একেক সময় মনে হয় এ যেন আমাদের এক মিনি জন্মভূমি। আমি যখন ২৩ বছর আগে এদেশে অভিভাসন নিয়ে আসি কালে ভদ্রে দু’ একটা বাংলা অনুষ্ঠান আর বাঙালির অনুষ্ঠান; এই ছিলো আমাদের অবলম্বন। এখন সে বাস্তবতা নাই। সিডনি জুড়ে বাংলাদেশের উদ্ভাস আর পরিচয় প্রকাশ্য।
সম্প্রতি এসেছিলেন সিনেমা ও নাটকের দুই তারকা। তারা বর্তমান বাংলাদেশ ও প্রজন্মের প্রতিনিধি। পরিচালক নির্দেশক মুস্তফা সরয়ার ফারুকী আর অভিনেত্রী তিশা। ফারুকী একসময় সংবাদপত্রে ছিলেন। নানা পথ পেরিয়ে তিনি এখন প্রতিষ্ঠিত একজন নাট্য নির্মাতা ও পরিচালক। ছোট পর্দা ছেড়ে বড় পর্দায় আসার পর তাঁর কাজগুলো বড় হবে এটাই স্বাভাবিক। এখন তিনি ভারতের ইরফান খান নেওয়াজ উদ্দীন সিদ্দিকীদের সাথেও কাজ করছেন। ডুব নামের যে ছবিটি রিলিজ হবার বিতর্ক আর আলোড়ন তুলেছিল তার মূল আধার ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। যেহেতু এটা কোন বায়োপিক ছিলোনা তাই পরিচালকের স্বাধীনতা ভোগ করেছেন ফারুকীL ফলে ছবির কাহিনী নিয়ে তর্ক করা যাবে না। আর যাই হোক আমি দেখেছি সিডনির হলভরা দর্শক। টিকেটের জন্য হাহাকার। দেখেছি তারুন্যের ভেতর সিনেমা দেখার আগ্রহ। সে আগ্রহ প্রমান করেছে আমরা যে মৌলবাদ আর অন্ধ সমাজের ভয়ে ভীত তার জানালা খুলতে ফারুকীর মত পরিচালকের প্রয়োজন। কিন্তু আমরাতো এমন এক জাতি কাউকে বিশেষ সম্মান বা মর্যাদা দেয়াটা কে মনে করি অপরাধ।
তর্ক বিতর্কের ঊর্ধে কেউ থাকতে পারে না। ফারুকীর বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ভাষা বিকৃতির। আমি অবশ্য গোড়া থেকে এ বিষয়ে একটু কনফিউজড। যদিও নাটকে অপ্রমিত বাংলার প্রচলন আমাদের তারুণ্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে । তাদের মুখের ভাষা পাল্টে গেছে। কিন্তু এটাতো মানতে হবে সেটা নিশ্চয় কথ্য ভাষার শক্তি। তার সে শক্তি আছে বলেই সে তা পেরেছে। আমার কনফিউশনের কারণ ছিলো ভাষা আর ডায়লেক্টের তফাৎ। কারণ ফারুকী নিজেও যখন কথা বলেন তখন কিন্তু প্রমিত বাংলাতেই বলেন। আর তাঁর সিনেমাগুলো ক্রমেই প্রমিত বাংলায় ফিরে যাচ্ছে। যা বলা যায় কিন্তু লেখা যায় না তা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে কিন্তু হতাশ আর ক্রোধী হবার কারণ দেখি না। ফারুকী সিডনির অনুষ্ঠানে এ নিয়ে তাঁর মত বলেছেন। যার সাথে একমত না হলেও আমাদের মানতে হবে ফারুকীর মত পরিচালকদের কাছে জাতির প্রত্যাশা বাড়ছে। এবার তার সিডনি আসার কারণ সিডনি ফিল্ম ফেষ্টিভ্যালে সদ্য নির্মিত ছবি শনিবারের বিকেল। ছবিটি বাংলাদেশে এখনো সেন্সরবোর্ডের কাঁচি মুক্ত হতে পারেনি। ছবিটির কাহিনী মর্মস্পশী। সংবেদনশীল আর স্পর্শকাতরও বটে। গুলশানের হলি আর্টিজানের ঘটনা আর যাই হোক কলংকের এক ভয়ংকর অধ্যায়। সে করুণ কাহিনী নিয়ে সিনেমা বানানো একদিকে যেমন সাহসের পরিচায়ক আরেকদিকে সাবধানতার। সরকারী চোখ নিশ্চিতভাবেই দেশের ভাবমূর্তির দিকে। আর মানুষের চোখ খোলা। তাই মুক্তমন উদার সমাজ আর চেতনা ও বোধের কারনেই ছবিটি আলোর মুখ দেখা দরকার। কারণ এখন আর অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। দেশে না চললেও সিডনিতে বাঙালি বিদেশী সবাই দেখে নিয়েছে এই ছবি। ছায়াছবিটি নিয়ে খোদ অষ্ট্রেলিয়ানদের মতামত কিন্তু পজেটিভ। জঙ্গীবাদকে নির্মোহভাবে তুলে ধরে দেশ ও সমাজকে মুক্ত রাখতে বিনোদনের বিকল্প কোথায়? তাহলে আমাদের বিবেক কি বলে?
মুক্ত হোক শনিবারের বিকেল।
সিডনির আড্ডায় ফারুকী ও তিশা। ছবি স্বত্ব: পথ প্রোডাকশন্স ও দেশী ইভেন্টস।
বলছিলাম বাংলাদেশের গৌরবের কথা। এই প্রজন্ম আমাদের পরবর্তী এরা আমাদের চাইতে অনেক এগিয়ে। তাই আমাদের সীমাবদ্ধ মন ও মনন অনেক সময় তাদের অনেক কিছু নিতে পারে না। ফারুকীরা এখন বাংলা ইংরেজী মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ভাষায় কথা বলেন। তাদের জন্ম স্বাধীন বাংলাদেশে। আমরা পরাধীন দেশে জন্মেছিলাম বলে আমাদের মেরুদন্ডে সমস্যা আছে। তাদের কেন তা থাকবে? তারা তাই ক্রিকেটারের মতো বা সফল আর কারো মত মাথা উঁচু করে কথা বলেন। তাদের জানার পরিধিও বড়। আমার ধারণা আমাদের বয়সীদের বরং সীমার বাইরে পা রাখা উচিৎ। কান পেতে শোনা দরকার নবীন প্রজন্ম কি বলছে কেন বলছে।
সিডনির সন্ধ্যাটিতে হলভর্তি দর্শক শ্রোতার মন ভরিয়েছে ফারুকী আর তিশা। তাদের বিনয় আর ভালোবাসা স্পর্শ করেছে প্রবাসী মানুষের মন। সিডনির তারুণ্যের গর্বিত সংগঠন পথ প্রডাকশন আর দেশী ইভেন্টস’র কল্যানে আমরা তাদের সঙ্গ পেয়েছি। বুঝতে পেরেছি কোথায় দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বিনোদন জগত। প্রভাতফেরী নামের পত্রিকা ছিলো এ কাজের পৃষ্ঠপোষক। যা প্রমাণ করে পৃষ্ঠপোষকতার জন্য এখন বাঙালিরাই যথেষ্ট। জয় বাংলার এই এক শক্তি। দেশ স্বাধীন হবার পর আমরা যেসব হতাশা আর সন্দেহে ভুগতাম রাজনীতি যেসব ঝামেলা আমাদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে দুর্বল করে তুলেছিল সেগুলো এখন আস্তে আস্তে অদৃশ্য প্রায়। নতুন এই বাংলাদেশ যেন অন্য এক আশার প্রতীক।
ফারুকী ও তিশার সাথে কথা বলছেন শাকিব ইফতিখার। ছবি কৃতজ্ঞতা: পথ প্রোডাকশন্স ও দেশী ইভেন্টস।
এ দুই তারকা বিশেষত নায়িকা অভিনেত্রী তিশার বিনয়খচিত আচরণ ছিলো চোখে পড়ার মতো। আকাশ সংস্কৃতির কল্যাণে এখন যদি আপনি মিডিয়ায় চোখ রাখেন দেখবেন এদের ভক্ত ফলোয়ার আর দর্শকের সংখ্যা দুনিয়ার বহু দেশ এমনকি অষ্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যার চাইতেও বেশী। সে গর্বের ধারক কেউ যখন ডাউন টু আর্থ বা মাটির কাছাকছি থাকেন তখন বোঝা যায়মাটিতে পা আকশে মাথা তোলা এদের দিকে ফিরে তাকাতেই হবে আমাদের। সিডনির পথ প্রডাকশন, দেশী ইভেন্টস ডট কমকে সাধুবাদ এমন আয়োজনের জন্য। প্রভাতফেরী পত্রিকার সৌজন্য আর আনুকূল্যে সিডনির সংস্কৃতিপরায়ন মানুষ অনুষ্ঠানটি উপভোগ করতে পেরেছে। কিছু বাহুল্যতো ছিলোই। আমরা সবসময় অতিকথনে ক্লান্ত। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তারপরও এমন আয়োজন সুযোগ করে দেয় জানার জানানোর। বিদেশের সাথে দেশের মেলবন্ধন হয় প্রগাঢ়।
আগেই লিখেছি প্রায়ই আমরা চমকে উঠি বাংলাদেশের নানা উজ্জ্বলতায়। আমাদের রাজনীতি যে বিষয়গুলো দিয়ে আমাদের মনে কালো মেঘের ছায়া তৈরী করে শিল্প সংস্কৃতি খেলা বা অন্য কোন একটা বিষয় তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দেখিয়ে দেয় দেশ কতটা এগুচ্ছে। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে নিয়ে যত তর্ক থাকুক না কেন দেশ বিদেশে তিনি বাঙালি তারুণ্যের জন্য আইকন। বরং তাঁকে সেভাবে দেশের কাজে লাগাতে পারাটাই হবে দরকারী। এই যে তিনি বললেন যদি একজনকে নিয়েও বায়োপিক বানাতে হয় তো তিনি তা বানাবেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। আর কেন তা করতে পারবেন না সেটাও বলেছেন সবিস্তারে। সেখানেই আছে না বলা কথা আর ভাবার তাগিদ।
বাংলাদেশের গৌরব ও সম্মানের অনিবার্য এক পীঠভূমি সিডনি এখন এমন সব তারকা ও বাঙালির পদভারে জমজমাট।