কাল রোজ গার্ডেনে ট্রাম্পের স্পীচ শুনবার জন্য বেশ রাত পর্যন্ত জেগে বসেছিলাম আমি। কাতারে তখন রাত দুটো। টিভি স্ক্রিনের কোনায় সিএনএন এ বার বার ঘোষণা আসছিলো, ট্রাম্প স্পীচ দেবেন ‘এনি মোমেন্টে’। সেই ‘এনি মোমেন্ট’ শেষ হতে অনেক লম্বা সময় লেগে গেলো। কি জানি কিসের আশায়, তবুও বসে ছিলাম ! আসলে মানুষ তো আশা নিয়েই বেঁচে থাকে। তাই আমারও হয়তো একটা ক্ষীণ আশা ছিল ট্রাম্প তার গভীর সমবেদনার কথা বলবেন, আশার বাণী শোনাবেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটা কঠোর ব্যবস্থা নেবেন যা শত বছরের নির্যাতন এবং নিপীড়নের একটা ইতি টানবে। আহা, কি সুন্দর স্বপ্ন ছিলো আমার !
অনেক লম্বা সময় নিয়ে বখে যাওয়া তরুণের মতো বের হয়ে এলেন ট্রাম্প। ওনার সমস্ত শরীরে এবং চোখে মুখে সব সময় একটা গোঁয়ার্তুমি প্রকাশ পায় যেন।উনি ছাড়া পৃথিবীতে আর কোন কিছুরই কোন মূল্য নেই। কেউ কিছু না, কোন মানুষ মানুষ না। উনি যেটা বলবেন, বুঝবেন সেটাই একমাত্র সত্য- এমন একটা অভিব্যক্তি নিয়ে দাঁড়ালেন বরাবরের মতোই। এক লাইনে জর্জ ফ্লয়েডের জন্য স্যরি হয়ে দেশে শান্তি আনা নিয়ে আইন শৃঙ্খলার কথা শোনালেন। আর্মি নামানোর কথা বললেন, বাকি সময়টা অ্যামেরিকা কতো মহান তা নিয়ে বললেন আরও কয়েক মিনিট।

এর আগেও একদিন আমি অপেক্ষা করেছিলাম ট্রাম্পের স্পিচ শুনবার জন্য। সেদিন চীনের গুষ্ঠি উদ্ধার করে দিয়ে একবারের জন্যেও জর্জের কথা বলেননি লোকটা। যার হাতে এতো ক্ষমতা সে কি করে এড়িয়ে যায় এমন অস্থির একটা সময়? এমন একটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য তিনিও তো অন্য সবার পাশে দাঁড়াতে পারতেন। কিন্তু তাহলে সেটা হয়তো ট্রাম্প হতো না। উনি হয়তো শিখেছেন, কালোদের জীবনের কোন মূল্য নেই, হয়তো শিখেছেন কালোদের মায়া দেখানো মানেই দূর্বলতা, হয়তো শিখেছেন মায়া দেখালেই এরা মাথায় চড়ে বসবে, হয়তো শিখেছেন এদেরকে ডাণ্ডাবাজি করেই থামাতে হয় -এমন সব বিশ্বাস হয়তো ওর নিজের মনেই কাজ করে, তাই স্পীচ দিতে এসে মিথ্যা সান্ত্বনা দিতে পারেননি। তিনি হয়তো মনে মনে ওই পুলিশ অফিসারের মতোই, যিনি হাটু গেড়ে বসেছিলেন ফ্লয়েডের বুক ও ঘাড়ের ওপর।
জর্জদের প্রতি অন্যায় অবিচার নিয়ে সহানুভূতি দেখালে ট্রাম্পের কি ক্ষতি হয় আমি জানি না। তবে এটা যে ওর ভেতর থেকে আসে না এটা স্পষ্ট। এতো অ্যারোগেন্ট নারসিসিস্ট অনুভূতিহীন রেসিস্ট একজন মানুষকে দেশ চালাবার মতো দায়িত্ব দিয়ে এর বেশী কিছু হয়তো আমরা আশা করতে পারিনা। কিন্তু মানুষ এবার থামবার জন্য পথে নামেনি।

নিউইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমো আমাকে একটা স্বপ্ন দেখান। এই ভদ্রলোকের মধ্যে আমি মনুষ্যত্ব দেখতে পাই। উনি ট্রাম্পের এই স্পিচে অনেক লজ্জিত হয়েছেন, টুইটারে বলেছেন “প্রেসিডেন্টের জন্য এটা আরেকটা টিভি রিয়েলিটি শো। প্রেসিডেন্ট মিলিটারি লাগিয়েছে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ঠেকাতে, যেন ও চার্চে যেয়ে ছবি তুলতে পারে।”
এমন অমানবিক একটা কাজের প্রতি একজন মানুষ যদি তার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সামান্যতম সহানুভূতিও প্রকাশ করতে না পারে তাহলে তার জীবনের সার্থকতা কোথায়? সে অ্যামেরিকার মতো একটা দেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারে কিন্তু মানবসভ্যতায় তার অবস্থান সত্যিই অনেক নীচে। শত শত বছর ধরে যে অত্যাচার, অন্যায় এবং অবিচার চলে এসেছে, এতো বছর পরেও জর্জ ফ্লয়ডের এই মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা আসলে সামনে এগোইনি। আমরা এখনো অনেক পেছনেই পরে আছি। মানব সভ্যতার জন্য এর চেয়ে লজ্জাকর ঘটনা আর কি হতে পারে?
এটা ২০২০ সাল । ২০২০ সালে মানুষ এই নিপীড়ন সহ্য করবে না। মেনে নেবে না। করোনা, মৃত্যু বা জেলের ভয় মানুষকে কিছুতেই দাবিয়ে রাখতে পারবে না। এ ঘোর অন্যায়। এ অন্যায় থামতেই হবে। সভ্য সমাজের স্বপ্ন পূরণ হবে, Black lives matter এটা মানতেই হবে।
শিল্পী রহমান: গল্পকার, কবি, সংস্কৃতিকর্মী, কাউন্সেলর ও গবেষক। স্থায়ী নিবাস ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়ায়। কর্মসূত্রে রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে। প্রকাশিত গ্রন্থসমুহ: ধর্ষণ ধর্ষক ও প্রতিকার; উৎকণ্ঠাহীন নতুন জীবন; মনের ওজন; সম্ভাবনার প্রতিচ্ছায়ায়; যুদ্ধ শেষে যুদ্ধের গল্প; পথের অপেক্ষা; পাহাড় হবো ইত্যাদি।