সিরাজগঞ্জ জেলাধীন কাজিপুর উপজেলার ৬ টি এবং সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ৩ টি মিলিয়ে মোট ৯ টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত বৃহত্তর এক জনপদ, যা প্রায় চতুর্দিক থেকে যমুনা নদীর প্রবাহ দ্বারা বেষ্টিত। সুদীর্ঘকাল ধরেই সবকিছুতেই এই ৯ টি ইউনিয়নকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে নাটুয়ারপাড়া ইউনিয়ন।

এই বৃহত্তর চরাঞ্চল- বিশেষ করে কাজিপুর উপজেলাধীন ৬ টি ইউনিয়নের নাম কাগজে-কলমে ভিন্ন-ভিন্ন হলেও মৌখিকভাবে এই অঞ্চল বৃহত্তর নাটুয়ারপাড়া নামেই সর্বাধিক পরিচিত। অর্থাৎ সমগ্র এই অঞ্চলটি-ই নাটুয়ারপাড়া’র চর নামে লোকমুখে পরিচিত।
বাংলাদেশ সৃষ্টিরও অনেক আগে থেকেই এই জনপদ শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি আচার-অনুষ্ঠান, বিনোদন ও রাজনীতিতে ‘কাজিপুর’ তথা সিরাজগঞ্জে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে।
শতাধিক (১০৮) প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি কম্পিউটার ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও ২টি ডিগ্রি কলেজ এবং অসংখ্য নন-এমপিও-ভুক্ত ও প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে এই চরাঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা বিস্তৃত। স্বাধীনতার আগে থেকে অদ্যবধি এই অঞ্চলের উচ্চশিক্ষা ও সাক্ষরতার হার পুরো উত্তরবঙ্গে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে বিদ্যমান। মুক্তিযুদ্ধেও এই চরাঞ্চলের রয়েছে উল্লেখযোগ্য ও অগ্রগামী ভূমিকা।
মঞ্চনাটক, যাত্রা, সার্কাস, পুতুলনাচ ও খেলাধুলাসহ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এই চরাঞ্চলিয় জনপদ সবসময়ই নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। যদিও সারাদেশের মতোই এই অঞ্চলেও মূলধারার বাঙ্গালী-সংস্কৃতি যেমন নাটক, যাত্রা, সার্কাস, পুতুলনাচ ইত্যাদি আয়োজনে অনেকটা ভাটা পড়েছে~ এরপরও “নাপা সাংস্কৃতিক সংঘ” এবং “যমুনা বাউল একাডেমী” সহ বেশকিছু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এখনও স্রোতের বিপরীতে অতীতের ধরা অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অথচ আমাদের ছোটবেলায়ও দূরদূরান্ত থেকে নৌকা ভাড়াকরে নাটুয়ারপাড়ায় (নিজস্ব পরিচালনা ও কলাকুশলী দ্বারা মঞ্চায়িত) নাটক, যাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও খেলাধুলা দেখতে মানুষদের দলে দলে আসতে দেখেছি ।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে এই অঞ্চল সারাদেশে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গুজরাটের দাঙ্গা, বাবরী-মসজিদ কেন্দ্রিক সহিংসতাসহ সারাদেশে বিভিন্ন সময় হিন্দু সম্প্রদায় মুসলিমদের দ্বারা আক্রান্ত হলেও অদ্যবধি এই অঞ্চলে কখনও এরূপ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি, যদিও এই চরাঞ্চলে উল্লেখযোগ্য-সংখ্যক সনাতন জনগোষ্ঠির বসবাস আছে সুদীর্ঘকাল থেকেই।
উল্টো হিন্দু/মুসলিম নিজেদের ধর্মীয় উৎসবে একে অপরের পরিপূরক হয়ে অংশগ্রহণ করে আসছে সুদীর্ঘকাল ধরে। অতীতে কীর্তন, চড়ক পুজাসহ হিন্দু সমপ্রদায়ের নানাবিধ বৈঠকী গানের আসরে আমরা যেমন পরিবারসহ অংশ নিয়েছি, অনুরূপ ঈদ উৎসবসহ নাটক, যাত্রাপালা এমনকি আমাদের পারিবারিক বৈঠকী গানের আসরেও হিন্দু সম্প্রদায় পরিবার সহ অংশ নিয়েছে। নাটক/যাত্রাপালা বিলুপ্ত হলেও এখনও আমরা মিলেমিশে বৈঠকী গানের আসর উপভোগ করে থাকি; সম্প্রতি আমার বন্ধু “নিতাই চন্দ্র সরকার” (পুলিশের ওসি) এর ছোটভাই স্বপন কুমার সরকার মেম্বার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে~ মুসলমান বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় অতি অল্প খরচে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়, যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি উদাহরণ মাত্র।

সারাদেশের মতো নেশার থাবা এখানে হানা দিলেও চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি অত্র অঞ্চলে নেই বললেই চলে, বলতে গেলে এখনও এই অঞ্চলের মানুষ ২৪ ঘন্টার জন্য বাড়ির দরজা জানালা খুলেই রাখে।
নদীর কল্যাণে পন্যপরিবহণে সুবিধার জন্য ব্যবসা বাণিজ্য এবং অত্র অঞ্চলের বৃহৎ হাট (নাটুয়ারপাড়া হাট) কে কেন্দ্রকরে এই অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে অতীত থেকেই বেশ ভালো। একসময় মঙ্গাকবলিত (রংপুর/দিনাজপুর) এলাকাগুলো থেকে প্রচুর মানুষ এই অঞ্চলের স্কুল ও গেরস্ত বাড়িগুলোতে আশ্রয়নিয়ে দিনমজুরিতে কাজ করতো। জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় মঙ্গা দুর হলেও, এখনও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভিক্ষুক শ্রেণীর মানুষ নৌকাযোগে এই অঞ্চলে ভিক্ষাবৃত্তির জন্য আসে। তবে বাংলাদেশের কৃষিবিপ্লবের আগে এ অঞ্চলের কিছু মানুষও বজ্রা সদৃশ বড় বড় নৌকা নিয়ে “সিলেট-কাবারে”(সিলেটে আমনধান কাটার মৌসুমে) যেত এবং এক/দেড় মাস পর উক্ত নৌকা ভর্তি ধানসহকারে ফিরে আসতো। এই এলাকার বিখ্যাত দুই কৃষিপণ্য ছিল মরিচ ও পাট। মূলতঃ বগুড়া কেন্দ্রিক পাইকারগণ এই অঞ্চলের মরিচ ক্রয়করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রয করাতে এই অঞ্চলের মরিচই বগুড়ার মরিচ নামে দেশব্যাপী খ্যাতি পায়।
এতদিন সৌরবিদ্যুৎ দ্বারা এই চরাঞ্চলের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ হলেও; প্রয়াত সাবেক মন্ত্রী মুহম্মাদ নাসিম ভাইয়ের দীর্ঘ প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে যমুনার তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে সম্প্রতি এই অঞ্চলও বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়েছে। আশাকরি এমন একদিন আসবে, যেদিন হয়ত মেঘাই গাড়ি রেখে নৌকা বা স্পিডবোটে নাটুয়ারপাড়ায় আসতে হবে না, সরাসরি গাড়িতেই আসতে পারবো প্রিয় নাটুয়ারপাড়ায়।সারাদেশের উন্নয়নের জোয়ারে নাটুয়ারপাড়া তথা চরাঞ্চলও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে।
আজিজ মিশির সেলিম
প্রকৌশলী, সংগঠক
ঢাকা, বাংলাদেশ।