্টামিন সেবন করুন।এক্ষেত্রে বলে রাখা ভাল, অন্য অনেক কারনেও জ্বর হতে পারে।সেরকম কিছু মনে হলে ডাক্তার দেখাতে হবে।
ডাক্তারসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে
এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।এভাবে চললে, দেশে যদি কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা বাড়ে, তাহলে ডাক্তারসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মীরা পড়বে সবচেয়ে বড় হুমকির মুখে।যে কারণে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনকালীন নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা যদি সুস্থ না থাকে, নিরাপদ না থাকে তাহলে রোগীদের চিকিৎসা প্রদানমারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কী হতে পারে তা ভাবতেও পারছি না।চীনের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেছেন।
করোনা রোগীদের চিকিৎসার দায়িত্বে নিয়োজিতডাক্তারসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য বিশেষ পোষাকসহ গ্লাভস, চোখ ঢাকার জন্য গগলস সরবরাহ করতে হবে। এক কথায় যাকে বলে, ‘প্রাইভেট প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই)।
এয়ারপোর্টসহ বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় যারা করোনার স্ক্রিনিংয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত, যারা ল্যাবরেটরিতে করোনার বিভিন্নস্যাম্পল পরীক্ষায় নিয়োজিত, তাদের সবাইকে পিপিই প্রদান করতে হবে।এ ব্যাপারেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুস্পষ্ট গাইড লাইনদেওয়া আছে, সেটা অনুসরণ করতে হবে।দেশে মজুদ না থাকলে প্রয়োজনে চীন থেকে আমদানী করা যেতে পারে।আমি খোঁজনিয়ে দেখেছি, ডিজপোজাবল এসব পিপিই সেটের দাম তেমন বেশী নয়।প্রয়োজন শুধু সরকারের সদিচ্ছা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
এরকম গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ডাক্তারসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মীদেরও নিজেদের শরীরের প্রতি যত্নশীল হতে হবে।অতিরিক্ত কাজের চাপেওযতটুকু সময় পাওয়া যায় ঘুমিয়ে নিতে হবে, ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করতে হবে এবং যতটা সম্ভব এক্সারসাইজ করতে হবে।এসময়ে ডাক্তারসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের শারীরিক-মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে।
৬:গুরুত্বপূর্ণ আরো কিছু বলার ছিল
আমি বিশ্বাসী ধরণের মানুষ।আমি এও বিশ্বাস করতে চাই যে, বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় বাংলাদেশও কোভিড১৯ রোগেরপ্রাদুর্ভাবের ঝুঁকির মধ্যে আছে।এই ভাইরাসটি যেহেতু মানুষ থেকে মানুষে খুব দ্রুত ছড়াতে পারে।আক্রান্তদের ১৫-২০% এরচিকিৎসার প্রয়োজন হয়, যার মধ্যে ৪-৫%র অবস্থা গুরুতর হতে পারে। যদি বাংলাদেশে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে ৪-৫% জটিল রোগীকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেবার সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে কি না তা ভেবে দেখা দরকার।
এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, পরিস্থিতির অবনতি হবার আগেই তারা প্রোঅ্যাক্টিভ হয়ে আগেই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেবে, নাকি পরিস্থিতির অবনতি হলে পরে রিঅ্যাক্টিভ হয়ে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হবে। একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে দুই যুগের বেশী কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, বাংলাদেশের জন্য প্রোঅ্যাক্টিভ হয়ে পরিস্থিতির অবনতি হবার আগেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে শুধু মানুষের জীবনই রক্ষা পাবে না, সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবেও আমরা লাভবান হব।
যে কোন সমস্যাকে সুযোগে পরিণত করাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ।একসময় বন্যা হলে আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হতাম, সাইক্লোন-ঘুর্ণিঝড়ের মত যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসংখ্য মানুষ মারা গেছেন। কিন্তু এই ভয়াল করোনা আমাদের কিরূপ প্রাণহানী ঘটাবে- আমরা জানিনা।
গত পরশু সারা দেশ থেকে গার্মেন্টস কর্মীদের ঢাকামুখী স্রোত দেখে আমি যারপর নাই হতাশ। রাস্তা জুড়ে পিপড়ের সারির মত মানুষ আর মানুষ। কিসের সোশাল ডিসট্যান্সিং আর কিসের স্বাস্থ্যবিধি! সারা দেশ যেখানে লকডাউনে, রাষ্ট্রীয় ছুটি যেখানে বাড়ানো হয়েছে, সেখানে গার্মেন্টস কেন অন্য পথে হাঁটবে? সমস্যাটা আসলে কোথায়? শেখ হাসিনার সরকারকে বিব্রত করার এটি কি কোন মহাপরিকল্পনার অংশ? প্রশ্ন রেখে গেলাম।
সমাপ্ত।
ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কবি এবং সাহিত্যিক। অধ্যাপক: পাবলিক হেল্থ, নরদার্ন ইউনিভার্সিটি; চেয়ারম্যান: ফাইন্ডেশন ফর ডক্টর্স সেফটি এন্ড রাইটস্, বাংলাদেশ।