খাইরুল কবির চৌধুরীঃ এইযে এতসব ব্যস্ততা, এত আয়োজন, এতসব ক্লান্ত উৎসুক মুখ — এসব দেখে আমরা বুঝতে পারি আমাদের নগরীতে কিছু একটা ধেয়ে আসছে। আর্ট কলেজের সামনে আল্পনা, অন্দরে কল্পনার হাতি ঘোড়া চোখ পাকিয়ে হাসে।
ক্লান্ত ও ঘর্মাক্ত দুপুর। এমন নিস্তরঙ্গ বেলাতেও দোয়েল চত্বর যেন পাখির উচ্ছ্বাসে ডানা মেলছে। পসরা সাজিয়ে বসেছে যারা তারা কলসি কিংবা হাঁড়ির খবর বলতে এসেছে, খুচরা ও বাহারি মিষ্টান্ন কড়া রোদে জেগে উঠেছে। এত মাথা, এত পা, এত ধ্বনি, এত হাতের ভিড়েও একটি সমগ্র তালপাতার সেপাই সবেগে হাত-পা নাড়িয়ে কি যেন বলছে। বোঝা যায় এতক্ষণে হাঁড়ির খবর। বৈশাখ আসছে। আজ নয় কাল। এত প্রস্তুতি, এত মহড়া, এত শব্দ, এত রং, এত সাড়া — শুধু রমনার বটমূলে গান বেজে উঠল না। আজ তাই সংক্রান্তি — চৈত্রের শেষ দুপুর। কাল আমাদের নগরীতে বৈশাখ আসছে।
আমরা ভাবি কিভাবে আসে, কিভাবে আসবে, কিভাবে আসল?
বৈশাখ মাসের প্রথম দিন বাংলা নববর্ষ। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশে ১৪ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এই দিনটি ১৫ই এপ্রিল।
অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সন চালু করেন।
মুঘলরা ভারতবর্ষের শাসনক্ষমতায় এলে আরবি “হিজরি” সন অনুযায়ী রাজ্য পরিচালনা করতে শুরু করেন। কিন্তু এটি চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে করে কৃষকদের খাজনা দিতে অসুবিধায় পড়তে হয়। মূলত এই অসুবিধা দূর করার জন্যেই বাংলা সনের প্রবর্তন হয়। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ই নভেম্বর অর্থাৎ আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় থেকে। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। নতুন সনটি প্রথমে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল, পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়।
নবর্ষের উৎসব মূলত গ্রামীণ জীবনের সঙ্গেই জড়িত ছিল। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের পরে এটি আমাদের নাগরিক ও জাতীয় জীবনে নতুন তাৎপর্য লাভ করে। ১৯৬৭ সালের পূর্বে এখানে আয়োজন করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা ছিল না। তখন পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্রসঙ্গীত ও বাঙালি সংস্কৃতির চর্চার বিরোধিতার প্রতিবাদে বৈশাখের প্রথম দিনে ছায়ানট রমনার পাকুড়মূলে নববর্ষ পালনের আয়োজন করে। ছায়ানটের শিল্পীরা সমবেত কন্ঠে রবিন্দ্রনাথের ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটি পরিবেশন করেন। সেই থেকে ঢাকায়, রমনার বটমূলে, নববর্ষ উদ্যাপনের প্রথা শুরু হয়, যা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে বড় শহরগুলোতে। শাসকের ক্রমাগত চোখ রাঙানির ফলে বাঙালিরা ভাষার মতই এই পহেলা বৈশাখকে আঁকড়ে ধরে। ফলে পহেলা বৈশাখের একটি রাজনৈতিক মাত্রাও তৈরি হয়। সেই সময় বাঙালির জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িক আবহ ও স্বাধীকার আন্দোলনের চেতনা তৈরিতে পহেলা বৈশাখের দারুন প্রভাব ছিল।
বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনাও হয় মূলত আকবরের সময় থেকেই। কৃষকরা চৈত্রের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদারদের খাজনা পরিশোধ করতেন। পরদিন নববর্ষে জমিদার ও ভূ-স্বামীরা কৃষকদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এটি ‘পুণ্যাহ’ নামে পরিচিত ছিল।
অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। ব্যবসায়ীরা নববর্ষে তাঁদের পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে নতুন খাতা খুলতেন। ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানাতেন ও মিষ্টিমুখ করাতেন। ক্রেতারা সারা বছরের বাকির টাকা পরিশোধ করতেন। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়। বাংলা নববর্ষের আর একটি প্রধান অনুষ্ঠান হল বৈশাখি মেলা। দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈশাখের প্রথম দিনে এই মেলা বসে।
জীবন-যাপন ও সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন এবং নগরায়নের ফলে নববর্ষের অনেক অনুষ্ঠানের বিলুপ্তি ঘটেছে। জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে পুণ্যাহ উৎসবের বিলুপ্তি ঘটে। ঢাকার ঘুড়ি ওড়ানো এক সময় অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। ঘোড় দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, পায়রা ওড়ানো, নৌকা বাইচ, বহুরূপীর সাজ ইত্যাদি গ্রামবাংলার জনপ্রিয় খেলা এবং অনেক আঞ্চলিক ও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান বর্তমানে আর তেমন প্রচলিত নেই।
যা কিছু বেঁচে আছে তা আবার শহরে এসে ভোল পালটে ফেলেছে। হালখাতা এখন নগরে কদাচিৎ দেখা যায়। বৈশাখি মেলা থাকলেও এটি এখানে সেই অর্থে মিলনমেলা নয়। এখানে সকাল হতে না হতেই বুভুক্ষের মত রাস্তায় নেমে আসে শহরবাসী। রমনার বটমূলে বর্ষবরণে সবাই সামিল হতে চান। পহেলা বৈশাখের সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে শিল্পীরা উন্মুক্ত চত্বরে সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
নগরে এসে পহেলা বৈশাখ বর্তমান সময়ে অনেকটাই কর্পোরেট ও বাণিজ্যিক রূপ ধারণ করেছে। সকালবেলা পান্তা-ইলিশ খাওয়া এখানে ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। নববর্ষে নানা আয়োজনের মধ্যে মেলায় বসে মাটির সানকিতে পান্তা-ইলিশের দোকান।
এ উৎসব পালনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রস্তুতি নেয়া হয় পোশাককে ঘিরেই। তাই গত কয়েক বছর ধরে এখানে পোশাক কেন্দ্রিক বাণিজ্যও বেশ রমরমা হয়ে উঠেছে।
বাংলা নববর্ষকে ঘিরে বিদেশীদের মধ্যেও রয়েছে প্রবল আগ্রহ। প্রতিবারই বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরা আসেন এটি উপভোগ করতে। বাংলা নববর্ষের মূল শক্তির জায়গা এর সর্বজনীনতা ও অসাম্প্রদায়িক আবেদন যা একে ছড়িয়ে দিয়েছে পুরো বিশ্বে। এখন প্রতি বছরই বাংলা নববর্ষে গুগল তাদের বিশেষ ডুডল প্রকাশ করছে। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। ইউনেস্কোর মতে এটি মানুষের অশুভের বিরুদ্ধে লড়াই আর সত্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার প্রতীকী রূপ। এই শক্তির জোরেই বাঙালি ও বাংলা নববর্ষ আজও স্বমহিমায় ভাস্বর।