জ্যাকারান্ডাকে আমি বলি ‘অজিচূড়া’ । মিজানুর রহমান মুকুল

  
    

অস্ট্রেলিয়ায় যারা থাকেন তারা জ্যাকারান্ডা গাছ চেনেন। অক্টোবরের শেষ থেকে শুরু করে এদেশের প্রায় সব যায়গায় কম বেশী দেখা যায় বেগুনী নীল রংয়ের পাতাবিহীন একটি ফুল গাছ। এর নামই জ্যাকারান্ডা। সাধারণত রাস্তার ধারে সারিবদ্ধ ভাবে লাগানো হয় আলংকারিক বা সৌন্দর্য বৃক্ষ হিসেবে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া বাংলা নাম হচ্ছে “নীলকন্ঠ”। জ্যাকারান্ডা ফুলের রঙ বেগুনী বা নীল রঙের হয়ে থাকে, বসন্তে কোনো পাতা থাকে না; ফলে গোটা বৃক্ষটিকে মনে হয় বেগুনী বা নীল বৃক্ষের মত, এই ফুল গাছ বসন্তে বেশ স্বাপ্নিক একটা আমেজ নিয়ে আসে। এই ফুলের নিজস্ব সৌন্দর্যের জন্য বিভিন্ন কৃষ্টিতে, সাহিত্যে, গানে বাজনায় এই ফুলের কথা আছে। এমনকি কুসংস্কারেও বিভিন্ন জাতিতে রয়েছে জ্যাকারান্ডা ফুলের কথা।
স্যার জেমস্ মার্টিন এর উদ্যোগে জ্যাকারান্ডা ফুলগাছের বীজ ১৮৫০ থেকে ১৮৬০ সালের দিকে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও থেকে প্রথম অস্টেলিয়াতে এসেছে বলে ধারনা করা হয়। ১৫০ বছরের কিছু বেশি সময় পুর্বে এই গাছ অস্ট্রেলিয়াতে প্রবেশ করেছে অথচ বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াবাসী জ্যাকারান্ডা বৃক্ষ ছাড়া তাদের বসন্তের পরিবেশ চিন্তাই করতে পারে না।
একটু ঝড়ো বাতাস বা বৃস্টি হলে এই ফুল ঝরে পড়ে সবুজ ঘাস ও রাস্তার উপর যা দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন কেউ বেগুনী রংয়ের কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে। তবে বৃষ্টির সময় খুব সাবধানে গাড়ী চালাতে হয় বা পথ চলতে হয় কারণ ফুল আর পানি মিলে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে থাকে।

জ্যাকারান্ডার ছাদ ঘিরে স্বাপ্নিক সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিডনির হার্বার ব্রিজ। ছবি- লেখক

Jacarandas মূলত ‘স্বপ্ন গাছ’ নামে পরিচিত। জ্যাকারান্ডা ফুলের নাম এসেছে লাতিন ভাষা থেকে। ৪৯টি প্রজাতি নিয়ে গঠিত বিগ্নোনিয়াসি (Bignoniaceae) পরিবারের একটি প্রজাতির নাম জ্যাকারান্ডা। এর আদিনিবাস হলো মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, কিউবা, আর্জেন্টিনা, হিস্পানিওলা এবং জ্যামাইকা ও বাহামার উষ্ণ ও উপউষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলগুলোতে। এটাকে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এমনকি অস্ট্রেলিয়াতেও অনুপ্রবেশ করানো হয়েছে। এটা নেপালে ব্যাপক ভাবে লাগানো হয়েছে।
সাধারণত বেগুনী ও নীল এই দুই ধরনের ফুল সর্বত্র দেখা যায়। নীলকন্ঠ বা নীল জ্যাকারান্ডা (সাধারণ নাম: Blue Jacaranda, Neel gulmohur, Neelkanth) (বৈজ্ঞানিক নাম:Jacaranda mimosifolia) বিগ্নোনিয়াসি পরিবারের একটি উদ্ভিদ। এটি ক্রান্তীয় আমেরিকার প্রজাতি। এরা মাঝারি আকারের পত্রমোচি গাছ।

নীল ও বেগুনী ফুলে ছেয়ে গেছে চারপাশ। ছবি- লেখক।

জ্যাকারান্ডার পাতা দেখতে বাংলাদেশী কৃষ্ণচূড়া ফুলের পাতার মত এবং ফুলের রং জারুল ফুলের মত বেগুনী রঙের। তাই আমি এই ফুলের নাম দিয়েছি অস্ট্রেলিয়ার “অজি”ও কৃষ্ণচূড়ার সাথে মিলে “অজিচূড়া”। গাছের উচ্চতা অনেক টা কৃষ্ণচূড়া গাছের মতই সাধারণত ১০-১৫ মিটার হয়ে থাকে।
সিডনি থেকে ৬৪০কি:মি: দূরে নিউ সাউথ ওয়েলস অঙ্গরাজ্যর মধ্যে গ্রাফটন নামক যায়গায় সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে পুরো রাস্তাগুলো জ্যাকারান্ডা ফুলে ফুলে বেগুনী হয়ে থাকে এ উপলক্ষে প্রতি বছর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ ও নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ ব্যাপি চলে জ্যাকারান্ডা উৎসব। গ্রাফটনকে অস্ট্রেলিয়ার জ্যাকারান্ডার রাজধানী বলা হয়, কেননা, গ্রাফটনের বেশির ভাগ রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ ভাবে অসংখ্য জ্যাকারান্ডা লাগানো আছে।
অস্ট্রেলিয়ার অনেক রাস্তার নাম জ্যাকারান্ডার নামে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন, নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের গ্রাফটনে এবং লিসমোরে দুটি পৃথক রাস্তার নাম জ্যাকারান্ডা এভিনিউ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
নর্থ সিডনির কিরিবিলি তে McDougall Street এ রাস্তার দুই পাশে জ্যাকারান্ডা গাছ সারিবদ্ধ ভাবে অনেক বছর পুর্বে লাগানো হয়েছিল। যা বর্তমানে বড় হয়ে রাস্তার উপরে ছাদের মত দেখতে। পাতাবিহীন ফুলের সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন শত শত পর্যটক আসে এখানে। এই রাস্তার উপরে ও নিচে তাকালে একটা স্বাপ্নিক আবহ দেখা যায়।

পরিবারের সাথে লেখক ও আলোকচিত্রী মিজানুর রহমান মুকুল।

একদিন বিকেলে আমার দুই মেয়ে ও স্ত্রী সহ জ্যাকারান্ডার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য যাই। ওখানে দেখা জ্যাকারান্ডা ফুলের সৌন্দর্য সত্যিই লিখে বর্ননা করা অসম্ভব। রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছ বড় হয়ে মাথার উপর দিকে বেগুনী নীল রং এর ছাদের মত দেখতে।
পর্যটক এবং ফটোগ্রাফার রা প্রায়ই এখানে গাড়ী চলাচলের রাস্তার মাঝেখানে দাড়িয়ে বসে ফটো তোলার চেষ্টা করে যা স্থনীয় অধিবাসীদের জন্য বিরক্তিকর।পর্যটকের ছবি তোলার দৃশ্যগুলি স্থানীয় অধিবাসীদের উদ্বিগ্ন করেছে যারা চিন্তিত যে কোন বড় ধরনের দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে এইসময়ে।
মিলসন প্রিচিন্ট গ্রুপ নামে একটি সংগঠন নর্থ সিডনিতে সরকারীভাবে একটি জ্যাকারান্ডা উৎসব পালন করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে নর্থ সিডনি কাউন্সিলে। কাউন্সিল মেয়র বলেছেন ট্রাফিক ও অন্যান্য বিষয় যাচাই করে দেখবে। হয়তবা ভবিষতে এখানে জ্যাকারান্ডা উৎসব পালিত হবে এবং অনেক অনেক পর্যটক আসবে এই স্বাপ্নিক ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে।

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান মুকুল
আলোকচিত্রী ও নিসর্গিক
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments