ধারাবাহিক উপন্যাস মাতাল শিশু (৭ম পর্ব) – মোয়াজ্জেম আজিম

  
    

মাতাল শিশু

মোয়াজ্জেম আজিম

সপ্তম পর্ব:
কয়েকদিন পর ডাক্তারের কথামতো আমরা গেলাম সেই প্রাক্তন ডাক্তার বর্তমানে কৃষক সুফী মানুষটির কাছে। উনাকে দেখে কিন্তু আমার কৃষকও মনে হয়নি, ডাক্তারও মনে হয়নি।  মনে হলো উনি কিছুইনা টাইপের একজন মানুষ। আমি কিন্তু আশা করেছিলাম তিনি একজন সাদা ধবধবা চুলদাড়িওয়ালা লোক হবে। সাদা পাঞ্জাবী-পায়জামা পরা থাকবে। কোথাও কোনো ময়লার চিহ্ন থাকবে না। ওমা দেখি উনি লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে আমাদের সামনে বসা! ডাক্তারকে কখনও লুঙ্গি পরতে দেখি নাই। অবশ্য উনি এখন কৃষক হয়ে গেছে তাই হয়তো লুঙ্গিও পরা শুরু করেছে। উনার চেম্বারে কোনো এসিস্টটেন্ট নাই, নাই কোনো যন্ত্রপাতি। মানুষের হাড়গোড়, কংকাল, এমনকি ডাক্তারদের চেম্বারে যেসব শিরা-উপশিরার ছবি, মগজের কেলেন্ডার থাকে তার কিছুই নাই উনার চেম্বারে। উনাকে আর ডাক্তার বলা মনে হয় ঠিক হচ্ছে না। উনি অবশ্য মাকে আসতে মানা করেছে বারবার। বলেছে, কেন আসবেন। আমার খুব একটা কিছু করার নাই। তার চেয়ে তালুকদারের কাছে যাচ্ছেন, যান। যা বলে পালন করে দেখুন কোনো লাভ হয় কিনা। অনেক চাপাচাপির পর উনি শেষ পর্যন্ত মার কাছে হার মানলো এবং আসার অনুমতি দিলো। উনি এসেই মাকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই আমার সাথে কথা বলা শুরু করে দিলো। আমি তো একেবারে তাজ্জব। এই লোক তো সাধারণ লোক না রে ভাই!
বলে, কী মিয়া, কোনো সমস্যা হচ্ছে? তোমার নাম কী?
আমি কোনো কথা বলি না।
-কথা বলতে পারো?
-জ্বী।
-তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছ বলে খুশী খুশী লাগে?
-জ্বী।
-তুমি কি একটা শব্দই পারো?
-জ্বী।
উনি একটু হাসলেন। বললেন, খুব নার্ভাস লাগছে, না?
-জ্বী।
-ওষুধপত্র খাচ্ছ ঠিকমত?
-জ্বী।
-গুডম্যান।
এরই মধ্যে উনি আমার হাতপা একটু টেপাটেপি করলেন। সব ডাক্তারই হাতপা টেপে, চোখ উল্টে দেখে, জিহবা দেখাতে বলে। উনিও তাই করলেন। যাক অন্তত এখানে ডাক্তারদের সাথে উনার মিল পাওয়া গেল। এখন উনাকে আমার ডাক্তারই মনে হচ্ছে। মা বসে আছে চুপচাপ। মা সারাক্ষণ কেমন যেন ভয়ে ভয়ে থাকে। যদি কোনো ডাক্তার বলে ছেলে ভালো হয়ে যাবে, তখন চেহারায় একটা প্রশান্তির প্রলেপ অল্প সময়ের জন্যে হলেও খেলে যায়। আর যদি কেউ বলে যে এই রোগের কোনো চিকিৎসা নাই তাহলে মার মুখ ঢেকে যায় দোযখের ধোঁয়ায়। আজ মনে হয় মা একটু বেশী ভয় পাচ্ছে। কেননা আমার কেন যেন মনে হচ্ছে লোকটা বেশী মিথ্যা বলবে না। মাও হয়তো সেরকমই ধারণা করছে। বলবেই বা কেন? উনি তো আর কোনো খোঁয়াড় তৈরী করে রাখেনি যে রোগী আসলেই আটকাবে! কাজেই উনার মিথ্যা বলার কোনো দায়-দরকার নাই। আর সত্যি কথা খুব কমই মানুষের আত্মস্থ করতে পারে, স্বপ্ন দেখাতে পারে। এটা এরই মধ্যে আমার বোঝা হয়ে গেছে। মার নিশ্চয় আরও আগেই হয়েছে। যদিও মার ব্যাপারটা আমার এখনও ভালো বোঝা হয়ে উঠেনি। মাকে যতই দেখি ততই ধন্ধ লাগে। মহিলা পূর্ণবয়স্ক তো? মাঝে মাঝে কেমন যেন আমার চাইতেও বেশী শিশুর মতো আচরণ করে। কেঁদে বুক ভাসায় আমি মরে যাব বলে। কিন্তু কখন মরে যাব তার তো কোনো ঠিকঠিকানা নাই! সন্তানের জন্যে মার এই ভালবাসা পাগলামীর নামান্তর। অবশ্য সব ধরনের ভালাবাসাই মনে হয় পাগলামীর নামান্তর। যে যা-কিছু ভালবাসে পাগলের মতো ভালবাসে। পাগলের মতো ভালবাসা আমার ভাল্লাগেনা। হঠাৎ করে উনি মার সঙ্গে কথা বলা শুরু করে। আমি আমার চিন্তা বাদ দিয়ে উনার কথায় মনোযোগ দিই।
-মাগো! আপনি আমার মেয়ের বয়সী তাই মা সম্বোধন করলাম। কিছুু মনে করবেন না। আজকাল মেয়েছেলেরা ভাই-ব্রাদার শুনতে পছন্দ করে। আর আমরা পছন্দ করি মা-বাপ বলতে। যাই হোক, যা বলার জন্যে বা বলা যায় যা শোনার জন্যে আপনি এখানে এসেছেন। তালুকদার নিশ্চয় আপনাকে বলেছে যে আমি এখন আর ট্রাডিশনাল ডাক্তারী বলতে যা বোঝায় তা করি না। তাই বলে কবিরাজিও করি না। যা করতে চাইতাম আমার ডাক্তারী জীবনের শেষের দিকে, বা যা করার স্বপ্ন দেখতাম তা হলো রোগের কারণ নির্ণয় করে সমূলে বিনাশ করা। আর তা করতে গিয়ে ডাক্তারী পেশায় আর টিকতে পারলাম না। সমস্ত ক্লিনিক, হাসপাতাল, রিসার্চ ইনস্টিটিউড, মেডিকেল কলেজ সবাই আমাকে বয়কট করতে শুরু করলো। সবাই বুঝে গেছে যে আমি উনাদের ভাত মারতে আসছি। ডাক্তারীবিদ্যা আসলে মানুষের উপকারের জন্যে না। বিদ্যা মানুষের প্রথমত রুটি রোজগারের উপায়, তারপর বিলাসিতার উপায়। আর তা রোগীর জীবনের বিনিময়ে আসে। যে কোনো বিদ্যাই সাধারণের জন্যে তৈরী করে গেঁড়াকল, আর বিদ্যাশীলের জন্যে তৈরী করে অপার সম্ভাবনার স্বর্ণখনি। একজন তার বিদ্যার বদৌলতে চুষে খাচ্ছে হাজার জনকে। মাগো, এই গল্পের কোনো শেষ নাই।
আপনার ছেলের সমস্ত রিপোর্ট তালুকদার আমাকে পাঠিয়েছে। আমি দেখলাম। তালুকদার আমাকে বলেছে আপনার ছেলের ভালোর জন্যে সে প্রায় সবকিছুই করছে। এখন এক ওষুধ কোম্পানীর সাথেও চুক্তি হয়েছে সব ধরনের সহযোগিতার। চিকিৎসা যা চলছে চলুক। তার ব্যাপারে আমার কোনো মন্তব্য নাই। তালুকদার এই সময়ের একজন বিখ্যাত ব্যস্ত ডাক্তার। আমি যতটুকু বুঝি তাতে তার কোনো সময় নাই রোগীর কথা শোনার। আপনার কথা সে শুনেছে। আপনার ছেলেকে নিয়ে সে প্রচুর পড়াশোনা করছে। কিভাবে ছেলেটার ভালো করা যায় তা নিয়ে সে গভীরভাবে চিন্তিত। ব্যাপারটা আমার কাছেও ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। ওর মতো টাকার নেশায় মশগুল কোনো ডাক্তারের পক্ষে এতকিছু ভাবা সম্ভব না। তারপরও বলা তো যায় না মানুষ চেঞ্জ হয়। সেও হয়তো টাকার নেশা থেকে বাইর হয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। বয়স হচ্ছে, হয়তো বুঝতে পারছে টাকা ওকে খুব বেশী কিছু দিতে পারবে না, কিছু অসুস্থ প্লেজার ছাড়া। হয়তো বুঝতে পারছে প্লেজার এবং পানিশমেন্ট দুইটা এক সাথে থাকে। তবে নিশ্চিত করে কিছু বলার নাই। ওরা যে কোন কারণে কী করে তা বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে।

অলংকরণ: আসমা সুলতানা মিতা।

তবে আমার পরামর্শ যদি চান তাহলে বলব, যা কিছু জীবনে ঘটে মেনে নিয়ে বাঁচতে শিখুন। আমার মনে হয় আপনার ছেলে ঠিকই আছে। অসুখ যেটা আছে তার কোনো সর্টকাট চিকিৎসা আমার জানা নাই। আপনার ছেলের অসুখের কারণ নিহিত আছে সমাজে। চিকিৎসা না, সমাজের এই সমস্যা নির্মূলই কেবল ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ স্বাভাবিক করে বাঁচতে দিতে পারে। আমি কখনও সমাজতন্ত্রী ছিলাম না। এখনও রাজনীতির সাথে কোনোভাবেই যুক্ত হতে পারি নাই। চেষ্টা করেছি, কেউ যেহেতু আমার সাথে একমত হতে পারে না আমিও তাদের সাথে যুক্ত হতে পারি না। কিন্তু কার্ল মার্কসের পূঁজির সাথে আমি একমত। পূঁজি যতদিন বুর্জোয়াদের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত না হবে ততদিন দুনিয়ায় শান্তির কোন সম্ভাবনা নাই। আর একটা কথার সাথে একমত সেটা হলো প্লেটোর দার্শনিক রাজা। এই দুয়ের মিলনে হয়তোবা মানব কল্যাণের জন্যে কিছু একটা হতে পারে। ইফ উ কান্ট স্টপ প্রোফিট মেকিং এক্টিভিটিস, ইউ কান্ট এস্টাবলিস্ট এনি হিউমেনেটারিয়ান স্টেট। বুদ্ধিমান প্রাণী যদি বিড়াল-বিলাসী হয় সে অন্যেরটা চুরি করবেই। আমি এখানে বিড়াল-বিলাসী মানে বিড়ালের মতো আরামপ্রিয় মানুষের কথা বলছি। তো যা বলছিলাম ছেলেকে তার স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে দিন। সে আর-দশটা বাচ্চার মতোই খেলবে, দুষ্টামি করবে, স্কুলে যাবে, বন্ধুবান্ধব হবে। ওর বয়েস তাড়াতাড়ি বাড়ছে তো ক্ষতি কী? ও তো সবকিছু কোআপও করছে তাড়াতাড়ি। ওকে স্কুলে দেন দেখবেন অন্য ছেলেরা যেখানে এক বৎসর সময় নেয় এক ক্লাসের জন্যে সেখানে সে নেবে এক মাস। ছেলে তো খুবই ইন্টেলিজেন্ট। আমরা কি ডিরোজিওর কথা ভুলে গেছি। মাত্র নয় বছর বয়সে সে এন্ট্রান্স পাশ করেছিল। সতেরোতে হিন্দু কলেজের শিক্ষক। বাইশে মারা গেল সারা ভারতবর্ষ কাঁপিয়ে। বড় পীর আব্দুর কাদির জিলানীর কথাও তো আমরা সবাই জানি। আপনার ছেলেও না হয় আর-একজন সেইরকম বিরল প্রতিভার অধিকারী। অসুবিধা কোথায়?
ছেলের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। দেখেন কোনো স্কুলে দিতে পারেন কিনা। না পারলে বাসায় পড়ান। অন্য বাচ্চা বা বয়স্ক মানুষের সাথে ওকে মিশতে দিন। দুনিয়াটা দেখুক, বুঝুক। কতদিন বাঁচলেন তার চাইতেও কিভাবে বাঁচলেন সেটাই বড় কথা।
মা আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ আমাকে নিয়ে বের হয়ে এলো। আমি কিছ্ইু বুঝতে পারলাম না, উনি খুশী হলো, না বেজার হলো।
চলবে।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments