মেয়েটার কান্না শুনেছিলেন? নিজের সম্ভ্রম রক্ষার্থে কি আকুল আর্তনাদে ভেঙে পড়ছিল বার বার! কিভাবে প্রতিটা মুহূর্তে নিজের শরীর ঢাকবার ক্লান্তিহীন চেষ্টা করছিলো, নিজের গোপনাঙ্গ রক্ষা করবার কি আপ্রাণ প্রচেষ্টা। ভুক্তভোগী নারী পুলিশকে বলেছেন- ‘ওরা অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু আমি সম্ভ্রমটুকু রক্ষা করতে পেরেছি’। জান প্রাণ দিয়ে রক্ষা করেছেন যা উনার কাছে জীবনের চেয়ে মূল্যবান ছিল। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ভুক্তভোগী এ যাত্রা উনার সম্ভ্রম বাঁচাতে পেরেছেন, কিন্তু উনার ট্রমাটা চিন্তা করেছেন? কোন অংশেই কম নয় সেই ট্রমা। সারাজীবনের জন্য মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন উনি। কর্তৃপক্ষ উনার মানসিক চিকিৎসার দায়িত্ব নেবেন, এটাই প্রত্যাশা।
আমার সারাদিনের ব্যস্ততার ফাঁকে শুনতে পাচ্ছি সেই হৃদয় বিদারক চিৎকার। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই মুহূর্তের ছবি। মেনে নেয়া যায়না, চুপ করে থাকা যায় না। কিন্তু কি করতে পারি আমরা ? প্রতিবাদ করা ছাড়া বা অপরাধীদের যোগ্য শাস্তি চাওয়া ছাড়া আর কি কিছুই করার নেই?
এই ধরণের পাশবিক অত্যাচারের ভিডিও আমরা এর আগেও দেখেছি কিন্তু কারণ জানতে পারিনি শুধুমাত্র পৈশাচিক আনন্দ নেয়া ছাড়া। এবারের ভিডিওর কারণ জানা গেছে। এটা দিয়ে তারা ভুক্তভুগীকে ব্ল্যাকমেইল করতে চেয়েছে, আর সেটাতে সফল হতে না পেরেই ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়াতে ছেড়ে ভাইরাল করেছে। কিন্তু ঘটনা কি শুধু এখানেই শেষ, নাকি আরও কিছু জানবার আছে আমাদের?
মনে রাখতে হবে এরা সবাই মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। তাই এরা আমাদের মতো চিন্তা করতে শেখেনি। ওরা দেখতে শুনতে আমাদের মতো হলেই আমাদের মতো চিন্তা করতে পারেনা। তাই নিজের মতো করে এদের চিন্তা ভাবনার বিচার করলে আমরা বিশাল বড় ভুল করবো? ওদের নিয়ে অনেক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে আমাদের। কতোটুকু জানি আমরা ওদের সম্বন্ধে? পরিবার, সমাজ, শিক্ষা কিংবা অশিক্ষা, এসবের বাইরে ওরা একেকজন আসলে কারা? আরও অনেক বেশী গভীরে যেয়ে জানতে হবে, ওরা কিভাবে জীবন দেখতে শিখেছে এরা এবং কেন? কোথায় ভুল ছিল? নিজে থেকে জেনে যাওয়ার অভ্যাসটা ছাড়তে হবে এবং “ এই দেশের কিছুই হবে না “ বলে সব কাজ বন্ধ করে হাত গুঁটিয়ে বসে থাকলেও চলবে না। আরও জোরেশোরে, আটঘাট বেঁধে নামতে হবে।
সিলেটের সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে জনৈকের মেয়েকে দীর্ঘদিন ধরে শামীম নামের এক যুবক তার মেয়েকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে আসছে। বিষয়টি তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যকে জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি। উল্টো গুতগাও গ্রামের শামীম, লিটন, লিয়াকত, আক্কাইসহ কয়েকজন মেয়ের বাবাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে মেয়েকে উত্যক্ত ও ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদ করায় তাকে রড দিয়ে পিটিয়ে আহত করে। এখানে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে, আইন শৃঙ্খলার ফাঁক রয়েছে, সাহায্য চেয়েও না পাওয়া গেলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে? আর এই ধরণের অপরাধীরা যদি জেনেই যায় তাদের আইন কিছুই করতে পারবে না তাহলে ওরা তো তাদের পাশবিকতার কোন সীমানাই চিন্তা করবার প্রয়োজন মনে করবে না।
উত্তর প্রদেশের হাথরাসে গণধর্ষণের তদন্ত ধামা চাপা দেওয়ার অভিযোগ এসেছে, ১৯ বছরের দলিত তরুণীর গণধর্ষণের মতো এতো বড় ন্যাক্কারজনক একটা অপরাধের অপরাধীরাও সমাজের উঁচু স্থানের দাপট দেখিয়ে আইন ফাঁকি দেবার চেষ্টা করছে। এইযে আইন ফাঁকি দেবার এই সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে এরা বার বার, এদেরকে থামানো তো কঠিন হবেই।
২০১৮ ‘র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একটা রিপোর্টে জানা যায় “নারী শিশু নির্যাতনের ৯৭% মামলায় সাজা হয়না” । সবাই একবাক্যে এটাকেই মুল কারণ হিশেবে চিহ্নিত করছে এখন। কারণ মানুষের ভেতরে শাস্তির ভয় না থাকলে মানুষ তো অপরাধ করবেই। এটাতে কোন সন্দেহই নেই। কিন্তু আরও একটু তলিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। এরা এমন বিকৃত মানসিকতার হচ্ছে কেন?
শাস্তির পাশাপাশি এসব নিয়েও ভাবতে হবেঃ
১/ এদের কি পারিবারিক কোনো অবস্থান থেকে এমন একটি মানসিক বিপর্যয় ঘটলো কিনা
২/ অথবা ছোট বেলার কোন ঘটনা থেকে অবচেতন মনে ধরেই নিলো এটাই স্বাভাবিক (বাবাকে দেখেছে মায়ের সাথে বা অন্য কারো সাথে এমন ব্যবহার করতে)
৩/ অথবা শেখানোই হয়েছে যে যৌনকামনা মেটানোর এটাই স্বাভাবিক উপায়।
৪/ কিংবা নিজেরাই ছোটবেলায় কোনভাবে অ্যাবিউসড হয়েছে কিনা ।
নীচে বেশ কয়েকটি পরিসংখ্যান দেয়া হলো যেটা অ্যামেরিকাতে গবেষণা করে বের করা হয়েছে (রবার্ট ডারহাম, ডেভেলপমেন্টাল এক্সপেরিনেন্সেস অফ চাইল্ড সেক্সচুয়াল অ্যাবিউসারস অ্যান্ড রেপিস্টস, ২০১৩)। খুব সহজেই বুঝা যাচ্ছে এদের ছোট বেলার বেড়ে ওঠার সাথে ধর্ষণ করা বা সেক্সচুয়ালি আবিউস করা কতো বেশী জড়িত।
• সালিভান , বীচ, ক্রেইগ এবং গ্যানন এর মতে, যেসব মানুষকে সেক্সচুয়ালি আবিউসড করা অপরাধে মানসিক চিকিৎসার জন্যে পাঠানো হয়েছে, তাদের মধ্যে ৫৫% থেকে ৬০% মানুষই ছোট বেলায় নিজেরাই সেক্সচুয়ালি আবিউসড হয়েছিল। ডেভারসা এবং নাইট বলেছেন, অতীত থেকে বর্তমান এরা সরাসরি শিকার থেকে শিকারিতে পরিণত হয়েছে।
• সিমন্স, ওয়ারটেলে এবং ডারহাম (২০০৮) বলেছেন, যৌন শোষণের ফলে পরবর্তীতে বাচ্চাদের ওপরে যে প্রভাব পড়ে, দিনের পর দিন সেটা সহ্য করে যাওয়ার চাইতে, এসবের কারণ খুঁজে বের করা অত্যন্ত জরুরী।
• ডারহাম, ওয়ারটেল, সিমন্স (২০০৮ ) বলেছেন, যাদের দ্বারা শিশু যৌননির্যাতন হয়, তাদের মধ্যে,
* ৭৩% ছোট বেলায় সেক্সচুয়ালি আবিউসড হয়েছে।
* ৬৫% এর হয়েছে পর্নোগ্রাফি দেখে ,
* অল্প বয়স থেকে হস্ত মৈথুন করেছে ৬০% ।
* একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ৬৮% ধর্ষকরা ছোটবেলায় শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছে, অন্য দিকে শিশু যৌন নির্যাতনকারীরা ছোট বেলায় সেক্সচুয়ালি আবিউসড হয়েছে।
* প্যারেন্টাল ভাইওলেন্স ৭৮% ,
* ইমোশনাল আবিউসড ৭০% এবং
* পশুর সাথে নিষ্ঠুরতা ৬৮% ।
* ধর্ষক এবং শিশু যৌন নির্যাতনকারীদের মধ্যে ৯৩% প্রচণ্ড ভাইওলেন্সের মধ্যে বেড়ে উঠেছে।
* ৯৪% বলেছে বাবা মায়ের সাথে ইন্সিকুরড অ্যাটাচমেন্ট
* ৭৬% বলেছে এড়িয়ে যাওয়া বাবা মা, এটাও একধরণের ইন্সিকুরড অ্যাটাচমেন্ট
* ৬২% বাচ্চারা উদ্বিগ্ন পিতামাতার অ্যাটাচমেন্টে বেড়ে উঠেছে হয়তো ভাবছেন, এগুলো পশ্চিমা দেশের পরিসংখ্যান, এগুলো দিয়ে আমরা কি করবো?
এটার উত্তর হলো, এগুলো থেকে ধারণা করে নেবো, এগুলো থেকে শিখবো, কি ধরণের পরিসংখ্যান নিলে আমরা একটা অবস্থানে দাঁড়াতে পারবো, যেখানে দাঁড়িয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারি, কি করা উচিৎ? ওপরের পরিসংখ্যান থেকে অ্যাবিউসের ধরনগুলো দেখে খুব সহজেই অনুধাবন করা যায় আমাদের দেশেও এ ধরণের অ্যাবিউস হয় শুধু আমরা হয়তো অ্যাবিউস হিশেবে গণ্য করি না। কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে অথবা এনজিও’র সমাজসেবীদের মাধ্যমে এইসব তথ্য বের করা সম্ভব। ক্রিমিনাল সাইকোলজিস্টরাও প্রত্যেক ধর্ষকের সাথে কথা বলে তাদের ব্যবহারের একটা নমুনা বুঝে নিতে পারেন। তারপর সেই অনুসারে একটি তালিকা তৈরি করতে পারেন কি কি কারণে একজন মানুষ ধর্ষকে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশের গবেষণার ফলাফল ভিন্ন হতে পারে। আমাদের অবাক করে দিয়ে নতুন কিছু জানবার সুযোগ আসতে পারে যেটা পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য অত্যন্ত উপকারী হবে।
এই ধরণের তথ্য জানতে পারলে সেই অনুযায়ী ভবিষ্যতের পদক্ষেপ নিতে সুবিধা হবে। প্রয়োজনে ছোট বেলায় এদের চিকিৎসা করে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন দেয়া যেতে পারে। শিশুদের বেড়ে ওঠার সময় কেমন পারিবারিক বন্ধন এবং পরিবেশ হওয়া উচিৎ সেটা বুঝে নিয়ে তারও একটা প্রতিকার করা সম্ভব। এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সামাজিক সচেতনতাবোধ বাড়াবার জন্য ব্যাপক প্রচারকার্য চালানো যেতে পারে। এখন যেহেতু পুরো দেশ ভুক্তভোগী, এখন এটা আর লুকিয়ে রাখবার বিষয় না, লুকোবার প্রয়োজনও নেই। সবাই জানুক, শিখুক এবং সচেতন হোক।
শিল্পী রহমান : গল্পকার, কবি, সংস্কৃতিকর্মী, কাউন্সেলর ও গবেষক। ধর্ষণ ধর্ষক ও প্রতিকার গ্রন্থের লেখক।
ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া।