মহাত্মা আহমদ ছফা’র মৃত্যু বা জন্ম বার্ষিকী এলেই সারা দেশে সাহিত্য দর্শন চর্চাকারীদের তোড়জোড় চলে। চলে আলোচনা সমালোচনা। অনুষ্ঠান বন্দনা ও সাগরেদ বা উপ সাগরেদরা পক্ষে বিপক্ষে একে অপরকে ঘায়েল করার প্রচেষ্টা তো থাকেই।
ছফাকে নিয়ে টানাটানি হেছড়া-হেছড়ি প্রত্যক্ষ সাগরেদগণের রাজনৈতিক ও দার্শনিক বিভক্তি এসবের অন্যতম কারণ। এসব সাগরেদ উপসাগরেদ গণেরা আবার বিভিন্ন সময়ে ছফা’র উদ্ধৃতি বিবৃতিকে পুঁজি করে গোষ্ঠী স্বার্থে সিদ্ধি হাসিলের ফন্দি ফিকির খুব দেখছি ইদানিং। এসব বিরক্তিকর অবস্থা থেকে নিজের আত্মোপলব্ধি টুকু লিখে ছফা স্যারের প্রতি সম্মান টুকু জানাতে চাই।

রণেশ দাশ গুপ্তের সাথে আহমদ ছফা’র কবিতার সম্পর্ক দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত কবিতার সম্মানি চাওয়া নিয়ে একটি ঘটনা সবাই জানেন। ছফা’র কবিতার সম্মানিটা যে রণেশ দাশ গুপ্ত তাঁর বেতনের টাকা থেকে দিতেন, তা ছিলো ছফা’র চাইতে ছফা’র কবিতাকে বেশি ভালোবেসে। উপনিবেশ বুদ্ধিজীবীগণ ছফা’র নাম পরিবর্তন করে সাফা করেছিলেন, নাম পরিবর্তনে ছফা’র প্রতিবাদকে সমর্থন করেছিলেন কিন্তু রণেশ দাশ গুপ্ত।
কথিত ছফা চর্চা কারিগণ তা কি ভুলে গেছেন?না-কি আবুল হাসানের কবিতার মতো তাও রাজনীতি? ছফা আমৃত্যু রাজনীতিরই শিকার।
ছফা চর্চার সাথে কতো অখাদ্য কুখ্যাদ্যের বন্দনা শোনা যায় । কিন্তু রণেশ দাশ গুপ্তের নাম নিলে কারও কারও ঈমান নিয়ে টানাটানি হয় আবার।
আজকাল অনেকেই দেখি ছফা বন্দনা করেন ছফাকে সামগ্রিক ভাবে না মেনে বা না জেনে।দুর্ভাগা বাঙ্গাল কিন্তু নজরুলকেও ভাগ করে।
রবীন্দ্রসঙ্গীত বিরোধী রবীন্দ্রনাথ ঠেকাও আন্দোলনের নেতার সন্তানও আজকাল রবীন্দ্র ভক্তিতে গদগদ। ছফা এসব ভণ্ডামি ধরিয়ে দিয়েছিলেন বলে রবীন্দ্রজীবীদের প্রতি হিংসার শিকার হতে হয়েছিলো আহমদ ছফাকে।
আজকাল অনেককেই দেখা যায় ছফা নাম কীর্তন করে জাতে উঠতে চান। প্রশ্ন হচ্ছে, ছফা কোন জাতের, তাঁর জাতের স্বরুপ কি? উত্তর কিন্তু নাই নাই। তিনি তো বাল্যকালেই মসজিদে তাঁর বাবার প্রশ্রয়ে রামের ভক্তি পদ্য পড়ে শুনিয়েছিলেন মুসল্লিদের। তিনি তো নব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড়ের পর নিজ গ্রামেই ঝড়ে ভেঙে পড়া হিন্দুদের মন্দির নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। সেসব কি তিনি রণেশ দাশ গুপ্তের প্রভাবে করেছিলেন? রণেশ দাশ গুপ্ত তখন কিন্তু বাংলাদেশেই ছিলেন না।
ছফা মানব জাতের একজন খাটি বাঙ্গাল বললে সমস্যা কোথায়? কবি ফররুখ আহমদ কে নিয়ে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, শামসুর রাহমানও লিখেছেন, শুধু ছফাকে নিয়ে লিখেননি। কথিত বাম চোখে তা কিন্তু পড়েনা। অথচ সরকারি প্রতিষ্ঠান ইসলামি ফাউন্ডেশনে ছফা বক্তব্য রাখায় তাকে যারা মুজাহিদ মনে করেন
তারা ভুলে যান ইসলামি ফাউন্ডেশন কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হাতে পুণর্জন্ম লাভ করা প্রতিষ্ঠান। ছফা তো প্রখ্যাত জার্মান কবি গ্যাটে কে অনুবাদ করেছেন, তাহলে তিনি কি হিটলারের জার্মানি হয়ে গিয়েছিলেন? বার্টেন্ড রাসেলসহ আরও অনেক ইহুদি নাসারাদের লেখা অনুবাদ করেছেন, তাহলে তিনি কি ইহুদি নাসারা হয়ে গেছেন?
শল্যবিদেরা যেমন মানুষের কৃমি ঘাটেন তেমনি নজরুল, ছফা’র জাত পাত ধর্ম কুষ্টি না ঘেটে তাঁর সৃষ্টিগুলো নিয়ে হুলুস্থুল টানাটানি করি আমরা, বুঝতে চেষ্টা করি ছফা কোন বিবৃতি কোন প্রেক্ষাপটে দিয়েছিলেন। বুঝতে চেষ্টা করি কোন প্রবন্ধ কোন প্রেক্ষাপটে লিখেছেন।
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির কঠোর সমালোচক আহমদ ছফা কিন্তু আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর উপহার কম্বল পরম শ্রদ্ধায় মমতায় আগলে রেখেছেন। এমন প্রেম কঠিন আওয়ামীদের কাছেও পাওয়া যাবেনা। তাহলে তিনি কি আওয়ামীলীগার হয়ে গেলেন? আহমদ ছফা আওয়ামীলীগ নেতাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে যেমন কঠোর সমালোচনা করেছেন তেমনি তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এক দুই প্যারার মধ্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যা লিখেছেন, তা স্তাবকদের কয়েকটি বই এক জায়গায় এনে তুল্যমূল্যও চলেনা। যেমন রসমলাই, সন্দেস দেখতে যেমন আকারে ছোট, একই ভাবে বাজারে মেলায় পথের ধারে গামলা ভর্তি রসগোল্লা আকারে অনেক বড়, দামও কম। কিন্তু স্বাদ বলা মুশকিল। তিনি তো তার বইতে জিয়ার ক্ষমতা দখলকে ডাকাত সর্দারের সাথে তুলনা করেছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ছফাকে নিজ হাতে রান্না করে খাইয়েছেন তাই বলে ছফা কি আওয়ামী বুদ্ধিজীবী?
অথচ ছফাই শান্তি চুক্তির গলদগুলো ধরিয়ে দিলেন। চুক্তির গলদ না সরানো বা শোধনের ব্যবস্থা না করার কুফল ভোগ করছে রাষ্ট্র ও পাহাড়ি জনজাতি গোষ্ঠি। ছফা জাসদ রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন, তাদের পত্রিকায় লিখতেন, কিন্তু সেই জাসদ নিয়েও তার উপলব্ধির লেখা গুলো পড়েন, পড়ে বা না পড়েই তাঁকে জাসদ ট্যাগ লাগিয়ে দেন, অথচ সেই জাসদ এর একটি সক্রিয় অংশ কিন্তু বর্তমান সরকারের অংশীদার। শুধু ফরহাদ মজহার, সলিমুল্লাহ খান কেন উদাহরণ করেন। হুমায়ুন আহমদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, অসীম সাহা, রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, মুহম্মদ নুরুল হুদাদের কেন নিরাপদ রাখেন? আহমদ ছফা কিন্তু কবির চৌধুরীকে নিয়ে বিজিএস নামে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন কিন্তু ছফা এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের কাছে খুব আদরনীয় ছিলেনও বটে।
৬০-৭০-৮০’র বিশাল একটি তরুণ গোষ্ঠি শিক্ষক হতে পারেন তাহলে তার ক্লাসে বহু শ্রেণী গোষ্ঠির শিক্ষার্থীরা ভিড় করবেই। সেই শিক্ষার্থীরা যে যার শ্রেণী চরিত্র অনুযায়ী তার স্বরূপ প্রকাশ করলে তাতে ছফা’র কি দায়।
বঙ্গবন্ধুর আওয়ামীলীগে যেমন খন্দকার মুশতাক ছিলো ছফা’র ক্লাসেও ফরহাদ মজহার ছিলো। তবে ফরহাদ মজহারের যে মৌলিক সৃষ্টি নাই তা অস্বীকার করবেন কি করে? চানাচুর ছাড়া হুমায়ুন আহমদের আর কি আছে বলেন।
আমরা যারা ছফা’র ক্রান্তিলগ্নে নবীন সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতির নবীন কর্মী সলিমুল্লাহ খানের কারণে ছফা’র সাম্রাজ্যে প্রবেশাধিকার পেতে সহায়ক, তা নয়কি?
আসুন তর্কাতর্কির ভেতর দিয়েই মানুষ ছফাকে দেখি। জাত পাত দেখে নিজের ঠিকুজু যেনো না হারাই।
মানিক বৈরাগী
কবি ও নব্বইয়ের নির্যাতিত ছাত্রনেতা
কক্সবাজার, বাংলাদেশ।