তোমার বদনখানি মলিন হলে । অজয় দাশগুপ্ত

  
    

তখন দেশ স্বাধীন হয়েছিল মাত্র। ৭৩ সালে পূজা দেখতে বেরিয়েছিলাম। সন্ধ্যার পরপর চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকায় দেখি মানুষজন প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছিল। ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। একটু পর একজন লোক ধাক্কা দিয়ে বলল: বাড়ী যাও, দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। দাঙ্গা? তাও সদ্য স্বাধীন দেশে?  কিছু বোঝার আগেই মারমুখি ধর্মান্ধদের মিছিল দেখেই বুঝে গেলাম ভাগতে হবে। ভাগতে ভাগতে দৌড়ে বাড়ি এসে শুনি পূজা বন্ধ। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের চট্টগ্রামে একটি দুটি প্রতিমা বাদে বাকী সবগুলো ছিলো ধড় থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন। সেদিনই আসলে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল এদেশে ধড় থাকবে হিন্দুদের মাথা থাকবে না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুও পারেননি। তাঁকে সময় দেয়া হয়নি সে ষড়যন্ত্র ঠেকানোর।

মুক্তিযুদ্ধের কথিত অসাম্প্রদায়িক গাছে সেদিন দেখলাম সাম্প্রদায়িক বিষফল ধরতে। অধ্যাপক আসহাব উদ্দিনের ভাষায়, চেতনার গাছে ধর্মান্ধতা। যার মানে একটি বছর চুপ মেরে থাকা পাকিস্তানী ভাবধারা আর উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ফিরে আসলো প্রবল বেগে। এটা এখন স্পষ্ট বুঝতে পারি সিগন্যাল দেয়া হয়ে গিয়েছিল তখনই। কিন্তু আমাদের অভিভাবকেরা তাদের দেশাত্মবোধের অজুহাত আর নিরাপদ চাকরি ফেলে যেতে পারেননি। সে না যাওয়ার ফলে বছরের পর বছর আমরা ভুগেছি। অথচ বোকার মতো ভালোবেসে গেছি এই দেশকে। কলেজের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রগতিশীল নামের ছাত্র সংগঠনগুলোকে ভালোবেসে সমর্থন করে ভেবেছিলাম এরা সব পাল্টে দেবে। একদিন দেখলাম কিছু পাল্টায়নি। কেবল সেসব নেতারা পাল্টে গেছে। তাদের পোশাক খাদ্য ব্যবহার এমনকি আমাদের সাথে কথাবার্তা মেলামেশাও গেছে পাল্টে।

একটার পর একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিচ্ছিলাম। লিখিত সব ফলাফলে মেধা তালিকায় নাম আসে। মনে আশা ছিলো এবার এটা হবেই। ব্যংকের চাকরির ভাইভা বোর্ডে জহিরুল ইসলামের চব্বিশতলা দালানের বিশ তলায় তুলে প্রশ্ন করেছিল: ফারাক্কা ব্রিজের গঠনপ্রণালী কেমন? প্রশ্ন ছিলো তালপট্টি দ্বীপ কার? এমন তামাশা এমন অপমানের শিকার বহুবার হবার পরও বোকার মতো আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি গাইতে গাইতে কাঁদতাম। পনের আগষ্ট এলে চোখের পানি বাঁধ মানতো না। যখন কেউ দায় দায়িত্ব নিতে চাইতো না তখন জেলা পরিষদ মিলনায়তনে জাতীয় শোক সভায় পড়েছি মূল প্রবন্ধ। সে অনুষ্ঠানে আমার সাথে যাওয়া প্রিয় বন্ধু অর্ধেক থেকে হল ত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। যে এখন মহামান্যের দরবারে একজন আমলা। সেদিন সে দর্শক আসন থেকে পালিয়া বাঁচলেও আমি ছিলাম গোয়েন্দাদের নজরে। লাভ ?
ক দিন পরেই  আওয়ামী লীগের এক নেতার সাথে বসে ক্রিকেট খেলা দেখার সময় হাসতে হাসতে বলেছিলেন, এরা তো মালাউন এখনই হিন্দুস্থান সাপোর্ট করবে। আসেন পাকিস্তানের জন্য দোয়া করি। বিএনপির সময় ভাবলাম আওয়ামী লীগ বাঁচাবে। আওয়ামী লীগের সময় দেখি আরো খারাপ অবস্থা। এখন শুনি সবাই এক।

তবু মানতে চাইনি যে এদেশ আমার না। আজ অনেক কথাই বলতে ইচ্ছে করছে। প্রথম আলোয় আছেন উচ্চপদে আমার এক বন্ধু সাংবাদিক। তার সাথে আমার সম্পর্ক নাড়ির। তিনি যখন যে কাগজে যেতেন আমার লেখা নিতেন। একটি জনপ্রিয় দৈনিকে কাজ করার সময় একদিন জানালেন সপ্তাহে না পনের দিনে লিখতে হবে। তা হোক। কিন্তু কারণটা শুনে মাথা খারাপ হবার যোগাড়। তখনকার সম্পাদক ছিলেন প্রগতিশীল নামে পরিচিত একজন। সে তিনি নাকি বলে দিয়েছিলেন ঘন ঘন হিন্দু নাম ছাপানোর দরকার নাই। তারপর আরো মজার ব্যাপার ঘটেছিল আরো একটি স্বনামধন্য কাগজে। আবেদ খান চলে আসার পর যাদের বাদ দেয়া হলো তারা সবাই অমুসলিম লেখক।
তবু আমরা লজ্জাহীন। আমি অন্তত চোখের পর্দাহীন এক আহাম্মক। দেশের জন্য কাঁদি। যারা আমায় চেনেন বা জানেন তাদের ভেতর অনেকেই সাবধান করেন, দাদা এতো আবেগের দরকার নাই। আমার ভালো মুসলমান বন্ধুরাও বলেন এ কথা। তারা অনেকেই দেশের ভবিষ্যত সমাজের উদারতা ও শান্তির বিষয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছেন অনেক আগে। কিন্তু আমি এতোদিন পারিনি। কেন পারিনি জানিনা। শুধু মনে হতো আমার বন্ধু তো ওমর কায়সার আমার বন্ধু মাঈনুল হাসান , ইউসুফ মোহাম্মদ আমার বন্ধু ছিলো প্রয়াত শাহিদ আনোয়ার খালিদ আহসান আমার প্রিয় অনুজ রাশেদ র উফ, রাশেদ হাসান আলী হাবিব এরা।

সিডনিতে আমার বন্ধু ড: মনজুর হামিদ কচি আমার অনুজ শামীম, শুভ, হাবিব এরা সবাই তো মুসলমান অথচ আমার আত্মীয়তুল্য।
আমাকে লেখক করে তুলেছেন তোয়াব খান, আবেদ খান, প্রয়াত বজলুর রহমান, রাহাত খান, সন্তোষ গুপ্ত বা মুণিরুজ্জামান। কি করে ভুলে যাই তাঁদের ! এখনো কলকাতা গেলে নিজেকে পরদেশী মনে হয়। এতোবছর সিডনিতে থেকেও স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশ। দেখি সে দেশের শ্যামল মেয়ের মুখ। কিন্তু আজ আর নিজেকে চেনা কেউ মনে হচ্ছে না। পঞ্চাশ বছর পর আজকের বাংলাদেশ দুর্গা প্রতিমার মতো ছিন্নভিন্ন হাতহীন ধড় হীন। দাউ দাউ আগুনে পোড়া হিন্দু নামের মানুষদের পোড়া ভিটামাটি। রামুর উদাস বিষণ্ণ বুদ্ধ দেয়াল উড়ে যাওয়া চার্চের পরাজিত যীশুর মতো বিপন্ন স্বদেশ।
আমি তোমায় ভালোবাসি এ গান গাইতে পারবো আর? সারাজীবন গাইতে হবে: আমি নয়ন জলে ভাসি….

অজয় দাশগুপ্ত
ছড়াকার, কলামিস্ট
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।

বিজ্ঞাপন

 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments