সাধারণত উঁচু পাহাড়, গিরিখাত থেকে সৃষ্ট ঝরণাধারা বা হিমবাহ থেকে নদীর জন্ম হয়। কখনও বা প্রাকৃতিক পরিবর্তন থেকেও নদীর জন্ম হয়। হাজার হাজার ফুট উঁচু থেকে প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে আসে জলস্রোত। আর তা স্থলভাগ অতিক্রম করার সময় নদী নামে পরিচিতি পায়। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। আরো বলা হয় হাজারো নদীর দেশ বাংলাদেশ। কেননা, মায়ের মতোই স্নেহের বন্ধনে চারদিকে ঘিরে রেখেছে অসংখ্য নদ-নদী। নদী বাহিত পলি উর্বর করে এদেশের মাটি। নদীর দানে উর্বর মাটিতে ফলে সোনার ফসল। মূলত কৃষি ব্যবস্থার সাথে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই নদী। তাছাড়া বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের জীবনে নদী কখনো প্রত্যক্ষ কখনো পরোক্ষভাবে অবদান রাখছে। নদীর কারণেই বাংলাদেশের চারিদিকে দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ আর সবুজের ছড়াছড়ি। এছাড়াও মাছের বংশ বৃদ্ধি, মাছের বিস্তার ও প্রসার ঘটে এই নদীতেই।
মূলত নদীই মাছের প্রধান উৎস। তাই তো জেলে সম্প্রদায়ের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম উৎসও নদী। পদ্মা-মেঘনার রূপালী ইলিশ বিশ্বসমাদৃত। রুই, কাতল, চিতল বোয়াল,শোল আরো আছে রকমারি মাছ। এই সব মাছ আমাদের দেহের সিংহভাগ আমিষের চাহিদা পূরণ করে। মূলত নদীই এদেশের প্রাণ। তাই তো নদীর তীরে গড়ে ওঠেছে শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ, হাট-বাজার, কলকারখানা ও জনপদ। নদী পথে মানুষের যাতায়াত ও মালামাল পরিবহন খরচও খুব কম। তাছাড়া নদীর সৌন্দর্যের অন্যতম আকর্ষণ পাল-তোলা নৌকা। কারণ, নৌকা ও নদী একে-অপরের পরিপূরক। তাই তো রকমারি নৌকা নদীকে করেছে আরো শোভাময়ী। নদীর বুক চিরে তরতরিয়ে চলত পাল তোলা নৌকা। বেগবান নৌকার দু’পাশে ছিটিয়ে পড়ত সাদা সফেদ বুদবুদ ফেনা। সে কী অপূর্ব সুরেলা আওয়াজ? মাঝিরা গাইত ভাটিয়ালি গান। আর পালের পতপত আওয়াজেও সৃষ্টি করত মিহি সুরের মূর্ছনা। আর সূর্যাস্তের রক্তিম আভায় বর্ণিল দৃশ্যে মন হারাত দূর অজানায়। এমনি রূপে অপরূপা নদী আপন সৌন্দর্যে মুগ্ধ করত দু’পাশের জনপদের মানুষকেও। আর এসব মুগ্ধতায় লুদ্ধ হতো পানকৌড়ি, বালিহাঁস, আরো রকমারি পারিযায়ি পাখি। নদীর পানিতে ডুব সাঁতারে মাছ শিকারে ব্যস্ত হতো তারা। ঢেউয়ের তালেতালে হেলেদুলে ভাসত ওরা। আর জলকেলিতে প্রেমলীলায় মগ্ন হতো। কখনো ঝাঁকবেঁধে পাখা ঝাপটায়ে উড়ত। কী যে সুন্দর দেখাত পাখিদের প্রমোদ বিহারের মুগ্ধকর মুক্ত জীবন। এতে নদীর সৌন্দর্য আরো বহুগুণে বেড়ে যেত।
আজ আগের মতো নেই সেই সৌন্দর্য। নেই অভয়ারণ্যে হিসাবে নদীতে পাখিদের অবাধ বিচরণ। তাছাড়া সময়ের বিবর্তনে এর স্থান দখল করেছে ইঞ্জিন চালিত নৌকা। হারিয়ে গেছে দাঁড় ও গুন টেনে নৌকা চালানোর সেই মনোরম দৃশ্য।
এখন মাঝিদের কণ্ঠে আর শোনা যায় না সেই জারি, সারি আর ভাটিয়ালি গান। ভাটির টানে গানের সুরে উতলা বিরহী বধূরাও এখন আর উন্মন-উতলা হয় না। এ সব গানে থাকত গ্রামীণ জীবনদর্শন ! গ্রামীণ নারী মনের প্রেম-ভালোবাসা, বিরহ-দহন, আবেগ- আকুলতা ইত্যাদি। বাংলা সাহিত্যেও নদী এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কাব্য, চলচ্চিত্র এবং সংগীতে নদীর কদর ছিল চিরসমাদৃত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পদ্মা নদীর মাঝি”, জসীমউদ্দিনের “সোজনবাদীয়ার ঘাট এবং চলচ্চিত্রে “তিতাস একটি নদীর নাম” উল্লেখযোগ্য। কালজয়ী চলচ্চিত্রের সেই জনপ্রিয় সুজন-সখীর গানের চিত্রায়ন মানুষকে এখনো আনমনা করে।
বন্যা এবং নদীভাঙ্গন দুটোই মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এর কারণ বর্ষায় প্রমত্তা নদী থাকে পূর্ণ যৌবনা। উজানে প্রচুর বৃষ্টিপাত। পাহাড়ি ঢলে নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে। এতে পানির গতিবেগ প্রচন্ড বেড়ে যায় এবং দ্রুত গতিতে সমুদ্রের দিকে ধাবিত হয়। তখনি উপকূলীয় অঞ্চলের নদী সংলগ্ন স্থলভাগে পানির তীব্র তোড়ে সৃষ্টি হয় নদী ভাঙ্গনের। আর অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধিতে সৃষ্টি হয় বন্যা। এতে প্রাণহানি হয়। ফসল নষ্ট হয়। সৃষ্টি করে নদীভাঙ্গন। বিলীন হয়ে যায় গ্রাম-গঞ্জ, জনপদ। সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয় মানুষ। আবার পলিবাহিত বন্যার পানিই উর্বর করে এদেশের মাটি। বন্যার পানিতে বাঁধ দিয়ে উৎপন্ন করা হয় বিদ্যুত। তবে নদী একপাড় ভেঙ্গে আরেক পাড় গড়ে। তাই তো, হেমন্তের কণ্ঠে সেই কালজয়ী গানের কলি মনে পড়ে গেল –
একূল ভেঙ্গে ওকূল তুমি গড়
যার একূল ওকূল দু’কূল গেল
তার লাগি কী কর?
এ গানের কথার তাত্ত্বিক তত্ত্বে যে প্রশ্ন তার উত্তর নদী জানে না। এমনি কতশত ভাবাদর্শী বা অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক দর্শনও লুকিয়ে আছে এটাও নদী জানে না। নদী তো নিজেই জানে না তার সৃষ্টির রহস্য! নদীর সৃষ্টির পেছনে আছে কতশত বাঁধা-বিপত্তি, সমস্যা-সংকট। আরো জড়িয়ে আছে ত্যাগ-তিতিক্ষার করুণ ইতিহাস!
পাহাড়ের অনেক উঁচু থেকে প্রবাহমান জলধারা নীচুতে পড়লে তাকে বলি ঝর্ণা। ঝর্ণার সৌন্দর্যে যতটা না মুগ্ধতা রয়েছে তার পতনের পথ ততোটাই কন্টকাকীর্ণ ও বিপদসংকুল। প্রবাহমানতার পদেপদে বড় বড় পাথর বহন করে তাকে নীচে পড়তে হয়েছে। পাথরের ঘর্ষণে তার অস্তিত্ব রক্ষায় এসেছে অনেক প্রতিবন্ধকতা। এ সবকে অতিক্রম করে নীচুতে পড়ে ঝর্ণা নামে খ্যাতিলাভ করেছে। কিন্তু ঝর্ণা কখনো একে পতন বা বিপর্যয় মনে করে নি। আবরো নতুন উদ্যোমে, প্রাণোচ্ছলতায় এগিয়ে চলছে আপন গতিতে। এতেও ছিল বাঁধা। কিন্তু থেমে থাকে নি ঝর্ণা। বাঁধা পেয়েও ডানে-বাঁয়ে এঁকেবেঁকে যেত। শেষ পর্যন্ত তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে। সমভূমির উপর দিয়ে চলার পথও মসৃণ ছিল না। পাথরের ঘর্ষণে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তার দেহ-মন। কিন্তু কেউ, কখনো উপলব্ধি করি নি। আমরা শুধু বাইরে থেকে বহমান নদীর শান্ত-সমাহিত রূপটিই দেখি। আর তার মনোলোভা সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই। চোখ জুড়াই। অথচ, নদীর অন্তরালস্ত দুর্বার স্রোত কী প্রচন্ড আক্ষেপ নিয়েই না বয়ে চলেছে! আর তার অতলান্তে চলছে কতই না গভীর দুঃখ-কষ্টের ভাঙাগড়ার খেলা। নীরবে নিভৃতে কতশত ব্যথা বুকে নিয়ে নদী বয়ে চলেছে নিরবধি। কে তার খবর রাখে? অথচ জীবন এবং জীবিকা উভয়ক্ষেত্রেই নদীর উপর আমরা নির্ভরশীল। মানুষের জীবনও বহতা নদীর মতোই। তাই তো বলা হয়, নদীর সাথে এ দেশের মানুষের গভীর মিতালি! আত্মিক সম্পর্ক।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বলেছেন, “নদী বাঁচলে বাঁচবে দেশ।” তাই এই শ্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে বলছি। সফল হোক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান। বন্ধ হোক অবৈধ বালু উত্তোলন। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা এবং বালু নদীর বর্জ্যে দূষিত পানি দুর্গন্ধমুক্ত হোক। রোধ হোক নদীভাঙ্গন। এতে নদী ফিরে পাবে হারানো সৌন্দর্য। তাই দেশের বৃহত্তম স্বার্থে আমাদের ক্ষুদ্রক্ষুদ্র স্বার্থগুলো ত্যাগ করা উচিত। ফলে নদী আরো ফিরে পাবে প্রকৃতির অপার নান্দনিকতা। চিরসবুজের বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে পর্যটকমহলের দৃষ্টি কাড়বে। দেশ হবে সমৃদ্ধ। আর আমরাও বাঁচব, নদীও বাঁচবে। বাঁচবে দেশ। আর গড়ব মোরা সোনার বাংলাদেশ।
পিয়ারা বেগম
কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
নারায়ণগঞ্জ, বাংলাদেশ।