আনন্দের সংবাদ, ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে কবি ও কথাসাহিত্যিক রাশেদ রেহমানের উপন্যাস ‘নদীর নাম যমুনা’।
এই উপন্যাসের শ্রেণী বা বিষয় অনুযায়ী এই উপন্যাসকে দু’টি বিষয়ের ওপর নির্ভর করা যেতে পারে- আঞ্চলিক আখ্যান এবং আত্মজৈবনিক আখ্যান।
এই উপন্যাসে বিশেষ একটি অঞ্চলের যেমন যমুনা নদীর তীরবর্তী মানুষের জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি অনেক ঘটনার ভেতর থেকে অনেক সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না মিশ্রিত বিবরণ এই উপন্যাসের চিত্ররূপ হিসেবে পেয়েছি বলেই এটাকে আঞ্চলিক ধারার উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত করলাম।

আবার আত্মজৈবনিক আখ্যান বলার কারণ নিছক লেখকের প্রতি সন্দেহ করে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে লেখক তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতকে শ্রমশীল শিল্পকুশলতায় উপন্যাসে রূপদান করেছেন কল্পনার ওপর নির্ভর করে। হয়তো তাঁর বিগত জীবনের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ঘটনাসমূহের দৃষ্টান্তও রেখেছেন উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহে (পাঠক হিসেবে আমার এই ধারণা অমূলক হতে পারে)।
এই উপন্যাসে তিনি শব্দে কিংবা ছন্দে আখ্যান বর্ননা করেছেন, নিয়েছেন বিভিন্ন নাটকীয়তার আশ্রয়। আমার বিশ্বাস যে কোন পাঠক ‘নদীর নাম যমুনা’ পড়তে শুরু করলে শেষ না করে উঠতে পারবেন না বলে বিশ্বাস করি। আমার মতো অলস পাঠক এক বসায় উপন্যাসটি পড়ে শেষ করেছি। রাশেদ রেহমান শুরু করেছেন এভাবে-
“ জলজঙ্গলে জলতরঙ্গে হাবুডুবু ডুবুডুবু মানবতা। যে যার বাঁচার প্রাণান্তকর চেষ্টায় আপ্রাণ সাঁতরায়। জল মানুষের কোলাকুলি, জলকেলি বিধাতার। জলস্থলনে কাতরায়, তবু জলে ডোবার ভয়ে প্রাণপণ সাঁতরায়।
কচুরিপানা আর ফেনার মত মানুষের মুণ্ড যত অবিরত ভাসে আশেপাশে। মৃত্যুর ভিড় ঠেলে স্মৃতির মশাল জ্বেলে হৃদাকাশে ধূসর শৈশব কৈশোর ভাসে। এবার মূল ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করি—
গফুর মল্লিক সরকারি ভূমি অফিসের তহসিলদার। যমুনায় তাঁর অর্ধেক ভূমি কেড়ে নিয়েছে। তারা সাত ভাইয়ের মধ্যে তিনভাই একই পেশায় এবং বাকিরা ব্যবসাসহ বিভিন্ন পেশায় জীবিকা নির্বাহ করতেন। দুই ভাই ব্রিটিশের ভূমি অফিসার সুবাদে আসামে চলে যান৷ বড়োজন মহাজন গোলজার বেপারি। সবার ছোট গফুর মল্লিক। গোলজার বেপারি খুব ঈমানদার মানুষ। নৌকায় করে কাজের পাশাপাশি করতেন আধ্যাতিক আরাধনা।একদিন নৌপথে তাদেরকে ডাকাত তাড়া করে। তখন সে দোয়ার বই পড়তে থাকেন। তখন এক আশ্চর্যান্তিত ঘটনা ঘটে যায়। পুরো অঞ্চল কুয়াশায় ঢেকে যায়। ডাকাত দল অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। এই ঘটনার পর থেকে এলাকার মানুষ তাকে মুন্সি, আবার কেউ দরবেশ হিসেবে সম্বোধন করতে শুরু করে৷ একদিন নারায়ণগঞ্জ থেকে গোলজার দরবেশ গফুরকে সঙ্গে নিয়ে উজান গাঙে নাও ভাসায়। চলতে চলতে ডবল পাল উড়াতে গিয়ে দড়িতে গিট্টু লেগে যায়। গফুর তাড়াহুড়ো করে মাস্তুলের উপরে উঠে যায়। সবাইকে ঝাঁকুনি দিতে বলে হঠাৎ করে মাস্তুল থেকে গফুর জলে ছিটকে পড়ে যায়। মাঝিরা বৈঠা ফেলে গফুর বৈঠা ধরে থাকে। পিছনের নৌকাকে ডাকে, কে শোনে কার হাকডাক৷ অবশেষে মাঝিরা নাটুয়াপাড়ায় গফুরকে রেখে যায়। কালাজ্বরে দশদিন পর গফুর মল্লিক মারা যায়।”
আহা কষ্ট ! কষ্ট কতো নির্মম যা মৃত্যুতে বিভীষিকাময়।গফুর মল্লিকের দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। সবার বড় ছেলে আবুল। পিতাকে হঠাৎ হারিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করে। মা রাহেলা বেগমও এক বছরের ছোট ছেলেকে রেখে এই ফাঁকে স্বামীর শোকে পৃথিবীকে বিদায় জানান। হায়রে কি নির্মম পরিহাস, এ যেন মৃত্যু মৃত্যু খেলা।
ঔপন্যাসিক এখানে চরম বাস্তবতায় লিখেছেন ”
“মৃত্যু মানুষকে অসহায় করে দেয়।
বিয়োগ ব্যথায় স্মৃতি কাতরায়।
অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর দহন সহস্রগুণ।
একটা মৃত্যু!
কতকিছু এলোমেলো করে দেয়…..”
উপন্যাসের পুরো গল্পটি এগিয়ে গেছে নানান বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে। কাব্যিক ছন্দে লেখা হলেও উপন্যাসটিতে খুব সহজ ভাষার প্রয়োগ এবং বাক্যবিন্যাস যে কোনো পাঠককে বাধ্য করবে বাধ্য পাঠক হিসেবে এক বসাতে পাঠ করার তাড়না। গ্রামীণ পটভূতিতে লেখা হলেও লেখক মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন বাক্যের পর বাক্য সাজাতে। প্রকৃত উপন্যাসের স্বাদ পেতে আপনাকে অবশ্যই এমন একটি বই সংগ্রহে রাখার মতো বলে মনে করি। ঔপন্যাসিক রাশেদ রেহমানের ‘আজিরন বেওয়া’ বইটি পড়ে তাকে যেভাবে পাঠক আবিস্কার করেছেন। তারই ধারাবাহিকতার স্বাদ এই উপন্যাসে পাওয়াটা অনুমেয় ছিলো।
বইঃ নদীর নাম যমুনা
ধরনঃ উপন্যাস
লেখকঃ রাশেদ রেহমান
প্রকাশক: হাওলাদার প্রকাশনী
প্রচ্ছদঃ নিয়াজ চৌধুরী তুলি
পৃষ্ঠাঃ ৮০
বইয়ের মূল্যঃ ২৭৫ টাকা
মিজান হাওলাদার
কবি ও গল্পকার।
বাংলাদেশ।