প্রশান্তিকা রিপোর্ট: বাংলাদেশের প্রখ্যাত নজরুল সঙ্গীত ও ক্লাসিকাল শিল্পী সুজিত মুস্তফা তাঁর সঙ্গীত নিয়ে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়া। গত ২১ সেপ্টেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় সিডনিবাসী শ্রোতাদের গান শুনিয়ে মুগ্ধ করলেন শিল্পী সুজিত মুস্তফা। ‘মর্মে মম ধ্বনি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে শিল্পী নজরুল সঙ্গীত, আধুনিক গান ও দর্শকদের অনুরোধে অসংখ্য গান করেন।

শিল্পীকে ফুল দিয়ে মঞ্চে বরণ করে নেয় মাহিকা। অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ছিলেন নাফিসা আসিফ স্বাগতা। স্বাগতা গানের ফাঁকে ফাঁকে চমৎকার ও সাবলীল কথা বলেছেন। অনুষ্ঠানে স্থানীয় শিশু শিল্পীদের পরিবেশনার পাশাপাশি ইন্দ্রাণী মুখার্জী, রাহুল হাসান এবং অমিয়া মতিন সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এছাড়া যন্ত্রে ছিলেন অভিজিৎ দাঁ ও নীলাদ্রী চক্রবর্তী। অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিলেন সঙ্গীত শিল্পী সুজিত মুস্তফার ছেলেবেলার বন্ধু আনিসুর রহমান নান্টু।

শিল্পী প্রথমেই ধরেন নজরুল সঙ্গীত, ‘নয়ন ভরা জল গো তোমার আঁচল ভরা ফুল/ ফুল নেব না অশ্রু নেব ভেবে হই আকুল’। তারপর ‘সুরে ও বাণীর মালা দিয়ে আমারে ছুঁইয়াছিলে’; ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী’;
‘দাঁড়ালে দুয়ারে কে তুমি ভিখিরি’; ‘না না যেওনা’; ‘আজো মধুর বাঁশি বাজে’। শিল্পীর বাবা প্রখ্যাত শিক্ষক, কবি ও গীতিকার আবু হেনা মোস্তফা কামালের গান গেয়েও বাবাকে শ্রদ্ধা জানান। তাঁর বাবার গান ‘তোমার কাজল কেশ ছড়ালো বলে এই রাত এমন মধুর’ গাওয়ার আগে ছোটবেলার এবং শিল্পীর স্ত্রী প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী মুনমুন আহমেদের সঙ্গে তাঁর স্মৃতিকথা শেয়ার করেন। দর্শকদের অনুরোধে শিল্পী বেশ ক’টি গান শোনান। সেগুলোর মধ্য ছিলো মান্না দে’র ‘আমি যে জলসা ঘরে বেলোয়ারী ঝাড়’; মানবেন্দ্র’র ‘আমি এতো যে তোমায় ভালোবেসেছি’; ‘বারে বারে শুধু আঘাত করিয়া যাও’; নজরুলের ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী/ দেবো খোঁপায় তারার ফুল’। দর্শক সাড়িতে বসা প্রখ্যাত শিল্পী সিরাজুস সালেকীনকে উদ্দেশ্য করে শিল্পী মজা করে বলেন, সামনে এতো গুণী দর্শক থাকলে গান করা মুশকিল। শিল্পীর বাবার লেখা এবং মাহমুদুন নবীর গাওয়া ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’ গাওয়ার সময় বলেন, এই গানটি বাংলাদেশের সবচেয়ে রোমান্টিক একটি গান।

পুরো অনুষ্ঠানে তিনি কথা আর গান নিয়ে এগিয়ে গেছেন। মাঝে মাঝে মজাদার কৌতুকও শুনিয়েছেন। প্রায় শুরু থেকেই তবলাবাদক অভিজিৎ দাঁ এবং কীবোর্ডিস্ট নীলাদ্রির বাজনার সঙ্গে শিল্পীর ছন্দ আসে। বিশেষ করে তবলার সঙ্গে শিল্পীর আলাপ উপস্থিত দর্শকেরা খুব উপভোগ করেন। বিরতির আগের শেষ গান ছিলো মান্না দে’র ‘না না যেওনা শাখায় তুমি থাকো’ এবং ‘ব্রজগোপী খেলে হরি হরিরে’ গানটি পরিবেশনার মধ্য দিয়ে তিনি অনুষ্ঠানের সমাপ্তি করেন। বিরতির পর মঞ্চে আসেন সিডনিবাসী শিল্পীর শিষ্য রাহুল হাসান। তিনি ১৩ বছর বয়স থেকে সুজিত মুস্তফার কাছে গান শিখতে শুরু করেন। রাহুল শোনালেন একটি মৌলিক গান। এরপর মঞ্চে আসেন সিডনিবাসী আরেক জনপ্রিয় শিল্পী অমিয়া মতিন। তিনি শোনালেন দুটি নজরুল সঙ্গীতের অংশবিশেষ।

দর্শক প্রতিক্রিয়া:
অনুষ্ঠানের বিরতি এবং শেষে অনেক দর্শকই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। প্রশান্তিকার সঙ্গে আলাপকালে সিডনিতে বাঙ্গালী কমিউনিটির প্রিয় মুখ গামা আব্দুল কাদির বলেন, প্রয়াত কবি, সাহিত্যিক, লেখক এবং শিক্ষাবিদ ছিলেন
আবু হেনা মুস্তাফা কামাল। তাঁর সুযোগ্য সন্তান সুজিত মুস্তফার নজরুলগীতি ও আধুনিক গানের পরিবেশনা ছিল অনবদ্য, মার্জিত এবং রুচিশীল। এই সংগীতের মূর্ছনার রেশ থাকবে
অনেক দিন।
সিডনিবাসী প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সিরাজুস সালেকীন গান চলাকালেই উচ্ছ্বসিত ছিলেন। তাঁর অনুরোধে বেশ ক’টি গান শোনান সুজিত মুস্তফা। গান শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সিরাজুস সালেকীন শিল্পীকে ‘বাঘের বাচ্চা’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। প্রশান্তিকার প্রশ্নের জবাবে সিরাজুস সালেকীন বলেন, সুজিত চমৎকার গেয়েছেন। ওর রাগপ্রধান গানগুলোর কোন তুলনা হয়না।
অনুষ্ঠানের বিরতিতে সুজিত মুস্তফা পরিচিত হন অস্ট্রেলিয়া আওয়ামীলীগের সভাপতি আইনজীবি সিরাজুল হক, উপদেস্টা গামা আব্দুল কাদির, সিডনি প্রেস এন্ড মিডিয়া ক্লাবের সভাপতি রহমত উল্লাহ, প্রশান্তিকা সম্পাদক আতিকুর রহমান শুভ, গানবাকশো রেডিও উপস্থাপক ও সংস্কৃতি কর্মী শুভজিৎ ভৌমিক, আবিদা রুচি প্রমুখের সঙ্গে। তাঁরা সবাই শিল্পীর গানের ভূঁয়শী প্রশংসা করেন।
সিরাজুল হক বলেন, সিডনিতে এরকম শুদ্ধ ধারার সঙ্গীত অনুষ্ঠানের আরও আয়োজন করা উচিত। উপস্থিত সবাই সুজিত মুস্তফাকে আবার আমন্ত্রণ জানিয়ে বড় পরিসরে অনুষ্ঠান আয়োজনের আহবান জানান।
ব্লগার ও ক্রিটিক শুভজিৎ ভৌমিক বলেন, মাত্র তিনটি যন্ত্র দিয়ে অনুষ্ঠান যে সুন্দর করা যায় তার উদাহরণ হিসেবে এই অনুষ্ঠান রয়ে যাবে। কেননা সুজিত মুস্তফার ভয়েসটা ছিলো দারূন সুরেলা এবং স্পষ্ট, তাঁর সাথে অভিজিৎ দাঁ তবলায় এবং কিশোর নীলাদ্রী চক্রবর্তী কীবোর্ডে ভালো বাজিয়েছেন।
সিডনিবাসী শিল্পী পলাশ বসাক অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সুদূর মিটাগং থেকে। প্রশান্তিকার সঙ্গে আলাপকালে পলাশ বললেন, ঢাকায় সুজিত দা’র কাছে গান শিখতেন একসময়। গুরুকে দেখতে এবং তাঁর গান শুনতেই এতো দূর থেকে আসা। গান শুনে তাঁর মন ভরে গেছে বলে পলাশ জানালেন।
স্ত্রী লেখক অনীলা পারভীনকে সঙ্গে নিয়ে অনুষ্ঠানে এসেছিলেন লেখক ও কলামিস্ট ড. শাখাওয়াৎ নয়ন। তিনি বললেন, সুজিত মুস্তফার মতো এতো বড় শিল্পী এসে শহরে গান গাইবেন আর সে অনুষ্ঠানে আসবেন না তা কি করে হয় ! অনীলা পারভীনও তাঁর মুগ্ধতা জানালেন।
মুক্তমঞ্চ পত্রিকার সম্পাদক নোমান শামীম বলেন, সুজিত মুস্তফার অনুষ্ঠানে না এলে সত্যিই বড় মিস হয়ে যেতো। তাঁর কথা ও গানে যেকোন সঙ্গীতপিপাসু মানুষের মন ভরে যাবে।
প্রশান্তিকা সম্পাদক আতিকুর রহমান শুভ একটু ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, দর্শক উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। তবুও আরও কয়েকটা আসন ভরতে পারতো। সুজিত মুস্তফা হলেন ওস্তাদ শিল্পী বা শিল্পীদের শিল্পী। সিডনির অনেক নামকরা শিল্পী বা অনুষ্ঠান সংগঠকেরা এই ওস্তাদ শিল্পীর অনুষ্ঠানে আসেননি। আবার অনেকেই এসেছেন। আপনারা প্রবাসী শিল্পীরা যখন অনুষ্ঠান করেন তখন দর্শক উপস্থিতি নিয়ে অসন্তোষ করেন। অথচ দেশ থেকে সম্মানীত একজন এলেন কিন্তু আপনাদের কেউ কেউ এলেন না, অসম্মান করলেন। সুজিত মুস্তফার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন যারা এসেছিলেন সবাই। আমিও একজন ছিলাম।
সাংবাদিক ও লেখক কাজী সুলতানা শিমি বলেন, বাংলাদেশের ধ্রুপদী শিল্পী সুজিত মুস্তফার পরিবেশনায় মুগ্ধ সিডনিবাসী।

সংস্কৃতি কর্মী ও আড়ং পত্রিকার সম্পাদক এলিজা আজাদ টুম্পা অনুষ্ঠান শেষে এক স্ট্যাটাসে বলেন, “সুজিত মুস্তফা হলেন তিনি, যার রক্তে আছেন প্রয়াত কবি, সাহিত্যিক, লেখক এবং শিক্ষাবিদ আবু হেনা মুস্তাফা কামাল, যিনি কিনা শিল্পীদের ওস্তাদ সেই গুণী ও শ্রদ্ধাভাজন শিল্পীর গান এই সুদূর প্রশান্তপারে বসে শুনতে পাবার সৌভাগ্য আমার হলো আবারো, আমি তাতেই ধন্য। ষাটের দশকের গানসহ অগণিত প্রিয় গানগুলো গেয়ে গেলেন এই গায়ক তাঁর সুরেলা নিরেট গায়কীতে, শুধুমাত্র তবলা হারমোনিয়াম ও একটি কিবোর্ড দিয়েই আর সিডনি দর্শকদের হৃদয়ে গেঁথে দিয়ে গেলেন এক মনোমুগ্ধকর সংগীত সন্ধ্যা যা বাংলাদেশী গুণী সংগীতশিল্পীদের প্রতি আনুগত্য স্বীকারে কিছুটা হলেও উদাহরণ হয়ে থাকবে।
সিডনিতে প্রায় সব অনুষ্ঠানে দেখা যায় তেমন একজন খালেদা কায়সার। তিনিও বান্ধবীদের নিয়ে এসেছেন গান শুনতে। সুজিত মুস্তফার গান শুনে তাদের সবার ভালো লেগেছে।
অনুষ্ঠান শেষে ‘মর্ম মম ধ্বনি’ অনুষ্ঠানটির আয়োজক আনিসুর রহমান নান্টু প্রশান্তিকাকে বললেন, “শিল্পী সুজিত আমার বাল্যবন্ধু, শুধু বন্ধুত্বের জন্যই নয় আমি গর্বিত ওর বড় একটি শিল্পী মনের জন্য। ও যত বড় শিল্পী ততো বড় একজন ভালো মানুষ।”
তিনি আরও বলেন, “অনুষ্ঠানে আসবেন ,টিকেট নিয়েছেন অথচ সেরকম প্রায় পঞ্চাশজন আর আসেননি। অথচ সেই টিকেট অন্যজনকে দিতে পারতাম।”
তিনি তারপরও ধন্যবাদ দেন আগত সঙ্গীতপিপাসু সকল দর্শককে। কেননা অনুষ্ঠানের ভেন্যু ছিলো সিডনির এককোনায় যা বাঙ্গালী অধ্যুসিত সাবার্বগুলো থেকে গড়ে ৫০/৬০ কিলোমিটার দূরে।
শিল্পী সুজিত মুস্তফা পরদিন রোববার ক্যানবেরায় আয়োজিত সঙ্গীত সন্ধ্যায় গান করেন। তিনি ২৫ তারিখ বুধবার ঢাকার উদ্দেশে সিডনি ত্যাগ করেন।