বাংলাদেশ জুড়ে বেশ কিছুকাল ধরে চলছে ধর্ষণের উৎসব। নারী জীবন নিরাপত্তার অভাবে আজ অতীতের চাইতেও অনেক বেশী পরিমাণে অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে বসেছে। সভ্যতা-বিবর্জিত এক ধরণের ছাত্র-তরুণী বীভৎস ধর্ষণ লীলায় মেতে উঠে দেশটাকে রসাতলে নিয়ে যেতে উদ্যত। অপরাধীরা কোথাও ধরা পড়ছে-কোথাও পড়ছে না। কোন কোন ধর্ষিতা বা তার অভিভাবকেরা মামলা দায়ের করছেন-কিন্তু বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অনেকে মামলা-মোকর্দমা করতে নানা কারণে এগিয়ে আসছে না। সমাজের তথাকথিত মাতব্বরেরা বহুক্ষেত্রেই কার্য্যত: অপরাধীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে তথাকথিত আপোষের প্রস্তাব নিয়ে ধর্ষিতার পরিবারের কাছে হাজির হচ্ছেন। সরল বিশ্বাসে এবং কোট-কাচারী থানার বিড়ম্বনা এড়াতে তাতে রাজীও হচ্ছেন অনেকেই। এই ধরণের আপোষের প্রস্তাবে রাজী হয়ে কেউ সুবিচার পাচ্ছেন এমন বিপোর্ট চোখে পড়তে আজও দেখিনি। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই মেয়েটিকেই দায়ী করে তাকে প্রহার করা, সমাজ থেকে ঐ পরিবারকে বহিস্কার করে একঘরে রাখা, কোন কোন ক্ষেত্রে ছেলেটিকে সামান্য কিছু জরিমানার রায় দেওয়া হচ্ছে। এমন সালিশ এর নেপথ্য উদ্যোক্তা সাধারণত: ঐ এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বর, কোথাও বা শিক্ষক, আবার অবশ্যই যাঁরা থাকেন তাঁদের, পরিচিতি জানানো হয় এলাকার মসজিদের ইমাম প্রভৃতি। রায়ে জরিমানায় যে টাকা ধার্য্য করা হয়-তা কখনও মেয়ে পক্ষ পেয়েছেন বা পাচ্ছেন বলে তেমন একটা শুনিনি। সেগুলি পকেটস্থ হয় শালিশকারী চেয়ারম্যান, মেম্বর, শিক্ষক ও ইমাম সাহেবদেরই প্রধানত:। তাঁরাই পরামর্শ দিয়ে থাকেন এমন ঘটনা নিয়ে।
আবার অনেকক্ষেত্রে ধর্ষিতা মেয়েটির ডাক্তারী পরীক্ষায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক আসামী পক্ষের টাকা খেয়ে ভূয়া রিপোর্ট দিয়ে মামলার সর্বনাশ ঘটান। মেয়েটিকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় তুলে যখন তাঁরা তাঁকে জেরা করেন তখন এমন সব প্রশ্ন করেন যার দ্বারা মেয়েটিকেই দায়ী প্রতিপন্ন করার জন্য “তোমার বয়স কত”? “ছেলেটিকে তো আগে থেকেই চিনতে-, এক সাথে মাঝে মধ্যে এদিক সেদিক বেড়াতেও যেতে, বাড়ী থেকে একলা বের হয়েছিলে কেন, তোমার পোষাক কেমন ছিল-টাইট না লুজ” প্রভৃতি প্রশ্ন উদ্দেশ্যমূলকভাবেই করা হয়।
রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, লুটপাট
তদুপরি সর্বাধিক আপত্তিকর বিষয় হলো ঐ ধর্ষকেরা দিব্যি রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে থাকে। ফলে সারাদেশ জুড়ে ধর্ষণের অসহ্য উৎসব বেপরোয়াভাবে চলছে কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই ঐ ঘৃণ্য অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে-ততোধিক কম ক্ষেত্রে অপরপাধীদের শাস্তি হচ্ছে।
একটি জনপ্রিয় এবং বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক গত ২৮ সেপ্টেম্বরের সংখ্যায় লালকালিতে চার কলামব্যাপী “উৎকণ্ঠা বেপরোয়া ধর্ষণে” শিরোনামে প্রকাশিত খবরে জানিয়েছেঃ “এম সি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনার মূল হোতা ছাত্রলীগ ক্যাডার সাইফুর রহমান ও শেখ মাহবুবুর রহমান ছিল মূর্তিমান আতংক। শিক্ষক, সাধারণ শিক্ষার্থী, নিজদলের কর্মী ও কলেজের পার্শ্ববর্তী টিলাগড় এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছে ত্রাস ছিল তারা। হোটেল সুপারের বাংলো খুলে জুয়ার আসর বসাত তারা। ইভটিজিং ও নির্য্যাতনের শিকার হয়ে কলেজ ছেড়ে চলে গেছেন অনেক ছাত্রী।
ক্যাম্পাসে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, কলেজে বেড়াতে আসা তরুণীদের ধর্ষণ করা ছিল তাদের নৈমিত্তিক কাজ। ক্যাম্পাসে আধিপত্য থকায়( আওয়ামী লীগের) বড় ভাইদের কাছেও বিশেষ কদর ছিলো তাদের।
এম সি কলেজের ছাত্রাবাসকে কেন্দ্র করে সাইফুর ও রনি তাদের টর্চার সেল গড়ে তোলে। হোষ্টেল সুপারের বাংলো দখল করে থাকত সাইফুল। ভয়ে অন্যত্র থাকতেন হোষ্টেল সুপার জামাল উদ্দিন। হোষ্টেলের নতুন ভবনের ২০৫ নম্বর কক্ষ ও বাংলোয় সাইফুরের নেতৃত্বে বসানো হয় ‘শিলং তীর জুয়ার আসর’। এ ছাড়া প্রতিদিন রাত্রে বসতো মাদক সেবনের আসর। করোনা পরিস্থিতির কারণে হোষ্টেল বন্ধ থাকায় নিজ খলে থাকা হোষ্টেল রুমকে মাক সেবন ও ইয়াবা ব্যবসার আখড়ায় পরিণত করে সাইফুর।
২০১৩ সালে কলেজে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির সময় চাঁদাবাজি শুরু করে সাইফুর ও তার সহযোগিরা। এতে বাধা দেওয়ায় নিজ লেরই কর্মী ছরুল ইসলামের বুকে ছুরিকাঘাত করে সাইফুর। গুরুতর আহত ছদরুলকে সিলেট থেকে যাওয়া হয় ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে। পরে গ্রুপের নেতাদের চাপে ছদরুল বাধ্য হয় মামলা আপোষ করতে। কলেজ সূত্র জানায়, কলেজে মেয়েদের প্রেমের প্রস্তাব দিতো শেখ মাহবুবুর রহমান রনি। জোর করে সে ছাত্রীদের মোবাইল নম্বর নিত। প্রেমের প্রস্তাবে রাজী না হলে সে প্রকাশ্যে তাদের লাঞ্ছিত করতো। রনির নির্য্যাতনের শিকার হয়ে অনেক ছাত্রী কলেজ ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। প্রেমের প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় প্রায় আড়াই বছর আগে ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে ছুরিকাঘাতও করে রনি। গ্রুপের শীর্ষ নেতা আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট রনজিত সরকার ও মুরারী চাঁদ কলেজের ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ কর্তা নাজমুল ইসলামের আশীর্বাদ থাকায় ক্যাম্পাসের ভিতরে ও বাহিরে বেপরোয়া ছিল সাইফুর ও রনি। শাহ রনি ও তার সহযোগি ধর্ষণ মামলার অন্যতম আসামী তারেক নিজেদেরকে অনেক সময় র্যাব-পুলিশ বলেও পরিচয় দিত বলেও অভিযোগ রয়েছে। র্যাব ও পুলিশ পরিচয় দিয়ে রাস্তা থেকে লোকজন অপহরণ করে ছাত্রাবাসে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া সাইফুর ও রনি চক্রের হাতে ক্যাম্পাসে একাধিকবার সাংবাদিক নির্য্যাতনের ঘটনাও ঘটে।
এই বিবরণ পড়ে জানা গেল সিলেটের বহুপুরাতন এবং নামকরা কলেজে আওয়ামী লীগের নেতাদের কারও কারও সমর্থন ও সহযোগিতায় কী ভয়ানক ত্রাসের রাজত্বই না গড়ে তুলেছিল ছাত্র লীগের দুর্ধর্ষ ক্যাডাররা। বিস্ময়কর হলেও যে সত্যটি উঠে এলো এডভোকেট রনজিত সরকার ও অপর একজন আওয়ামী লীগ নেতার নাম (দ্বিতীয় জন আইনজীবি নন)। ঐ ধর্ষক ক্যাডাররে পৃষ্ঠপোষক। আশা করবো বাংলাদেশ বার কাউন্সিল প্রয়োজনীয় তদন্ত করে স্থায়ীভাবে তাঁর ওকালতির সনদ প্রত্যাহার করে নেবেন-সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতিও তাঁকে বহিস্কার করে চিরতরে তাঁর আইনজীবী সনদ বাতিলের সুপারিশ করে বার কাউন্সিলকে পাঠাবেন।
পুলিশ ঐ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করতে পারায় অবশ্যই সন্তোষ প্রকাশ করছি। আর দাবী জানাচ্ছি ঐ অপরাধীরে গ্রেফতার ক্ষান্ত না দিয়ে তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার অভিযোগে এডভোকেট রনজিত সরকার ও নাজমুল সহ সকল অপরাধীকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে আসামী করা হোক। নইলে এ জাতীয় ঘটনার মূলোৎপাটন করা যাবে না কোন দিনই। আওয়ামী লীগের জেলা ও কেন্দ্রীয় সর্বোচ্চ নেতারা এ কাজে পুলিশকে সহযোগিতা করবেন এমন বিশ্বাস রাখতে চাই যদিও এ ব্যাপারে ঘটনা পরম্পরায় আদৌ আশাবাদী নই।
ইতোপূর্বে বলেছি সমগ্র বাংলাদেশে আজ ধর্ষণের মহোৎসব শুরু হয়েছে। খাগড়াছড়িতে আদিবাসী নারী ধর্ষণ, রাজশাহীতে খৃষ্টীয় গীর্জার ফাদার কর্তৃক নারী ধর্ষণের কাহিনীও অতি সাম্প্রতিক। কিন্তু এগুলি ছাড়াও আরও অসংখ্য ধর্ষণ ঘটনা সারা দেশে ঘটে চলেছে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে কোন মামলা দায়ের না হওয়াতে দেশবাসী সুনির্দিষ্টভাবে জানতে পারছেন না।
প্রশ্ন জাগে যখন দেখি, ধর্ষণে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ, ব্যাংকের টাকা লুটপাটে আওয়ামী লীগ, ফরিদপুরের আওয়ামী লীগ নেতা ৩০০ কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করে অবৈধভাবে তার মধ্যেকার ২০০ শত কোটি টাকা দিব্যি বিদেশে পাচার করে দেন, যখন যুবলীগ নেতাদেরকে ক্যাসিনো কান্ডে জড়িত হতে দেখি, যখন পাপিয়াদের মত মহিলাদেরকে যুব মহিলা লীগে জেলা নেতৃত্বের আসনে অবস্থান করতে দেখি, বহুক্ষেত্রে জেলাগুলিতেও প্রথমে হিন্দুবাড়ী ও তাদের জমিজমা দখল করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারেকে দেখি, যখন দেখি মন্দির-মসজিদ গীর্জা ভাঙ্গার ও প্রতিমাসহ একাধিক মন্দির ভাংচুর বা তাতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটা সত্বেও সরকার কোন অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা না দিয়ে পরোক্ষে প্রশ্রয় দেন, ২০০১ সালে দেশের দক্ষিনাঞ্চলে সংঘটিত হাজার হাজার সাম্প্রায়িক সহিংসতার ঘটনা, ধর্ষণ অপহরণসহ নানাবিধ নির্য্যাতন করা সত্বেও এবং এগুলির ব্যাপারে বছর কয়েক আগে এই সরকার গঠিত তদন্ত কমিশন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিশদ বিবরণসহ মামলা করার সুপরিশ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা সত্বেও কোন মামলায় কাউকে বিন্দুমাত্র শাস্তি দেওয়া হয় না-তখন একজন মুক্তিযোদ্ধা ভাষা-সৈনিক, প্রগতিশীল রাজনীতিক এবং একজন সাংবাদিক ও সচেতন নাগরিক হয়ে কি করে বিষয়টাকে একজন মন্ত্রীর মত হালকা সুরে বলবো “ধর্ষণ পৃথিবীর সব দেশেই হয়” এবং সে কারণে প্রচ্ছন্ন ইংগিতে বলবো যে, তাহলে বাংলাদেশে তা হবে না কেন?
এ পরিস্থিতি অসহ্য। তাই এ ব্যবস্থার বদল ঘটাতে সমাজ বিপ্লবই একমাত্র পথ।
রণেশ মৈত্র
কলামিস্ট, রাজনীতিক
একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক।