দেশ বিদেশ তোলপাড় করা বিয়েটি -অজয় দাশগুপ্ত

  
    

সত্যিকারের সেলিব্রেটিদের জীবনই এমন। তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ যেমন দেশ কাঁপানো খবর, তেমনি ফের বিয়ে করলেও তা হয় টক অফ দ্যা কান্ট্রি। হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ছিলো ১৩ নবেম্বর। সে দিনই খবরটা ঘটা করা বাজারে আসলো। হুমায়ূন আহমেদ যখন খ্যাতির মধ্য গগণে তখন তিনি কন্যার সম বয়সী শাওনকে বিয়ে করে সমালোচনার মুখে পড়েন। শেষতক তাঁর আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তাকে স্পর্শ করতে না পারলেও এই ঘটনা তাঁকে নিন্দিত করেছিল। মানুষকে খুব একটা দোষ দেয়া যাবে না। তাঁরা তাঁকে সমাজের দেশের রোল মডেল ভেবে বসায় এই বিপত্তি। লেখক কেন মডেল হতে যাবেন? পাশ্চাত্য এমন কি ভারতেও লেখকদের বিবাহিত জীবন নানা ধরণের ওঠা নামায় ভরপুর। সমরেশ বসু থেকে সদ্য প্রয়াতা নবনীতা দেব সেন সবার বিবাহ বিচ্ছেদ ও আবার বিয়ে করার কাহিনী আছে। কিন্তু আমাদের সমাজ এখনো তেমন উন্মুক্ত না। মানুষের মন যে সংস্কার বোধ আর বিশ্বাস তার সাথে সংঘাত তারা মানতে পারে না।

যারা মনে করেন হুমায়ূনের আলোয় আলোকিত বলে গুলতেকিন আলোচিত ও বিখ্যাত তাঁদের সাথে একমত হতে পারি না। কারণ তাঁর ভূমিকা হুমায়ুনের লেখক হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর যে ত্যাগ এবং শেষ পর্যন্ত যে ধৈর্য তার সাথে আদর্শ বাঙালি রমণীর মিল আছে । হয়তো সে কারণেই মানুষ তাঁর জন্য কেঁদেছিল। তার দৃঢ় মনোবল আর সামাজিক বন্ধনে পরিবার প্রীতি ও তখন চোখে পড়েছিল মানুষের। এরপর তিনি নিভৃত জীবন যাপন করলেও কবিতা লিখতেন। পাদ প্রদীপের আলোয় আসার মত প্রচুর কারণ থাকলেও আসেননি। আজ এলেন। এবং দাপটের সাথে এসে বাকী সব খবরকে ম্লান করে দিয়েছেন গুলতেকিন। কিছুই করেননি তিনি। মাত্র নতুন একটি বিয়ে করেছেন।

কেন এই মানুষের ভালোলাগা ভালোবাসা? কলকাতার বন্ধুদের টাইম লাইনও দেখলাম ভেসে যাচ্ছে। গুলতেকিনের প্রতি ভালোবাসায় তারাও একধাপ এগিয়ে। আমার এক কবি বন্ধুর স্ত্রী গত মাসে যাদের বাড়ীতে দাওয়াত খেলাম সেও আজ চমকে দিয়েছে আমাকে। মাত্র এক লাইনে সে লিখেছে, গুলতেকিন আমাদেরকে নতুন পথ দেখিয়ে দিয়েছে। কথাটা শক্তিশালী। এতে এমন মনে করার কারণ নাই ও বিচ্ছেদ কামনা করছে। মূলত অধিকাংশ নারী দেখছে কিছু কিছু বাদ প্রতিবাদ আর সাহশি বা সে নামে মাঠ গরম কিছু লেখালেখি ব্যতীত আসলে কেউই কিছু করে না। গুলতেকিন কোন বিপ্লব করেননি। কোন মহত কাজও না যে তাঁকে স্যালুট দিতে হবে। কিন্তু তাঁকে ঘিরে এই আনন্দ  উপচে পড়ার মূল কারণ তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন যে বয়সে আমাদের দেশের মানুষ মনে করে তাদের জীবন শেষ আর কিছু করার নাই সে বয়সে তিনি ঘর বেঁধেছেন। বয়স শরীর সামাজিকতার ওপরে চলে যাওয়া এই সম্পর্ক হয়তো কেবলই জীবনসঙ্গীর। যে সঙ্গীর হাত ধরে তিনি জীবনের শেষ সময়টুকু পার করবেন আনন্দ ও নির্ভরতায়। আমি এতে প্রতিশোধ দেখিনি। আমার মনে হয়েছে এ এক সবল ও সুন্দর সিদ্বান্ত।
গুলতেকিন খান তাঁর রুচি ও আভিজাত্য বোধের জন্য নন্দিত।হুমায়ূন আহমেদ তাঁকে ছেড়ে যাবার পর তিনি নিজের ভেতর সংসারের ভেতরই গুটিয়ে ছিলেন। জনশ্রুতি এমন, হুমায়ূন আহমেদই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর লেখায়ও আছে মেয়েরা ছেলে ও ভাইয়েরা সবাই ভাবীর দলে।তাঁর মৃত্যুর পর চারদিকে যখন শোক ও বিরহের মাতম তখনো গড়িয়ে পড়া দু ফোঁটা চোখের জলে গুলতেকিন ছিলেন ব্যতিক্রমী ও নান্দনিক।
যে সব মানুষ হুমায়ুনের বিয়ে নিয়ে শোরগোল করতেন, যারা এই কারণে তাঁকে পছন্দ করেন না তাঁরা কি এখন বুঝতে পারবেন, বিয়ে একটি অধিকার।
প্রাপ্ত বয়স্ক দু জন মানুষ তাদের জীবন বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নেবেন সেটা তাঁদের ব্যাপার।
এই যেমন মনে করছি, বিয়ে যতটা তারচেয়ে পরিণত বয়সে একজন জীবনসঙ্গী খুঁজে নিয়েছেন গুলতেকিন। মাঝপথে নয় গোধূলির সোনালী আভায় সামাজিক বৈধতায় বিয়ের নামে জীবনসঙ্গী খুঁজে নেয়া তাঁকে অভিবাদন।
নীরবে অনেকেই এভাবে প্রতিবাদ করেন। উচ্চকিতরা যখন সোচ্চার তখন গুলতেকিনই পারেন নীরবতাকে রঙিন করতে।
স্বীকারে লজ্জা নাই, অকারণে একটু খারাপও লাগছে বৈ কি। মনোহারিণী এমন কেউ কারো না হওয়া অবধি আমার আমার মনে হওয়াটা কি খুব দোষের?
শুভ জীবন গুলতেকিন। আপনার বাকী জীবন নান্দনিক ও সুখময় হোক। হয়তো হুমায়ূন  আহমেদও আপনাকে বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অদৃশ্যলোক থেকে। বলছেন: ভালো থেকো। সুখে থেকো।

অজয় দাশগুপ্ত
কবি, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
সিডনি,অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments