তোর মতোন কেউ নেই

একদিন খুব ভোরে; সুর্য্য তখনো চোখ ডলাডলি করছে; এমন আবছা আলোয় ঘরের বাইরে পা ফেলেই মাহবুব বুঝতে পারলো, আজ তার তেলাপোকা প্রভাত। পায়ের নিচে আলবার্ট ক্যামু’র ‘প্লেগ’ উপন্যাসের সেই ইঁদুরটির মতো তার পায়ের নিচে একটি তেলাপোকা পড়েছে। আর পড়বেই বা না কেন? সেও থাকে একটি নিষিদ্ধ পল্লীর পাশেই এক সস্তা গলিতে। এসব পথের পাঁচালী তো আর কাঠগোলাপের শাদার মায়ায় ভরে থাকে না। তার জন্য ঘরে বাইরে, পূর্ব-পশ্চিমে এতটুকু নিমফুলের গন্ধ কিংবা তিস্তা পাড়ে প্রথম আলো অথবা পদ্মা নদীর মাঝিরা মেঘের ছায়া দেখেনি। জীবন কখনো তার বোন হয় নি। তুচ্ছ বস্তু কিংবা ইতর প্রাণীরও ঈশ্বর থাকে কিন্তু চাঁদের অমাবশ্যায় জোছনা ও জননীর গল্প, জলেশ্বরীর বকুল রঙ্গিন স্টুডিও দূরবীন দিয়েও কোথাও কেউ দেখেনি। যুগান্তরের সেই সময় থেকে সমকাল, শঙ্খনীল কারাগার, নন্দিত নরক, এইসব দিন-রাত্রিই তাঁর উত্তরাধিকার। অচিনপুরে সারা জীবনে কোনো নুরুলদীন, কোনো কালপুরুষ, বাকের ভাই কিংবা অগ্নিপুত্র লন্ঠণ হাতে কালের কন্ঠে ডাক দিয়ে যায়নি। একবার এক রুপবতী রুপা দুর্গেশ নন্দিনী তাকে জিজ্ঞেস করেছিল,
-তুমি কে?
সে আমতা আমতা করে নত মস্তকে কানের কাছে মাথা চুলকাচ্ছিল। কী উত্তর দিবে ভাবতে ভাবতে এপাড়-ওপাড় হাতরে মরেছে। মানবতার মতো শীতের ভৈরব সাঁতরে কোন পাড়ে যাবে, বুঝতে পারেনি। যুৎসই উত্তর আর খুঁজে পায় না। পায়-ই না। যা পাচ্ছিল তা মনে মনে বলছিল- “আমি হতে চেয়েছিলাম পদ্মা, মেঘনা কিংবা যমুনা নদীর মুশায়রা। কিন্তু পারিনি। তবে আমি হয়তো কুলখানি বাড়ির সেই টিউবওয়েলের হাতলধরা কিশোর, যে সকলের পানি খাওয়ার জন্য কল চাবাইতে থাকে, চাবাইতেই থাকে… এক সময় ছাগলের ঠান্ডালাগা কাশির শব্দের মতো শব্দে টিউবওয়েলের বাকেট খুলে গেলে যার মনে পড়ে, সবাইকে পানি খাওয়াতে গিয়ে সে নিজেই পানি খেতে পারেনি। পিপাসা বেড়ে যায় তখন। বহুগুণ।

অথবা সেই কবর-খোদকের মতো অসহায়, যে গ্রামের সকল মুদ্দারের জন্য কবর খনন করে আজীবন কিন্তু তার মায়ের মৃত্যুতে কেউ কবর খুড়তে আসেনি। অথবা কেরানীমারাবৃস্টিতে ভেজা সেই বেকার, যাকে দেখে লোকাল বাসের ড্রাইভার একটু থামে, বাস ধরার জন্য যখন সে দৌঁড় দেয়, বাসের হেল্পার বাসের গায়ে ঠাসঠাস করে থাপ্পর দিয়ে বলে ‘ওস্তাদ আগে ভাড়ান’…পিছন ফিরে তাকিয়ে উপহাস মাখানো হাসি দিয়ে বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে চলে যায়। আমি সেই বেকারের হাঁপাতে হাঁপাতে হতাশ চোখে চেয়ে থাকা বেদনামাখা-ঘনদ্রুতশ্বাস। অথবা সেই ব্যর্থ প্রেমিক দেবদাস, যে মেঘদূত হতে চেয়েছিল। যে তার মনের কথা সাহসের অভাবে কোনো দিন পার্বতীকে বলতেই পারেনি, অথবা সেই অভাগা লক্ষীন্দর, যে বাসর রাতে বেহুলাকে আদর করার আগেই সর্পদংশনে প্রাণ দিয়েছে, কিংবা আমি সেই যুবতীর প্রেমিক, যে আমার আপন ছোট ভাইকে বিয়ে করে আমাকে এখন ভাসুর সম্বোধন করে।̓ শেষমেষ উত্তরগুলো মনমতো না হওয়ায় মাহবুব কিছুই বলবে না ভেবে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে, মেয়েটি কখন জানি সুরঞ্জনা হয়ে চলে গেছে ঐ যুবকের কাছে। মনে মনে মাহবুব শুধু বলেছে,
-আমি কে? তা আমি না জানলেও, আমার মতে, তোর মতোন কেউ নেই।
শাখাওয়াৎ নয়ন
একাডেমিক, প্রাবন্ধিক এবং কথাসাহিত্যিক।
www.facebook.com/shakhawat.nayon