দৃশ্যমান পদ্মা সেতু: স্বপ্ন হলো সত্যি । মিতা চৌধুরী

  
    

আমি বড় হয়েছি গাজীপুরে, কিন্তু আমার পিত্রালয় শরীয়তপুর আর মা’র বাড়ি চাঁদপুর। বহু বছর পর্যন্ত আমার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার সেই কাকৈসার গ্রামে লঞ্চ’ই ছিলো একমাত্র উপায়। আর পদ্মা বা মেঘনা বর্ষায় কতটা উত্তাল আর প্রলংঙ্করি হতে পারে তা শুধু ঐ নদী পথে যাদের যাতায়াত তাঁরাই জানেন।

যদিও আমি নদীর পারের মানুষ কিন্তু সাঁতার না জানায় নদীতে আমার ভীষন ভয়! আমার বড়বেলা ছোটবেলা যতবার আমি শরিয়তপুরে গিয়েছি আমি সারারাত জেগে বসে থাকতাম লঞ্চে। ভয়; যদি ঝড় ওঠে, যদি কিছু হয়, যদি এই যাত্রায় আর জীবিত ফিরতে না পারি। এরকম হাজারো ভয় এসে ভিড় করতো মনে। সারারাত জেগে থাকতাম আর দোয়া ইউনুস পড়তাম তাই।

সর্বশেষ স্প্যান লাগানোর দৃশ্যটি সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

২০০৩/’o৪ সালে একবার গেলাম শরিয়তপুরে বাসে করে, কিন্তু রাস্তার যে করুন দশা তাতে মনে হচ্ছিল জীবন বাজি রেখেই আর আল্লাহর হাতে সব শপে দিয়ে এই যাত্রায় যদি বেঁচে যাই তবে আর কোনদিনও বাসে আসবো না বাড়িতে। একে তো ঘন্টার পর ঘন্টা ফেরীর জন্য অপেক্ষা তার উপর ঢাকা পার করে যে রাস্তা তাতে বড়জোর দু’টো রিক্সা পাশাপাশি চলতে পারে, বাস না। যাইহোক পরে রাস্তা চওড়া হয়েছে কিন্তু পদ্মা তো পার হতেই হবে।

আজ পদ্মা সেতুর সর্বশেষ স্প্যান বসানো হলো! এই পদ্মা সেতু শুধু একটা সেতু নয়, এ ছিলো আমাদের অঞ্চলের জনগনের দীর্ঘদিনের স্বপ্নের একটু একটু করে বাস্তবে পরিণত হওয়া। একটি জনগোষ্ঠির নতুন দাঁড় উন্মোচনের দিন।
সর্বোপরি নিজস্ব অর্থায়নে এতবড় একটি প্রকল্প আলোর মুখ দেখেছে এবং বাস্তবে রুপ নিয়েছে তাই স্বভাবতই এর গুরুত্ব অনন্য।

২০১৪ নালের ৭ ডিসেম্বর শুরু হয় এই ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু, যা দক্ষিণ বঙ্গের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগের আমূল পরিবর্তন আনবে। মার্কিন নকশায় স্টিলের এই দ্বিতল সেতুর উপরের স্তরে আছে চার লেনের সড়ক পথ আর নিচে আছে রেললাইন। এই নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করছে চীনা প্রতিষ্ঠান। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ টি জেলার সঙ্গে স্থাপিত হবে যোগাযোগ, পদ্মা সেতুতে দৈনিক গড়ে চলবে ২৪ হাজার যানবাহন। তবে এই মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে অনেক প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। বিশেষ করে পদ্মার মতো প্রলয়ঙ্করী নদীতে বিশাল আকারের ভিত্তি ও স্প্যান বসানোর কাজটি ছিলো খুবই দুরূহ। এই সেতু নির্মাণের মোট ব্যয় হয় ৳৩০১।৯৯০ বিলিয়ন বা প্রায় ৩.৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার যার পুরোটাই যোগান দেয়া হয়েছে দেশীয় অর্থায়নে। বাংলাদেশের মতো একটি উঠতি অর্থনৈতিক অবকাঠামোর জন্য যা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত সাহসী একটি পদক্ষেপ।

বর্তমানে এই সেতুর প্রায় ৯০% কাজই শেষ হয়েছে। পদ্মার বুকে আজ বসলো মূল সেতুর সর্বশেষ স্প্যান। এখনো বেশ কিছু কাজ বিশেষ করে নদীর দুই পাড়ে সংযোগ বাকি আছে। এই বাকি ১০% কাজ আশা করা যায় আগামী এক বছরের মাঝেই শেষ হবে। সরকার এবং কতৃপক্ষ আশা করছেন আগামী বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগেই সেতুর সম্পূর্ণ কাজ শেষ হবে এবং জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হবে।

এই পদ্মা সেতু নিয়ে বহু কিছুই হয়েছে। সে প্রসঙ্গে আজ আর যাবো না। শুধু বলবো যারা এই পদ্মা সেতু ও তার ভবিষ্যত নিয়ে বা এর বাস্তবায়নের বিষয়ে কুৎসা ও মিথ্যা খবর ছড়িয়েছে, তাদের মুখে ছাই ও গালে সজোড়ে একটা চপেটাঘাত পরেছে আজ। আর এ শুধুই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে, তার দৃঢ় ও দৃপ্ত সংকল্পের কারণে। ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী , আপনি ছিলেন বলেই আজ এটা সম্ভব হলো। বাংলাদেশের ক্রিকেট বিস্ময় সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা পদ্মা সেতুর এই দৃশ্যমানতার খবরে যেমন বলেছেন, “ স্বপ্ন মানুষ ঘুমিয়েই দেখে কিন্তু যে স্বপ্ন মানুষ জেগে জেগে দেখে সে স্বপ্ন তাকে আর ঘুমাতে দেয় না। আজ স্বপ্ন পুরণ হলো।”

শুধু মাশরাফি কেন? দেশের ১৮ কোটি মানুষই আজ বলছে- আজ আমাদের স্বপ্ন পূরণের দিন।

মিতা চৌধুরী
মেলবোর্ন প্রধান, প্রশান্তিকা।
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments