
শেষ খন্ড
সাত-আট মিনিটেই সায়মন রেখাকে জানায়:
নাম রাহাত খান, বাবা মৃত জব্বার খান। ম্যানচেস্টার স্কুল অফ আর্কিটেকচার থেকে অনার্স এবং মাষ্টার্স শেষ করেছে। ছোট একটা আর্কিটেকচার ও ইন্টেরিয়র ডিজাইন কোম্পানির মালিক। কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই, ছোট বেলায় বাবা মারা যাবার পর থেকে মামার কাছে মানুষ হয়েছে। তার মামা প্রাক্তন এমপি এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মঈন খান।
সায়মনের ফোন শেষ হতে হতেই, রাহাত মগ ভর্তি চা নিয়ে ফেরে। রেখা চায়ে চুমুক দিয়ে বলে:
-চা বেশ ভালো হয়েছে। তোর মামার এই বাড়িতে কে কে থাকে?
-কেউ না, মাঝে মাঝে পুরো পরিবার আসে কিছুদিন থাকে। মাঝে মাঝে মামার ব্যবসায়িক পার্টনারদের জন্য পার্টির ব্যবস্থা করে। ইনফ্যাক্ট আজই মামা আসবে, রুফটপে ১০-১৫ জনের ছোট একটা পার্টি আছে। তোমাকে কিন্তু আসতে হবে।
-আরে নাহ, আমি আসবো না।
-তুমি সংকোচ করছো কেন? মামা খুব ফ্রেইন্ডলী এবং শিল্পমনা তুমি কথা বললেই বুঝবে। তুমি যে ছবিঘরে ছবি দেখতে যাবে সেখানকার এস এম সুলতানের ছবি গুলো মামার সংগ্রহ। মামা আমাকে খুব ভালোবাসে এবং ছোটবেলা থেকে ছেলের মত বড় করেছে, যদিও মামাকে আমি কিছু কারণে খুব অপছন্দ করি বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
-নারে ,আমি আসবো না।
-ফালতু কথা না আর, আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসব।
-আচ্ছা দেখা যাবে বলে রেখা সময় দেখল, প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। শোন এখন উঠব, আজ আর ছবি ঘরে যাবো না। তোর ফোন নাম্বার দে, কাল যাব ছবি দেখতে। রাহাতের ফোন নাম্বার সেভ করে সাইকেলের প্যাডেলে পা দেয়।
তিন চার মিনিটের ভিতর মেইন রাস্তায় এসে পরে। মেইন রাস্তাও বেশ শান্ত, ট্রাফিক জ্যাম নেই, রিকশা নেই, ফুটপাতে হকার নেই, পথের পাশে দোকান নেই। রোদের প্রখরতা বেড়েছে, বেড়েছে গরম অনুভূতি। রেখা ফুটপাত ধরে দাঁড়ায়, মনের ভেতর অস্থির অবস্থা। নিজের কাছে মনে হচ্ছে অকারণ ঘুরে বেড়াচ্ছে, সে কোনো তথ্য উদ্ঘাটন করতে পারবে না।
রেখা ফোন বের করে ওসি রশিদ সাহেবকে ফোন দিলো:
-হ্যালো রশিদ সাহেব।
-জী ম্যাডাম।
-দুপুরে লাঞ্চের পর কি আপনার সময় হবে? আমি খুনের স্পট গুলো একটু ভিজিট করতে চাই।
-কখন আসতে হবে বলেন?
-দেড়টার দিকে আসেন, আমি হোটেলে থাকব।
-জ্বী ম্যাডাম, আমি ব্যবস্থা করছি।
-আচ্ছা, তাহলে রাখছি দেড়টার দিকে দেখা হবে।
রেখা হোটেলে ফিরে ফ্রেস হয়ে বারান্দায় দাঁড়াতেই সায়মনের ফোন আসে। ফোন রিসিভ করেই জিজ্ঞেস করে :
-হ্যালো সায়মন কোনো আপডেট আছে ?
-খুনের ঘটনার কোনো আপডেট নেই তবে নতুন কিছু ঘটনার আপডেট আছে। রিভার সিটিতে যে কয়জন খুন হয়েছিল তাদের প্রত্যেকের কোম্পানি ওয়েবসাইট হ্যাকাররা হ্যাক করে তাদের কুকীর্তি প্রকাশ করেছে। এছাড়াও গণশত্রু নামে একাউন্ট দিয়ে ফেইসবুক এবং টুইটার এ এসব কু-কীর্তি ভাইরাল করেছে। দুর্নীতি, জমি দখল, মানি লন্ডারিং, খুন, স্মাগলিং এমন কিছু নেই যা তারা করেনি। সবচেয়ে বেশি স্ক্যান্ডাল এমপির।
-হুমম, বুঝলাম তা তোমাদের আপডেট কি? সেটা বলো।
-আমাদের জানানোর আধঘন্টার মধ্যেই হ্যাকিং ডিভাইস গুলো লোকেট করতে পেরেছি। পুলিশ কাউকে এরেস্ট করতে পারেনি তবে ডিভাইস উদ্ধার করেছে।
-গুড জব। তবে সায়মন আমাদের খুশি হবার কোনো কারণ নেই। আমার ধারণা ওরা আমাদের থেকে বেশি ইন্টেলিজেন্ট। ওরা ইচ্ছে করেই ডিভাইস গুলো আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে। সরকারকে আরো কিছু কেলেঙ্কারির তথ্য তুলে দেবার জন্যই এটা করেছে। আমার ধারণা খুনিরাই এই হ্যাকিং করেছে, জনগণের সমর্থন নেবার জন্য। যাই হোক তোমাদের অনেক ধন্যবাদ দ্রুত আইডেন্টিফাই করার জন্য। অনেক ব্যর্থতার ভেতর কিছুটা হলেও স্বস্তি। আর কোনো কিছু ঘটলে আমাকে জানিও বলে রেখা ফোন রেখে দেয়।
রশিদ সাহেব নির্ধারিত সময়ের আগেই এসে উপস্থিত হয়েছে। সঙ্গে আরো তিনজন, সকলেই সিভিল পোশাকে। রেখা ল্যাপটপ আর কিছু হ্যান্ড গ্লাভস ব্যাগে ঢুকিয়ে দ্রুত পুলিশের গাড়িতে চেপে বসল।
রশিদ সাহেব কে বলল:
-আমরা প্রথমে আফতাব সাহেবের বাড়িতে যাবো।
গাড়ী মেইন সড়ক ধরে চলছে, যানবাহন কম থাকায় খুব দ্রুত চলছে। রশিদ সাহেব পাশের সিটে বসেছে, চোখে কালো সানগ্লাস। রেখার দিকে ফিরে বললো:
-ম্যাডাম আফতাব সাহেবের কীর্তিকলাপ ফাঁস হয়েছে। আপনি কি দেখেছেন?
-না, দেখিনি। তবে শুনেছি, শুধু আফতাব সাহেব কেন! যে কজন খুন হয়েছে সবারটাই তো ফাঁস হয়েছে।
-আপনি তো শুধু শুনছেন, এভিডেন্স গুলো দেইখেন। এরা যেসব আকাম কুকাম করছে এদের তো ক্রসফায়ার দেয়া উচিৎ। আমরা পুলিশ তো কিছু করতে পারিনা, এক হিসেবে খুনিরা ভালো কাজ করছে। এই কাজের জন্য ওগো পুরস্কার দেয়া উচিৎ।
রেখা ভুরু কুঁচকে রশিদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে কি বলেন এইসব ! পুলিশ হয়ে খুন কে সমর্থন করেন? বিনা বিচারে মানুষ মেরে ফেলাকে সমর্থন করেন?
রশিদ সাহেব একটু বিরক্তি নিয়ে বলে,
-আপনি বিচারের কথা বলছেন। বিচার ব্যবস্থা তো ওদের হাতের মুঠোয়।
-আপনার কথায় যুক্তি থাকলেও আমি ব্যাক্তিগত ভাবে বিচারহীন হত্যাকে সমর্থন করিনা।
কথা বলতে বলতে গাড়ি এসে আফতাব শিকদারের বাড়ির সামনে দাঁড়ায়। বাড়ির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে রশিদ সাহেব কে জিজ্ঞেস করে:
-বাড়িতে কয়টা সিকিউরিটি ক্যামেরা পাওয়া গেছে?
-বাড়ির ভেতরের এবং বাইরের অংশ মিলিয়ে ১২ টা ক্যামেরা।
-সবগুলো কি ওয়ারলেস আইপি ক্যামেরা ?
-হ্যাঁ ,সব ওয়ারলেস ক্যামেরা, খুনের দুদিন আগে থেকেই ক্যামেরা গুলো বন্ধ ছিল।
-এখন কি ক্যামেরা গুলো খোলা?
-হ্যাঁ, তবে ক্যামেরা মেমোরি কার্ড বদলে ফেলা হয়েছে। পুরোনো মেমোরি কার্ড গোয়েন্দা বিভাগের কাছে।
বিল্ডিংয়ের ভেতরে কোথাও কোনো গোপন ক্যামেরা আছে কিনা, সেগুলো খোঁজার জন্য রশিদ সাহেবকে অন্য তিনজন কে ইন্সট্রাকশন দিতে বলে।
রশিদ সাহেব মনে মনে বলে আসছে বিরাট গোয়েন্দা!! আরে আমরা এসব কাজ আগেই করেছি। বিরক্ত হলেও অন্যদের কাজে লাগিয়ে দেয়।
রেখা পুরো বাড়িটা দেখা শেষ করে ছাদে আসে, ছাদের উপরে একটা বড় কামরা। গ্লাসের দরজা থাকায় ভেতর টা দেখা যাচ্ছে, সাজানো স্টাডি রুম। রুমের সামনে প্রশস্ত পার্টি স্পেস, ছাদের শেষ মাথায় সুইমিং পুল। সুইমিং পুলের কাছেই আফতাব সাহেবের মৃত্যু স্থান চিহ্নিত করা আছে। রশিদ সাহেব কে জিজ্ঞেস করল:
–
ছাদের এই রুম খোলার ব্যবস্থা আছে?
-আছে ম্যাডাম, নাম্বার ডোর লক খুলতে খুলতে বলে তবে এই রুমে কিছু পাওয়া যায়নি। খুনের সময় এই রুম বন্ধ ছিল, পরে গোয়েন্দা বিভাগের লোক ভেতরে ঢুকেছিল।
রেখা রুমের ভেতর ঢুকলো, ছিমছাম স্টাডি রুম। মাঝখানে চার জনের বসার জায়গা, একদিকে মিনি বার এবং বড় টেলিভিশন। অন্যদিকে প্রচুর বইয়ে ঠাসা বইয়ের তাক ,পাশে কম্পিউটার ডেস্ক।
-এই কম্পিউটার টা কি খোলা হয়েছিল?
-সম্ভবত না, ম্যাডাম।
রেখা হ্যান্ড গ্লাভস পরতে পড়তে পড়তে বললো এই কম্পিউটার এর কীবোর্ড, মাউস এবং মাউস প্যাড ফরেনসিক ল্যাব এ পাঠাবেন। ফিঙ্গার প্রিন্ট চেক এর জন্য। রেখা এক্সটার্নাল মাউস এবং কীবোর্ড নিয়ে এসেছিলো। মাউস কীবোর্ড লাগিয়ে কম্পিউটার ওপেন করে। কম্পিউটার পাসওয়ার্ড প্রোটেক্টেড, রেখা ফ্লাশ ড্রাইভ লাগিয়ে নিজের প্রোগ্রাম চালু করে।
রশিদ সাহেব একটু অবাক হয়ে রেখাকে দেখে, কোলের উপর রাখা কীবোর্ড এর উপর রেখার আঙ্গুল চলছে ঝড়ের গতিতে। এতো দ্রুত কেউ টাইপ করতে পারে! দুই মিনিটের ভেতর পাসওয়ার্ড ভেঙে কম্পিউটার এর ভেতর ঢোকে। সিকিউরিটি ক্যামেরা সফটওয়্যার ওপেন করে দেখে মোট ১২ টি ক্যামেরা থাকলেও, আরো ৪ টা ক্যামেরার সন্ধান পায়। আরো আধ ঘন্টার চেষ্টায় সব গুলো ক্যামেরার লোকেশন বের করে ফেলে। রেখা চেয়ার ছেড়ে উঠে।
-চলুন রশিদ সাহেব ছাদে যাই। আমি একটা সিগারেট খেতে খেতে কথা বলবো, আশা করি মেয়েদের সিগারেট খাওয়া দেখে অবাক চোখে তাকাবেন না।
ছাদে এসে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে:
-রশিদ সাহেব আপনি বলেছিলেন টোটাল ১২ টা ক্যামেরা, কিন্তু সর্বমোট ক্যামেরা ১৬ টা। ছাদের এই রুমের ভেতরেও একটা গোপন ক্যামেরা আছে। বইয়ের তাকের লকার টাই একটা ক্যামেরা, ড্রইং রুমের ঝরনাটা দেখেছেন সেটায় একটা গোপন ক্যামেরা রয়েছে। তবে সম্ভবত এই ক্যামেরা গুলাও বন্ধ ছিল, তবুও আমি আরো কিছুক্ষন কম্পিউটার এ বসে চেক করবো। আপাতত আপনি নিচে গিয়ে আপনার লোকদের খোঁজাখুঁজি বন্ধ করুন।
রশিদ সাহেব কপালে ভাঁজ দেখা যায়, মনে মনে বলে আরে এই ম্যাডাম তো জিনিয়াস! আর সে কিনা ভাবছিলো অকাজের মহিলা।
রশিদ সাহেব সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই রেখা ডাক দেয়।
-আমাকে চা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা যায়? খুব চায়ের তেষ্টা পেয়েছে।
-অবশ্যই ম্যাডাম, ব্যবস্থা নিচ্ছি।
রেখা সিগারেট শেষ করে কম্পিউটারে গিয়ে বসে। দশ থেকে পনেরো মিনিটের ভেতর বুঝতে পারে কম্পিউটার হ্যাক হয়েছিল এবং এই কম্পিউটার দিয়েই ক্যামেরা গুলো হ্যাক করে বন্ধ করা হয়েছিল। এর মধ্যে রশিদ সাহেব ফ্লাক্স ভর্তি চা এবং কাপ নিয়ে হাজির। চা খেতে খেতে রশিদ সাহেব কে বলে:
-ক্যামেরা গুলো এমনি এমনি বন্ধ ছিল না, এই কম্পিউটার এবং ক্যামেরা গুলো হ্যাক করা হয়েছিল। খুনি চক্র খুব ইন্টেলিজেন্ট, আমি চেষ্টা করছি ওদের আইপি গুলো খুঁজে বের করার।
এরপর প্রায় আরো ঘন্টা তিনেক কাজ করার পর রেখার চোখে মুখে একটা হতাশার ভাব ফুটে ওঠে। রেখা উঠে রাশিদ সাহেবের খোঁজ নেয়। রাশিদ সাহেব ছাদেই ছিল।
-রাশিদ সাহেব আপাতত কিছুই হচ্ছে না, আপনাকে কম্পিউটারটা ঢাকা পাঠাতে হবে। আমরা আরো চেষ্টা চালাতে চাই। আরো একটা কাজ করতে হবে এই বাড়ির কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ক্যামেরা সেট আপ যারা দিয়েছে তাদের তথ্য বের করতে হবে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, যদিও আমার মনে হয় তারা জড়িত নয়।
-জি, আচ্ছা ম্যাডাম। এখন কি আমরা অন্য খুনের স্পটে যাবো?
-হ্যাঁ, অন্য স্পট গুলোও দেখতে চাই। রেখা নিজের ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে আসে। ছাদ থেকে নামার পূর্বে নামার সময় চোখ যায় বিকেলের শান্ত নদীর দিকে। গোধূলির শেষ আলো চিকচিক করছে নদীর জলে। সৌন্দর্যের দিকে সময় নষ্ট না করে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়।
সবগুলো স্পট ভিজিট শেষে যখন হোটেলের সামনে নামল তখন প্রায় রাত আটটা। হোটেলে ঢুকতেই রাহাতের দিকে চোখ পড়ে, বুঝতে পারে রাহাত ওকে মামার বাড়ির পার্টিতে নিয়ে যেতে এসেছে। কাছাকাছি গিয়ে জিজ্ঞেস করে কতক্ষণ আগে এসেছিস?
-প্রায় ঘন্টা দেড়েক।
-আমাকে ফোন করতে পারতিস।
-তুমি আমার সেল নাম্বার নিলেও তোমার নাম্বার নিতে আমি ভুলে গিয়েছিলাম।
-হুম,তাইতো আমিও তো তোকে নাম্বার দেই নি।
সারাদিনের ধকলের পরে রেখার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। অথচ রাহাত দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করেছে, ওকে না বলতে পারছে না। রাহাতকে বলল
– চল রুমে চল, সারাদিন ঘুরেছি আমি একটা শাওয়ার নিয়ে তোর সাথে বের হবো।
-আমি এখানেই অপেক্ষা করছি।
রেখা দ্রুত শাওয়ার শেষ করে, সাজসজ্জার দিকে রেখার কোন ও রকম নজর নেই। হাতের কাছে যা আসে তাই পরে।আজ পড়েছে সাদা পাজামার ওপর সবুজ লং ফতুয়া। ক্যামেরা নেবে ভেবেও শেষ মুহূর্তে রেখে দেয়, গলায় একটা ওড়না পেঁচিয়ে নিচে নেমে আসে।
রাহাতের গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল:
-আমি পার্টিতে বেশি সময় থাকবো না। মামার সাথে দেখা করেই চলে আসবো। সারাদিন আমার উপর খুব ধকল গেছে, এখন খুব ক্লান্ত লাগছে। তুই না আসলে আমি যেতাম না।
রাহাত একটু ব্যঙ্গ সুরে বলে -এতো ছোট একটা শহরে ঘুরেছো, তাতে ধকল আসলো কই থেকে!
-তুই ধকল বুঝবি কি করে! সকালে তোকে একটা মিথ্যে বলেছি। আমি আসলে ঘুরতে আসিনি। আমি পুলিশের লোক এখানে খুনের তদন্তে এসেছি।
রাহাত ড্রাইভ করলেও রেখার দিকে অবাক হয়ে থাকায়।
-কি বলো আপা ! চাপা মারিও না! তোমার চেহারা থেকে শারীরিক গঠন কোনোটাই পুলিশের মত না।
রাহাতের বলার ভঙ্গিতে রেখা হেসে ওঠে।
-কেনো পুলিশের কি আলাদা চেহারা! তুই কি জানিস পুলিশে কি অপূর্ব সব সুন্দরীরা চাকরি করে। দেখলে তোর মাথা ঠিক থাকবে না।
-আমি দেখেছি, তুমি তাদের মত নও। তুমি কি গোয়েন্দা ?
-নারে, আমি গোয়েন্দাও নই, আমি পুলিশের ক্রিমিনাল নেটওয়ার্ক বেজ ডাটাবেজের চিফ এডমিনিস্ট্রেটর।
-আপা তুমিও তো ছুপা রুস্তম, সকালে বাড়ি দেখিয়ে তোমায় অবাক করে দিয়েছি। আর এখন তুমি আমার মাথা আউলা ঝাউলা করে দিয়েছো।
রেখা আবার হাসে, কথা বলতে বলতে রাহাতের মামার বাড়িতে এসে পৌঁছায়। বিদ্যুতের আলোয় বাড়িটাকে এখন আরো সুন্দর লাগছে। তবে রেখার সেদিকে খুব একটা খেয়াল করল না। রাহাতের পিছুপিছু রুফটফ এ এসে পৌঁছায়। ছবির মত সুন্দর একটি ছাদ, সাজানোর গাছ, সুইমিং পুল বসার জায়গা সব কিছুই গোছানো। পুরো ছাদটা আলোয় ঝলমল করছে। রেখাকে একজায়গায় বসিয়ে বলল
– আমি মামাকে ডেকে আনছি। তুমি হার্ড ড্রিংক বা সফট ড্রিংক কি নেবে?
-সফট ড্রিংক নিয়ে আয় তবে এক মগ কফি হলে ভালো হতো, খুব ক্লান্ত লাগছে।
-তাহলে কফি কেন? বিয়ার নিয়ে আসি, এখানে লজ্জার কিছু নেই আপা।
-না না তুই যা।
রাহাত চলে যেতে রেখা উঠে ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। এখান থেকে পুরো শহরের একাংশ দেখা যায়। আলোয় ঝলমলে শহর, শহর শেষ হতেই মেঘনার জলের ছবি। বহুদূরে মেঘনায় ভাসা জেলেদের নৌকা সারি সারি, দেখে মনে হয় শতশত আলোর প্রদীপ ভাসছে জলে।
এক ভদ্রলোক সামনে এল, কাঁচা পাকা চুল। চুলে পাক ধরলেও চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েনি।
-হ্যালো আমি রাহাতের মামা। আপনি নিশ্চয়ই রেখা?
-জ্বী মামা।
-রাহাত তো আমাকে বানিয়ে কিছু বলেনি! তুমি জান না মা, আমার ভাগ্নি অবিকল তোমার মতো ছিল। তোমার হয়তো বিশ্বাস হচ্ছে না, ছবি দেখলে বুঝতে কতটা সত্যি। আমাদের সবার প্রিয় ছিল সে, তুমি একদিন ঢাকার বাসায় এসো তোমাকে ওর ছবি দেখাবো।
ভদ্রলোকের আন্তরিকতায় রেখার জড়তা কেটে গেল, প্রথম দেখাতেই মা সম্মোধন টা কানে বাজছে। এরমধ্যে রাহাত কফির মগ নিয়ে হাজির।
-এই তো রাহাত এসে গেছে, তোমরা কথা বল। আমি ওদিকটায় দেখছি বলে ভদ্রলোক চলে গেল।
রেখা কফিতে চুমুক দিল, বেশ স্ট্রং কফি। এই মুহূর্তে রেখার এটাই দরকার ছিল। পুরো পার্টিতে ১০-১২ জন লোক। এক কর্নারে ঘরোয়া কনসার্ট এর ব্যবস্থা। একস্টিক গিটার হাতে একজন গাইছে পিট সিগার এর পুরোনো গান “Where have all the flowers gone? Long time passing …” গানটা রেখার খুব পছন্দের।
গান শেষ হতে রাহাতের মামার গলায় ঘোষণা শুনতে পেলো: “আপনারা সবাই আমার ভাগ্নেকে চেনেন। আপনারা সবাই তাকে ট্যালেন্টেড আর্টিটেক্ট হিসেবে চেনেন। তবে তার অনেক গুন, সে খুব ভালো ভায়োলিন বাজায়। রাহাতকে ভায়োলিন শোনানোর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমার বিশ্বাস তার ভায়োলিনের সুরে আপনারা সবাই মুগ্ধ হবেন।”
রাহাত একটু বিরক্ত হয়ে – মাঝে মাঝে মামা কি যে করে না! বলে সামনের দিকে যায়। রেখাও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শোনার জন্য সামনের দিকে যায়।
রাহাত অল্প সময়ের ভিতরে বেহালা নিয়ে মিউজিশিয়ানদের কাছে যায়। বেহালায় মাইক্রোফোন সেট করে গিটারিস্টের কানে কানে কথা বলে। গিটারিস্টকে মাথা দোলাতে দেখা যায়, টুং টাং গিটার বেজে ওঠে। কয়েক মুহূর্তেই বেজে ওঠে বেহালা, বেহালার সুরে কথা গুলো স্পষ্ট হয়ে বাজছে।
“যদি তারে নাই চিনি গো সে কি আমায় নেবে চিনে
এই নব ফাল্গুনের দিনে — জানি নে জানি নে॥”
বহুবার শোনা রবীন্দ্র সংগীত রেখার কাছে নতুন করে ধরা দেয়। ৪-৫ মিনিট মন্ত্র মুগ্ধের মত শোনে গিটার এবং বেহালার কম্বিনেশন। শেষ হতেই হাত তালির সাথে সাথে চিৎকার করে বলে ওয়ান মোর, ওয়ান মোর। সাথে সাথেই বিদ্যুৎ চলে যায়, বা দিক থেকে কে একজন জোরে ধাক্কা দেয়। রেখা ধাক্কা সামলাতে পারেনা, ছিটকে পরে মেঝেতে। একই সাথে একটা গুলির শব্দ টের পায়, তারপর কিছু মনে করতে পারে না।
সম্ভবত পাঁচ থেকে ছয় মিনিট অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। চোখ খুলে দেখে কেউ একজন চোখে পানির ঝাঁপটা দিচ্ছে। রেখার মাথা ঝিমঝিম করছে, ডান চোখের ভ্রু জ্বলছে। হাত দিয়ে দেখে অনেকখানি ফুলে উঠেছে। পানির ঝাঁপটা দেয়া লোকটা বললো বেশ কিছুটা কেঁটে গেছে, বরফ দেয়ায় ব্লিডিং বন্ধ হয়েছে। রেখা জিজ্ঞেস করল আমার চশমা কোথায়? লোকটা ওর হাতে চশমা তুলে দেয়। রেখার জ্ঞান ফিরেছে দেখেই রাহাত ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিয়েছে। আপা চোখের সামনে মামাকে মেরে ফেলেছে আমি কিছুই করতে পারলাম না। রাহাত ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। একটু শান্ত হয়ে এলে জিজ্ঞেস করে -পুলিশ খবর দেয়া হয়েছে?
-হ্যাঁ, পুলিশ এবং হাসপাতালকে খবর দেয়া হয়েছে। মামার বডিগার্ডের হাতে গুলি লেগেছে। গুলি খাবার আগে বডিগার্ড ওদের একজনকেও গুলি করেছে?
-তুই কাউকে দেখতে পেয়েছিস?
-না ওরা অ্যানোনিমাস হ্যাকারদের মুখোশ পরা ছিল। বলতে বলতে আবার ডুকরে কেঁদে ওঠে।
কিছুক্ষনের ভেতর পুলিশ চলে আসে। পুলিশের টিমের নেতৃত্বে ওসি রশিদ। রেখাকে দেখেই এগিয়ে আসে:
-ম্যাডাম আপনার কোনো সমস্যা হয়নি তো?
-না আমি ঠিক আছি, আপনি লোকজন সরিয়ে এভিডেন্স গুলো সিকিউর করুন। একজন গুলিবিদ্ধ আছে খোঁজ নিয়ে দেখুন এম্বুলেন্স কত দূর? আর আপনার ড্রাইভার কে বলবেন আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিতে। আমার দ্রুত কম্পিউটার এ বসা প্রয়োজন।
-জ্বি, আচ্ছা।
রেখা এবার রাহাতের দিকে ফেরে:
-ভাইয়া আমার এখনই হোটেলে ফিরতে হবে। তোর নিজেকে একটু সামলে নিতে হবে, আমি খুব শীঘ্রই ফিরে আসবো।
রাহাত তখন ও ফোঁপাচ্ছে, রেখা ওসি সাহেবকে বলে:
-আপনার ড্রাইভারকে ডাকুন। আর একটা কথা এই ছেলেটা মঈন সাহেবের ভাগ্নে, এই মুহূর্তে ওকে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ প্রসেসের ভেতর টানবেন না।
রেখা দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে পুলিশের গাড়িতে উঠে। ড্রাইভারকে দ্রুত চালাতে বলে। ঝড়ের গতিতে গাড়ি চলছে, রেখার অস্থির লাগছে, চোখের সামনে খুন হয়ে গেলো অথচ তার হাতে কোনো প্রমান নেই। অতি অল্প সময়ে হোটেলে পৌঁছায়, কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা রুমে ঢুকে ল্যাপটপ ওপেন করে। রিভার ড্রিম সিটির ক্যামেরা সিস্টেম এ লগ ইন করে, মঈন খানের আশেপাশের ক্যামেরা গুলো ডিটেক্ট করে। অনুমান করে খুনের সময়ের পনের মিনিট পূর্ব হতে ভিডিও ফুটেজ গুলো দেখতে শুরু করে। সব স্বাভাবিক দৃশ্য, বেশ কিছুক্ষন পরে বাড়ির সামনের দিকের একটা ক্যামেরার ফুটেজে দেখল রেখা পুলিশের গাড়িতে উঠছে। দেখেই নিজের খটকা লাগলো ! তাহলে পুলিশের গাড়ী ওই বাড়িতে আসার ফুটেজ কোথায় !! রেখা পুনরায় কয়েকবার ভিডিও টা দেখলো। অস্থির লাগছে, অস্থিরতা কাটাতে সিগারেট ধারালো। সাথে সাথেই রেখা বুঝতে পারলো ক্যামেরা সিস্টেম হ্যাক করা হয়েছে। শহরের সব ক্যামেরা গুলো আইপি ক্যামেরা। হ্যাক করে ক্যামেরা গুলোর লাইভ রেকর্ডিং বন্ধ করেছে ঠিক আগের মুহূর্ত গুলো রি রেকর্ড করিয়েছে। যার কারণে খুনিদের আশা যাওয়ার কোনো ফুটেজ নেই। সব গুলো খুনের ক্ষেত্রেই একই পদ্দ্বতি অবলম্বন করেছে। আজকেও সব নিখুঁত ছিল, শুধু হ্যাকিং সময় ব্যাপ্তি বেশি হওয়ায় পুলিশের গাড়ি আসার দৃশ্য টা বাদ পড়েছে। সেকারণেই রেখার চোখে ধরা পড়েছে।
সিগারেট শেষ করেই রেখা আইজি নুরুল হোসেন সাহেব কে ফোন দেয়। দুটো ডায়াল টোনের সাথে সাথেই নুরুল হোসেন সাহেব ফোন ধরে:
-হ্যাঁ, রেখা বলো।
-আপনি কি জানেন, আজকেও খুন হয়েছে।
-হ্যাঁ জানি, তুমি আহত হয়েছো সেটাও জানি। আমি দ্রুত হোটেলে ডাক্তার পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।
-স্যার ,আমি সেজন্য ফোন করিনি। রিভার ড্রিম সিটির ক্যামেরা সিস্টেম হ্যাক করা হয়েছে, তাই খুনিদের কোনো ফুটেজ নেই। হ্যাকিং এর সময় ভার্চুয়াল আইপি ব্যবহার করেছে। যে কারণে হ্যাকারদের লোকেশন হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মান, নেদারল্যান্ড এবং চীনের শহরগুলিকে।
-কি বলো ! খুনিরা তো চরম এক্সপার্ট। এদের কি খুঁজে পাওয়া সম্ভব?
-আশা করি খুঁজে বের করতে পারবো। প্রয়োজনে আরো এক্সপার্ট এই কাজে নিয়োগ দেব। স্যার, আরো একটা কথা একজন খুনি সম্ভবত গুলিবিদ্ধ হয়েছে, তার মানে খুনিরা শহর ছেড়ে যেতে পারেনি। যদি একটা ঝটিকা অভিযান চালানো যায় তাহলে খুনিরা ধরা পড়লেও পড়তে পারে।
-ব্যবস্থা নিয়েছি। এই ব্যবস্থা আগের খুনগুলোর সাথে সাথেও নেয়া হয়েছিল, কিন্তু কোনো ফলাফল আসেনি। ওখানকার সব বাড়িতে সবসময় লোক থাকেনা। আর বাড়ির মালিকরা সব বিশিষ্ট ব্যক্তি হওয়ায় সহজে সব বাড়ি সার্চ করা সম্ভব হয় না। দেখা যাক এবারে কি হয়! তোমার জন্য ডাক্তার পাঠানোর ব্যবস্থা করছি বলে নুরুল হোসেন সাহেব ফোন রাখে।
নুরুল হোসেন সাহেবের ফোন শেষ করে,রেখা, রাকিব এবং সায়মনকে ফোন করে হ্যাকিং স্টোরি জানায়। হ্যাকারদের লোকেশন ট্র্যাক করার জন্য সর্ব্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে বলে। মিনিট বিশের ভেতর ডাক্তার চলে আসে। মাথার কাঁটা জায়গা ব্যান্ডেজ করে ওষুধ দিয়ে যায়। এতক্ষন উত্তেজনায় মাথার ব্যাথাটা টের পায়নি। এখন মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে, রেখা বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
রেখার পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ধরে টানছে আর ডাকছে নীলু – এই আপা আর কত ঘুমাবি এবার ওঠ। এই আপা ওঠ আমি কলেজে যাব। রেখার ঘুমটা ভেঙে গেলেও উঠতে ইচ্ছে করছে না, নীলুকে বললো যা ব্যাগে টাকা আছে নিয়ে ভাগ, আমাকে জ্বালাস নে। জানালাটা খোলা বোধহয়, সকালের বাতাসে শীত শীত লাগছে। নীলুর আর সারা শব্দ পাচ্ছে না, চাদর টেনে কাত হয়ে শুলো। পক্ষণেই মনে হলো নীলু জগ ভর্তি পানি নিয়ে এসে গায়ে ঢালবে। পায়ের আওয়াজ পেতেই চিৎকার করে উঠলো – পানি ঢালিস না আমি উঠছি।
ঘুম ভেঙে উঠে দেখে কোথাও কেউ নেই। খোলা জানালা দিয়ে সকালের আলো ঢুকছে। বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। স্বপ্নটা আর কিছুক্ষন থাকলে কি ক্ষতি ছিল। নীলুকে অনেক দিন পর স্বপ্নে দেখলো। সম্ভবত রাহাতের বারবার আপা ডাকের কারণেই স্বপ্নটা দেখেছে। বালিশের পাশ থেকে হাতড়ে চশমা খুঁজে পড়ল। রেখা চশমা ছাড়া খুব একটা চোখে দেখতে পায়না। বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।
নীলুর যখন জন্ম হয়, রেখার বয়স তখন ছয়। সেদিন ঝুম বৃষ্টি, হাসপাতালের ভেতর কোলে একটা পুতুল নিয়ে বসে ছিল রেখা। ছোট খালামনি এসে বলল তোর একটা ভাই হয়েছে চল দেখবি। খালামনির সাথে গিয়ে ভাইকে দেখল। রেখার কাছে মনে হয়েছিল কাপড়ে জড়ানো একটা খেলনা, হাত পা নাড়ছে। জোরে জোরে কাঁদছে, কান্না থামছে না কিছুতেই। ভাইকে ধরতে গেলে ওর আঙ্গুল ধরে খেলতে খেলতে নীলুর কান্না থেমে গেছিল। পাঁচদিন পর ভাইকে নিয়ে বাসায় ফিরেছিল, তবে মা ফেরেনি সঙ্গে।
মায়ের মৃত্যুর পর বাবা আর বিয়ে করল না। পারিবারিকভাবে ছোট খালামনির সাথেও বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। বাবা বলল সম্ভব না – ওকে আমি ছোট বোনের চোখে দেখি, তার ওপর বয়েস কত! ওর কি বিয়ের বয়েস হয়েছে? সবে অনার্স পড়ছে। বিয়ের আগ পর্যন্ত ছোট খালা ওদের সাথে ছিল, নীলুর দেখাশুনা করত। মায়ের মৃত্যুর পর বাবার বেশ পরিবর্তন এসেছিল, উড়নচণ্ডী ধরনের লোকটা হঠাৎ ধার্মিক হয়ে গিয়েছিল। নিলুর দিকে খুব একটা খেয়াল ছিল না, যা কিছু কথা হত রেখার সাথে। খুব অল্প বয়েসেই নীলুর দায়িত্ব এসে পড়েছিল রেখার হাতে। রেখারও পুরো পৃথিবী ছিল নীলুকে ঘিরে – ভাই, বোন, সন্তান সব ছিল নীলুর ভেতরে।
দেখতে দেখতে রেখার চোখের সামনে নীলু বড় হয়ে উঠল, একরোখা, জেদি এবং অসম্ভব মেধাবী একটা ছেলে। নিজে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ায়, ভেবেছিল ভাইকে ডাক্তারি পরাবে। কিন্তু সেটা হলনা নীলু চারুকলায় ভর্তি হল। ফিরতি বছর রেখা স্কলারশিপ পেয়ে পি.এইচ.ডি করতে জার্মান চলে গেল। নীলুকে বিমানবন্দরে বিদায় দিতে এসেছিল, নীলুর সাথে সেটাই ছিল শেষ দেখা। জার্মান পৌঁছানোর বছর খানেক পরে রেখা একটা চিঠি পেল।
আপা,
চাইলে তোকে ফোন করতে পারতাম, তুই অনেক কথা বলবি ভেবে ফোন করার চিন্তা বাদ দিলাম। তোর তো অনেক খোঁজাখুঁজি করার প্রবণতা আছে, তাই তোকে ইমেইলও করলাম না। তোর মনে আছে তোকে এক সময় মিস ফেলুদা ডাকতাম।
যাই হোক অল্প কথায় আসল কথা বলি – আমাদের এই বর্তমান সমাজ বাবস্থায় মানুষে মানুষে বিস্তর ব্যবধান। এই সমাজ বাবস্থার একটা পরিবর্তন প্রয়োজন। আর সেই পরিবর্তনের জন্য আমি ভিন্ন পথে পা বাড়ালাম। তুই যখন ফিরবি তখন আমাকে খুঁজে পাবিনা, তাই খোঁজার চেষ্টা করিস না।
বাবাকে এই কথাগুলো বলার সাহস আমার নেই। তাই সেই দায়িত্ব টা আমি তোর উপর ছেড়ে দিলাম। বাবাকে আরও বলিস – আমার সাথে বাবার দূরত্ব থাকলেও আমি বাবাকে খুব ভালোবাসি। ছোটবেলায় শুধু ঈদের দিন নামাজে যাবার সময় আমাকে কোলে নিত, সিঁড়ি থেকে নামানোর জন্য। আমার তখন আনন্দে চোখে জল এসে যেত।
আপা ,ছোটবেলায় আমার খুব আক্ষেপ ছিল – মা ডাকতে না পারার। বড় বেলায় যখন বুঝতে শিখেছি, তখন আমার সব আক্ষেপ মুছে গিয়েছে – কেননা তুই তো আমার সব। তুই আমার সব অভাব পূরণ করে দিয়েছিস। তুই তো ফিস কাঁদুনে, জানি এখন ফোঁস ফোঁস করে কাঁদবি । তাই আর কিছু লিখলাম না।
সবশেষে, আমাকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করিস না। যদিও আমি জানি, তুই আমায় আজন্ম খুঁজে চলবি।
ইতি
নীলু
চিঠি পাবার পরপরই রেখা জার্মান থেকে ফিরে এসেছিল। বাবাকে চিঠি দেখাতে হাওমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলো। তারপর থানা পুলিশ বিজ্ঞাপন, বছরের পর বছর গেলো নীলু কে খুঁজে পেল না।
পুরোনো কথায়, মনের ব্যাথায় রেখার বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। বারান্দা থেকে রুমের ভেতর এসে দেখে হোটেলের ইন্টারকম ফোন বাজছে। ফোন ধরতেই রিসেপসান থেকে জানাল:
-ম্যাডাম আপনার কাছে এক ভদ্র লোক এসেছেন, আপনাকে বলতে বলেছে তিনি রাহাত সাহেবের ড্রাইভার।
-ওনাকে বসতে বল, আমি আসছি।
রেখা রাহাতের জন্য অনুতপ্ত বোধ করে। ছেলেটাকে কাল এত ভয়ংকর পরিস্থিতিতে রেখে আসার পর একবার ফোন করে খোঁজ নেবার সুযোগ হয়নি। ফোন করার জন্য মোবাইল হাতে নিয়েও রেখে দেয়, ভাবে ফোন করার চেয়ে সরাসরি যাওয়া ভাল। দ্রুত পোশাক পরিবর্তন করে। এতক্ষন খেয়াল করেনি, রাতের বেলা পরা পোশাক পাল্টায়নি। পাজামায় রক্তের কালো ছোপ ছোপ দাগ। পুরোনো কাপড়গুলো সোফার উপর ছুঁড়ে ফেলে বেরিয়ে আসে।
নিচে নেমে আসতেই হোটেল লবিতে অপেক্ষা করা ড্রাইভার কে চোখে পরে। ডাক দিতেই লোকটা উঠে আসে। ড্রাইভারের পিছু পিছু গাড়ির কাছে পৌঁছায়, ড্রাইভার দরজা খুলে দেয়। গাড়ির ভেতর ঢুকতেই একটা অন্যরকম গন্ধ টের পায়। এরপর কিছু মনে করতে পারে না।
রেখার যখন জ্ঞান ফিরল, তখন নিজেকে আবিষ্কার করল একটা ছোট কামরার ভেতর। কামরাটা প্রচুর বই পত্রে ঠাসা। তবে দেখলেই বোঝা যায় রুমটা নতুন করা হয়েছে, এখনো রুমের দেয়ালে এখনো রং করা হয়নি। রেখা বুঝতে পারল সে কিডন্যাপ হয়েছে। এই মুহূর্তে বসে আছে একটা এক সিটের সোফায়, উল্টো দিকে একটা মেয়ে বসা। মেয়েটার শুধু চোখ দেখা যাচ্ছে, মুখে সার্জিকাল মাস্ক পড়া। চুলগুলো ছেলেদের মত ছোট ছোট করে কাঁটা, কোমরে পিস্তল। রেখার চোখ খুলেছে দেখে মেয়েটা কথা বলতে শুরু করেছে:
আপনাকে কিডন্যাপ করা হলেও আপনার ভয় পাবার কিছু নেই। আপনাকে আমরা অল্প সময়ের ভেতর ছেড়ে দেব বলেই মেয়েটা উঠে একটা বুক সেলফের লক খুলল। হাতের স্মার্ট ঘড়িতে কয়েকবার আঙ্গুল চালাতেই বুক সেলফটা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে একটা দরজা দেখা গেলো। দরজা খুলে রেখাকে ডাক দেয়, এটা বেইসমেন্টের সিঁড়ি। আপনি বেইসমেন্টে চলে যান, আপনার জন্য সেখানে একজন অপেক্ষা করছে।
রেখা বেইজমেন্টের সিঁড়ি ধরে নেমে চলেছে আর ভাবছে তাকে কেন কিডন্যাপ করেছে! সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নামছে, সিঁড়িতে আলোর স্বল্পতা। বেইজমেন্টেও আলোর স্বল্পতা, বোধহয় বেইজমেন্টে বিদ্যুৎ কানেকশন দেয়া হয়নি। একটা মাত্র লাইট জ্বলছে, সম্ভবত টেবিল ল্যাম্প। আবছা আলোয় দেখতে পেলো বেইজমেন্টের এক কোনায় একটা খাট। খাটের উপর কেউ একজন শুয়ে আছে। চেহারা দেখা যাচ্ছে না, শরীর টা চাদর দিয়ে ঢাকা। রেখা সামনে আগায় না, দাঁড়িয়ে পরে।
হঠাৎ লোকটা কথা বলে ওঠে:
-কি মিস ফেলুদা, অবশেষে কিছু রহস্য উৎঘাটন করে ফেলেছিস?
কণ্ঠ শুনেই রেখার অন্তর কেঁপে ওঠে। মনে হচ্ছে পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে, সমুদ্রের ঢেউয়ের মত চোখের জল বেরিয়ে আসছে চাইছে। এই গলার স্বর তার চেনা, এটা নীলুর কণ্ঠ। এতগুলো বছর পার হলেও একটুও বদলায়নি কণ্ঠ। রেখা দ্রুত পায়ে খাটের কাছে চলে যায়। আবছা আলোতেও নীলুকে চিনতে অসুবিধা হয় না। মুহূর্তেই নীলুর মাথাটা বুকের উপরে রেখে চেপে ধরে শব্দ করে কাঁদতে থাকে। কান্নার ভেতর দিয়ে ঝড়ে পড়তে থাকে বুকের ভেতর জমে থাকা সব অভিমান, সব অভিযোগ, সব আক্ষেপ। নীলুর চোখ দিয়েও চুপচাপ ঝরতে থাকে চোখের জলের ধারা।
-আপা আমার মাথাটা তোর কোলে নিয়ে নে। আমার হাতে খুব ব্যথা পাচ্ছি।
-কেনো, তোর হাতে কি হয়েছে?
-তেমন কিছু না। একটা গুলি লেগেছে কালকে।
রেখা একটু সরে গিয়ে, কি বলছিস !
-যা সত্যি, তাই বলছি। তবে ভয়ের কিছু নেই গুলি বের করা হয়েছে।
-কই দেখি বলে টেবিল ল্যাম্পটা কাছে নিয়ে চাঁদর সরিয়ে দেখে বুকের একটু উপরে ডান হাতের কাছাকাছি ব্যান্ডেজ করা। হাসপাতালে যাস নি কেন? তারমানে এই খুনখারাপি তোরা করছিস?
নীলু হেসে ওঠে, তোর এতক্ষন লাগলো বুঝতে! বলতে বলতে নিজের মাথাটা রেখার কোলের দিকে এগিয়ে দেয়।
রেখা আবার কেঁদে ওঠে, এখন কি হবে রে। সত্যি সত্যি গুলি বেরিয়েছে তো।
-তুই টেনশন নিস না, খুব ভালো ডাক্তার আমার অপারেশন করেছে। যে মেয়েটা তোকে এগিয়ে দিয়ে গেলো, সে একজন ডাক্তার।
রেখা কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়, চুপচাপ নীলুর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে:
-নীলু তুই এতো নিষ্ঠুর কেন! তুই কেমন করে পারলি আমার সমস্ত পৃথিবীটা ধ্বংস করে দিতে!! তোর কি একটুও মায়া হয়নি আমার জন্য।
নীলু চুপচাপ কথা গুলো শুনতে থাকে, মনে মনে বলে তুই কাছে থাকলে হয়তো এতো বড় পদক্ষেপ নিতে পারতাম না। এর মধ্যে সেই মেয়েটা একটা ট্রে তে দুই মগ চা নিয়ে আসে। চায়ের মগ হাতে দিতে দিতে বলে:
-তুমি তো সকালে শুধু চা খাও, তাই না আপা!
-হমম, তুমি জানো কিভাবে?
-শুধু আমি কেন! এখানে আরো অনেকে তোমার সব অভ্যাস জানে। এমনকি তুমি কোন ব্রান্ডের সিগারেট খাও তাও জানে।
রেখা হাসতে হাসতে বলে ওমা তাই নাকি! আমি তো দেখছি এখানে পপুলার! কারা তাঁরা, যারা আমাকে এতো চেনে !
-তারা সবাই তোমার ভাইয়ের ভাই বোন! তুমি পুলিশের লোক তাই তোমার সামনে আসবে না।
চায়ের ট্রে নিয়ে মেয়েটা চলে যায়।
নীলু রেখার কোল থেকে মাথা তুলে খাটে হেলান দিয়ে বসে। রেখা একটা চায়ের মগ নীলুর দিকে বাড়িয়ে ধরে, নীলু বা হাত দিয়ে চায়ের মগ হাতে নেয়। রেখা নীলুর মুখোমুখি বসে চায়ে চুমুক দিয়ে:
-যে সমাজ বদলানোর জন্য আমাকে ছাড়লি, বাবাকে ছাড়লি। এই খুন খারাপি কি সমাজ পরিবর্তন?
-আপা সমাজ ব্যবস্থা কিংবা রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তন এতো সহজ নয়। তবে আমরা যা করছি সেটাও কম নয়, আমরা সমাজের আবর্জনা পরিষ্কার করছি। এটাও খুব প্রয়োজন, তুই হয়তো বলবি এটা আমাদের মনগড়া মত। এক কাজ করিস ফেসবুক, টুইটার অনলাইন নিউজ পোর্টাল গুলোতে পাবলিকের মন্তব্য দেখ। লক্ষ লক্ষ মানুষ আমাদের সমর্থন করছে।
রেখা ভাইরাল সংবাদগুলো না দেখলেও, ওসি রশিদ এর মন্তব্য মনে পরে – এক হিসেবে খুনিরা ভালো কাজই করছে। এই কাজের জন্য ওগো পুরস্কার দেয়া উচিৎ। মনের ভেতর কথাগুলো উঁকি দিলেও রেখা বললো:
-সে তুই যাই বলিস না কেন। খুন খারাপি কখনোই সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে পারে না।
-আপা তোর ভাবনা তোর কাছে থাকুক, আমার হাতে অতোটা সময় নেই। আর মাত্র দশ মিনিট তুই এখানে থাকতে পারবি। শুধুমাত্র আমার জন্য, অনেক রিস্ক নিয়ে তোকে এখানে আনা হয়েছে। জানিনা কখন কি হয়! তাই এই মুহূর্তগুলো তোর কোলে মাথা রেখে থাকতে চাই।
কথাটা শুনেই রেখার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে, মগ টা সরিয়ে রেখে বলে -আয়।
নীলু আগের মতো কোলে মাথা রেখে শোয়। আবারো নীলুর চুলে আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করলো,
-গুলি কবে লেগেছে? কাল? তুই কি জানিস? কাল আমিও ছিলাম ওখানে।
-জানবো না কেন! তোকে আমি ধাক্কা দিয়েছিলাম।
-কি বলিস তুই! অতো জোরে ধাক্কা দিয়েছিস তুই !
তুই কি মানুষ! আমি যদি আঘাত পেয়ে মরে যেতাম, জানিস কতখানি কেটে গেছে।
-আমি মানুষ না, আমি তোর ভাই। ধাক্কা না দিলে বরং তুই মরে যেতিস।
-মানে! কী বলছিস তুই?
-শোন আমি মঈন খানকে পরপর দুটো গুলি করে চোখ ঘোরাতেই দেখি মঈন খানের বডিগার্ড। আমাকে যে কভার করছিল তার দিকে পিস্তল তাক করেছে। আর ঠিক তার সামনেই ছিলি তুই। গুলি ছোড়ার মুহূর্তে তোকে ধাক্কা দেই, তুই পড়ে যেতে যেতে গুলিটা আমার গাঁয়ে লাগে। গুলি খেয়ে ছিটকে পড়ি তোর পায়ের উপর। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে কভার করা ছেলেটা বডিগার্ড কে গুলি করে। ভাগ্যিশ বডিগার্ড বেঁচে আছে, কোনো নিরীহ মানুষ আমাদের টার্গেট নয় আপা।
শুনতে শুনতে রেখার চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পরে নীলুর কপালে।
-কিরে আপা !অকারণ কাঁদছিস কেনো?
-ও তুই বুঝবি না। আচ্ছা তোর কি বাবার কথা মনে পরে না?
নীলু হেসে ওঠে, কেন পড়বে না আপা! আমি যেমন তোর খোঁজ রাখি, তেমনি বাবারও খোঁজ রাখি। ভেবেছি সুস্থ হলে বাবার সাথে দেখা করে আসবো। তবে ভয় হচ্ছে তুই পুলিশের লোক। আবার ধরিয়ে না দিস হা হা হা। রেখাও হেসে ওঠে।
-তুই কি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরবি না?
-কি বলো আপা! আমি তো স্বাভাবিক জীবনেই আছি. পার্থক্য শুধু তোকে প্রতিদিন জ্বালাই না।
কখন সময় পার হয়ে গেছে রেখা টের পায়না। মেয়েটা এসে হাজির হয়:
-আপা তোমার সময় শেষ। রেখা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, বুঝতে পারে যেতে না চাইলেও তাকে চলে যেতে হবে। নীলুর কপালে একটা চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়ায়। আবার রেখার কান্না পাচ্ছে, কান্না জড়ানো গলায় বললো সুস্থ হবার খবর দিস আমাকে! নীলু কোনো কথা বলে না, নিশ্চুপ চেয়ে থাকে রেখার দিকে।
মেয়েটা রেখার দিকে একটা চশমা বাড়িয়ে দেয়।
-তোমার চোখের চশমাটা খুলে ব্যাগে রাখো, আর এই চশমাটা পড়ো।
-এই চশমা কেন?
-এই চশমা আমাদের চোখ বাধার যন্ত্র। চোখে পড়ার পর চশমাটা তোমার মাথায় আমরা লক করে দেব। এই চশমার ভেতর দিয়ে তুমি কিছু দেখতে পারবে না। চশমায় একটা মাইক্রো চিপ লাগানো আছে। তোমাকে নামিয়ে দেবার পর, আমরা চশমাটার লক খুলে দেব। লক খোলার পর চিপটা অটোমেটিক ধ্বংস হয়ে যাবে।
রেখা চশমাটা পড়তে পড়তে বলে- তার মানে তোরা আমায় বিশ্বাস করিস না।
মেয়েটা স্মার্ট ঘড়িতে আঙ্গুল চালায়, সঙ্গে সঙ্গে চশমাটা মাথার পেছন দিকে আটকে যায়। চোখ খোলা থাকলেও চোখ দুটো অন্ধকারে ডুবে যায়। অন্ধকার হাতড়ে শেষ বার নীলুর কাছে যায়। নীলুর মুখে হাত দিয়ে আদর করতে করতে বলে- সুস্থ হলে আমাকে একবার কিডন্যাপ করিস। আজকের মতো নয়, বেশি সময়ের জন্য। কথাগুলো বলছে আর ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নীলুর চোখেও জল এসেছে, ফিসফিসিয়ে বলে আচ্ছা।
রেখা মেয়েটার হাত ধরে এগিয়ে যায়, আস্তে আস্তে গিয়ে গাড়িতে বসে। গাড়িতে উঠে জিজ্ঞেস করে আমাকে কে নিয়ে যাবে এতক্ষন যে বোনটা ছিল সে? নাকি অন্য কেউ?
-আমিই যাবো আপা।
-তাহলে আমাকে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসাও। তোমার ভয়ের কিছু নেই।
রেখাকে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে। রেখার বুকের মাঝখানে চাপ ধরা ব্যথা, মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে কিছু চেপে বসে আছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আশার জন্য মেয়েটার সাথে কথা বলা শুরু করে।
-তোমার সাথে গল্প করলে বিরক্ত হবে না তো?
-না না, কি যে বলোনা আপা!
-তুমি ডাক্তার, তোমাদের ভেতর অনেক মেধাবী প্রোগ্রামার আছে যারা আমাদের সিস্টেম হ্যাক করেছে। এত মেধাবী তোমরা, উজ্জ্বল ভবিষ্যত তোমাদের। তোমরা কিভাবে নীলুদের খপ্পরে পড়লে? কি নির্দ্বিধায় মানুষ খুন করছো?
মেয়েটার কণ্ঠে রাগ, তুমি নীলুদের খপ্পরে বলছো!
ভাইয়ার মত হাজার খানেক নীলু থাকলে দেশ বদলে যেত। আর তুমি ভাবছো আমরা শুধু খুন খারাপি করছি। আমরা কতগুলো সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের স্কুল চালাই জানো! আমরা কতগুলো আরোগ্য সেন্টার চালাই জানো! এসব জায়গায় গেলে বুঝতে আমরা শুধু খুন-খারাবি করিনা। তোমার তো শুধু খুন চোখে পড়েছে, তাহলে খুন নিয়ে বলি। তুমি হায়েনা চেনো তো ! জানো তো হায়েনার কখনো ক্ষুধা মেটেনা। তাই এদের ভেতর কখনো খাবার ভাগ করা যায় না। আমরা যাদের মারছি তারা তো মানুষ নয়, ওরা সব হায়েনা। এরা সমাজে থাকলে সমাজ বদলাবে না। তারপরও হয়তো বলবে খুন। অথচ এই তুমিই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে সন্মান করছো, মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকার আদায়ের লড়াই কে বলছো স্বাধীনতা যুদ্ধ। সেখানেও মানুষ হত্যা হয়েছে। আমরাও খুন করছি না, আমরাও অধিকার আদায়ের লড়াই করছি। সরি আপা, তোমাকে অনেক কথা শুনিয়ে ফেলেছি।
রেখা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে: আমি জানি আমার ভাই খুনি হতে পারে না..
রেখার মন খারাপ কাটিয়ে দিতে বলে: আপা শোনো তোমাকে একটা বুদ্ধি দেই। বুদ্ধি মতো চলতে পারলে কথা দিচ্ছি তোমাকে আমি কিডন্যাপ করে আমাদের কাছে নেবার ব্যবস্থা করব।
রেখা চোখে দেখছে না তবুও ঘুরে তাকায়, বলো বলো আমি কি করবো?
শোনো পাহাড়ি অঞ্চলে আমাদের অনেক গুলো সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের স্কুল আছে। কাগজে কলমে ওগুলো বিদেশি অর্থায়নে চলে। আসলে স্কুল গুলো আমরা চালাই। তুমি তো গোয়েন্দা মানুষ, খুঁজে খুঁজে যদি কোনো স্কুলে পৌঁছাতে পারো তাহলেই হবে। আমি সেখান থেকে কিডন্যাপ করার ব্যবস্থা করবো।
রেখা হতাশ হয়ে বলে তোমরা কোথায় না কোথায় থাকবে । আমি স্কুল খুঁজে পেলেও লাভ হবে না।
হতাশ হইয়ো না, এই মুহূর্তে ভাইয়া আহত। আমাদের গোলাগুলি বন্ধ। আমরা কোনো না কোনো পাহাড়ি অঞ্চলেই থাকবো। আর আমি আমি গোপনে নজর রাখবো তুমি আসছো কিনা।
রেখার মুখে হাসি ফোটে, তোমার নাম কি বোন?
নাম বলা যাবে না আপা, আবার দেখা হলে নাম বলবো। শুধু তাই নয় বোনের আদরও আদায় করে নেবো। কথা শেষ হতে হতে গাড়িটাও থেমে যায়। আপা শোনো এখন তোমাকে নামতে হবে। রেখা দরজায় হাত দিতেই মেয়েটা বলে: একটু সবুর করো কিছু ইন্সট্রাকশন আছে। গাড়ি থেকে নেমে তুমি কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকবে, তিন মিনিটের ভেতর তোমার চশমার লক খুলে যাবে। যেখানে তোমাকে নামানো হচ্ছে সেখান থেকে হোটেলে ফিরতে তোমার পাঁচ মিনিট লাগবে। তবে তুমি দশ মিনিটের ভেতর তোমার রুমে গিয়ে ঢুকবে। তাহলে তোমাকে কিডন্যাপের কোনো দৃশ্য তোমাদের ক্যামেরায় থাকবে না। তোমাকে সকালে বেলায় হোটেল রিসেপশন থেকে যে ফোন দেয়া হয়েছে তাও আমরা করেছিলাম।
রেখা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। কিছুক্ষনের ভিতর চশমার লক খুলে যায়। চশমা খুলতেই আলোর ঝাপটা লাগে চোখে। ব্যাগের ভেতর থেকে নিজের চশমা পরে তাকাতেই দেখতে পায় সামনে লাইট হাউজ। রেখা দ্রুত পায়ে হোটেলের দিকে হাঁটা দেয়। হাটতে হাটতে মনে হয় আজ মাস খানেক ধরে যে তথ্যের অনুসন্ধানে দিন রাত্রি এক করেছিল, আজ সেই সব তথ্য তার মাথার ভেতরে। কিন্তু মস্তিস্ক সেই তথ্য কাউকে শেয়ার করতে চায় না। যক্ষের ধনের মত আগলে রাখতে চায়। এই তথ্য রেখার সুখের অনুভূতি, এই তথ্য রেখার কষ্টের অনুভূতি।
হোটেল রুমে প্রবেশ করেই সোফায় গা এলিয়ে দেয়। হাতে স্পর্শ পায় সকালে ফেলে রাখা পাজামার। পাজামাটা হাতে নেয়, দেখে পাজামায় রক্তের কালো ছোপ ছোপ দাগ। রেখার ভ্রু কুঁচকে যায়, এই রক্তের দাগ নীলুর রক্তের। পাজামাটা গালে ছোয়ায়। রেখার জানা নেই শুকানো রক্তের ঘ্রান থাকে কিনা! তবুও রেখা টের পায় নীলুর শরীরের গন্ধ। রেখা কাঁদছে না তবুও চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সেই চোখের জলে সমাপ্ত হয় রেখার তত্ত্বানুসন্ধান।
সমাপ্ত।
অলংকরণ: আসমা সুলতানা মিতা
Excellent