পুরুষ হয়ে নারী মনোজগতের প্রকৃতি পুঙ্খানুপুঙ্খ অবগত হওয়া কঠিন ব্যাপার। তবে নারীদেরকে যেভাবে দেখা যায়, যে ভূমিকা তাদের পালন করতে হয়, তাদের স্বাদ-আহলাদকে যেভাবে যুগের পর যুগ ধরে পদদলিত করা হচ্ছে এবং পরিশেষে তাদেরকে যেভাবে পুরুষের প্রয়োজনীয় উপাদান হিসাবে গন্য করা হচ্ছে, তা উপলব্ধি করলে এটি সহজেই প্রতিয়মান হয় যে, নারীরা মানুষ প্রজাতির সহজাত ও সাবলীল পদচারণার স্বাদ আজ অবধি গ্রহণ করতে পারেনি। পুরুষ প্রধান সমাজ, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ ও তথাকথিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক আবহ নারীদেরকে শুধুই বুঝতে শিখিয়েছে যে, এরকমই হতে হবে নারীদের, এরূপ ভাবেই হবে তাদের ভূমিকা এবং এতেই নারী জন্মের সার্থকতা। যুগে যুগে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্যে নারীবাদী গোষ্ঠী, লেখক-কবি-সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতারা এ নিয়ে আলোড়ন তৈরি করেছেন, তবুও কাজের কাজ বলতে গেলে হয়নি; কারন সম্ভবত: পুরুষ কেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে পুরুষদের অধিকার প্রয়োগের মনস্তাত্ত্বিক সংশোধনের ব্যাপারটি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। ভয়ংকর দৈত্যটিকে হত্যা করে নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করতে হলে, দৈত্যটিকে মারতে হবে, তা সবাই জানে; কিন্তু কোথায় আঘাত করলে দৈত্যটি পরাস্ত হবে এটি জানা ও করতে পারা মূল কর্তব্য।
অধিকারের ন্যায় বন্টনটি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ । যার যা অধিকার, তার প্রাপ্তি এবং তার সাবলীল ব্যবহার নিশ্চিত করাটিই বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট। সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা বলতে আমরা এ ধারাটিকেই বুঝি; অর্থাৎ, শ্রেনীভেদে অধিকার প্রাপ্তি ও তা চর্চা করতে পারার উপযুক্ত পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে শ্রেনী বলতে নারী শ্রেনী, পুরুষ শ্রেনী ও শিশু শ্রেনীকে বুঝায়। প্রশ্ন হলো, অধিকার বন্টনের ক্ষেত্রে কেন এ বিভাজন? প্রাকৃতিক ভাবেই নারী ও পুরুষের মধ্যে চাহিদা, তৃপ্তি, অবদান ও কর্মদক্ষতায় পার্থক্য বিদ্যমান। এ পার্থক্যে তুলনামূলক বিচার প্রসূত হীনমন্যতা যুক্তিবিরুদ্ধ। উদাহরণ স্বরূপ, গর্ভধারণের কষ্টদায়ক কিন্তু মহৎ ক্ষমতাটি যেহেতু শুধুমাত্র নারীটির, সেহেতু সন্তানটির উপর মাতৃত্বের অধিকারটি পিতৃত্বের অধিকারটির চেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে, এটিই ন্যায়সংগত; আবার, যে সকল ক্ষেত্রে, যেমন- কায়িক পরিশ্রম সংশ্লিষ্ট কাজে পুরুষদের অগ্রাধিকার ন্যায়সংগত। এরূপ অসংখ্য ক্ষেত্র রয়েছে, যখানে নারী ও পুরুষের প্রাকৃতিক সামর্থ্য অনুযায়ী অধিকার বন্টন যথাযথ। তবে, মৌলিক অধিকার গুলির ক্ষেত্রে বন্টনটি সমান হওয়ার ব্যাপারে চুলচেরা বিচ্যুতি গ্রহনযোগ্য নয়। যার যার অবস্থানে থেকে অধিকার গ্রহন ও প্রয়োগের ক্ষেত্র সমূহ পরিষ্কার ভাবে বুঝা এবং সে অনুযায়ী প্রাণটিকে সতস্ফুর্ততা দান করা যেমন একক ব্যক্তির দায়িত্বের অংশ, তেমনি সমাজটিরও কর্তব্য চর্চাগুলি পালনে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা। নারী যদি না চায়, তারপরও তাকে অবরূদ্ধ থাকতে বাধ্য করা, তার যোগ্যতাকে ব্যবহার করতে বাঁধা প্রয়োগ, তার মতামতকে অবমূল্যায়ন এবং তাদেরকে সর্বপ্রকারে কোনঠাসা করে রাখার প্রবনতা সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার অন্তরায়। নারীশিক্ষা যেমন নারীকে মানুষ হিসাবে তাকে অধিকার আদায়ের ব্যাপারে সচেতন করে, তেমনি জাতীয় অবকাঠামো কতটা প্রভাবমুক্ত হয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে সেটিই বিবেচ্য। অধিকার আদায়ের কথাটি এ কারনেই আসছে যে, বহুকালের বহমান কলুসিত সংস্কৃতির যাঁতাকলে অধিকার গুলি পিষ্ট হতে হতে মৃতপ্রায় বলে, আদায়ের পদক্ষেপটিই পারে এগুলির নবজীবন দিতে এবং এ আদায় হবে সমঅধিকারের বৃত্তে। বৃত্তটিকে বুঝা গুরুত্বপূর্ণ ; বৃত্তের বাইরের পদক্ষেপ সেহেতু অনধিকার চর্চা হিসাবেই পরিগনিত হবে, হোক সে নারী অথবা পুরুষ।

নারী সম্পর্কে পুরুষের মনস্তত্ত্বটির বিশ্লেষণ এক্ষেত্রে অবস্থার উন্নতির ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। নারী আজও পুরুষের অধিনস্ত বলেই পুরুষ মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা নারী মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ । আর্থ-সামাজিক প্রক্ষাপট, নারী নিরাপত্তাজনিত কারন, নারীদের ভূমিকা ও নারী শিক্ষার অভাব সাধারণত নারীদেরকে যুগে যুগে পুরুষদের অধিনস্ত করে রেখেছে। ‘স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর স্বর্গ বা বেহেস্ত’- এ কথার প্রচারে যেমন কতিপয় নারী পুরুষের বশ্যতা স্বীকার করে পুরুষকে শাসন-শোষনের পূ্র্ণ সম্মতি দিলো এবং কতিপয় পুরুষ এ সুযোগে একের পর এক অধিকার হরন করে আধিপত্যের রাজত্য কায়েম করলো; তেমনি অপরদিকে, কতিপয় পুরুষ এ বাণীতে নারীর শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালবাসার উৎসর্গের কথাই জানলো, অত:পর কতিপয় পুরুষ নারীর এ শ্রদ্ধা-ভালবাসার প্রতিদান স্বরূপ তার সম্মান-অধিকার রক্ষার্থে অধিকতর সচেতন হলো। পুরুষের নারী সম্পর্কিত মনস্তত্ত্বটির সংশোধন এ জন্যই জরুরী। কি আছে এ মনস্তত্ত্বে? কর্তৃত্ব করার প্রবনতা, স্বীয় অবদানের প্রাধান্য ও নারী অবদানের অবমূল্যায়ন, কথিত পৌরুষ প্রদর্শনের মানসিকতা এবং অসুস্থ বোধ যেন পুরুষ নামক প্রতিরূপটির সর্বাংশে জড়িয়ে আছে; আর, সে কারনেই বোধ করি ‘পুরুষ’ টি কলুসিত বলে ‘সুপুরুষ’ টি মাঝে মাঝে স্থলাভিষিক্ত হয়। আর্থিক অবদানটির মূল্যায়ন তুলনামূলক ভাবে বেশী বিধায়, অবদানের তথাকথিত গৌরবজনক কৃতিত্বে কর্তৃত্বের ক্ষমতা আরোপ করে পৌরুষ নামের অহংকারী সত্তাটির দাম্ভিকতায় নারী অবদানটি নিরবেই স্বীকৃতিহীন হয়ে মৃত হয়। যে নারীটি সত্যিকার অর্থে পুরুষ সাম্রাজ্যের বোঝা বহন করে, সে-ই শেষপর্যন্ত বোঝায় রুপান্তরিত হয়। যে ব্যবস্থায় নীরব যুক্তির স্থলে সরব অযুক্তি, যা অন্যায়, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সমস্ত অবস্থা বিরাজমান, সেখানে নারীর নীরবতাকে সৌন্দর্য নামক শেকলরূপী অলংকার দিয়ে ভূষিত করে নারীকে আজীবন কোনঠাসা করে রাখে। অসহায় নারী নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এক সময় এটিকেই নারী চরিত্রের আদর্শ রূপ মেনে নিয়ে তার মানুষ সত্তাটিকে ঘুমন্তই রেখে দেয়। পুরুষ মনস্তত্ত্বের এ সাম্রাজ্যবাদী মনভাব সৃষ্টির ইতিকথা যা-ই হোক না কেন, এটি যে সুস্থ মানসিকতা নয়, তা নিশ্চিত।
অনগ্রসর নারীটি যুগ বদলের সাথে সাথে অনেকটা অগ্রসর হয়েছে। অগ্রসর এ অর্থে যে, তারা শিক্ষা ও চেতনার সম্মিলিত প্রভাবে বুঝেছে অধিকার কোনটি, বুঝেছে শাসন-শোষন-ভালবাসা-শ্রদ্ধায় নারী মূর্তিটি আসলে কি। সাবলীল পদচারনায় নারীর এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে, ছোট ছোট অসংগতির প্রতিবাদের মাধ্যমে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। অধিকারটিকে শুধু আদায় নয়, পুনরুদ্ধারও নয়, এটিকে দখলদারিত্বে রাখার যোগ্যতা অর্জনটি গুরুত্বপূর্ণ । যোগ্যতা গুলির মধ্যে নারীদের প্রতি মমতা ও ভালবাসা ছাড়াও পুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও মায়ার রেশটি ছড়িয়ে দেয়া উল্লেখ করার মত। নারীবাদী বলে ক্ষ্যাত একটি গোষ্ঠি প্রায় সময়ই মনে করেন পুরুষরা তাদের আজীবনের শত্রু। বিচার-বোধের প্রশ্নে প্রাথমিক মানদন্ডটি মানব মানদন্ড, এর পরের মানদন্ডে আসবে লিঙ্গ ভেদে মৌলিক চাহিদার তারতম্যে ও প্রাপ্তিতে। নিজ অধিকার দখল মানে অন্যের অধিকার হরন নয়। পুরুষের জন্য নারীর শ্রদ্ধামিশ্রিত অবনত মস্তক মানে, নারী মননের দুর্বলচিত্তের প্রকাশ নয় কিংবা আত্মসমর্পন নয়, এটা বুঝা যেমন পুরুষটির কর্তব্য, তেমনি নারীটিরও। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য শক্তি থাকা জরুরী। শক্তিটি অর্জন মানে স্বাবলম্বী হওয়া ও ন্যায়বিচার বোধে সম্পূর্ণ হওয়া। ভাত-কাপড়ের জন্য শত অন্যায় নারীদের মাথাগুঁজে সহ্য করার নজির অসংখ্য। অন্যায়ের প্রতিবাদের জন্য একক ব্যক্তি প্রচেষ্টা মাঝে মাঝে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার চেয়ে দ্রুততর কার্যকরি হয়। নারী হয়ে স্বীয় অধিকার রক্ষার পাশাপাশি অন্য নারীদের অধিকার হরনের ব্যাপারে সচেতনতা কতর্ব্যের মধ্যেই পরে। এ সচেতনতাটি নিজ পরিবার বলয়ে বহাল রাখা প্রাথমিক কর্তব্য। অনেকে নিজের ও অপরের অধিকার ও তাদের উপর অন্যায়-অত্যাচারের কথা জোড় গলায় ঝড় তুললেও, নিজ গৃহে পরিচারিকাটিকে কিংবা বউ হয়ে শ্বাশুড়ীকে, শ্বাশুড়ী হয়ে বউকে, ননদ হয়ে ভাবীকে বা বৌদিকে, ভাবী বা বৌদি হয়ে ননদকে এবং জা হয়ে জা-কে জুলুম, অত্যাচার ও নির্যাতন করতেই থাকে। নারী অধিকার রক্ষার্থে কতিপয় নারীর এরূপ কর্মকান্ড নারী অত্যাচারের সংস্কৃতি সৃষ্টির মাধ্যমে এর জাতীয়করন করছে; কারন, একটি একটি পরিবারের সমন্বয়েই সম্পূর্ন জাতিটি গঠিত। অধিকার ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সেজন্যই আত্মশুদ্ধিটি প্রাথমিক ভূমিকা পালন করে। ভাল সমাজে অবশ্য এ সংক্রান্ত নীপিড়ন ও অন্যায়গুলিকে যথাযথ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করা হয়।
আবহমান কালের নারী রূপের প্রতিমূর্তিটি কল্পনা করলে যে রূপটি ভেসে উঠে তাতে অসহায় দৃষ্টি, পুষ্টিহীনতা ও ক্লান্তির ছাপ, অনিশ্চয়তা ও ভীতি যেন নারীটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। আমাদের মায়েদের, আমাদের স্ত্রীগণের, আমাদের বোনদের এবং আমাদের কন্যাদের যে হাসিমাখা স্বত:স্ফূর্ত মুখ আমাদেরকে সচল ও সফল রাখার প্রণোদনা দেয়, তাতে অসহায়ত্ব, ভীতি ও অনিশ্চয়তার চিহ্ন আমাদেরকে এটিই বুঝিয়ে দেয় যে, আমরা সত্যিকার অর্থে অচলাবস্থার দিকে সচল অথবা সফল ভাবেই ব্যর্থ। এখানে ‘আমরা’ বলতে পুরুষদেরকে নির্দিষ্ট করা হচ্ছে; কারন, মালীর ভূমিকায় যেহেতু পুরুষটি, সেহেতু ফুলের সুস্বাস্থ্যটি তার উপরই নির্ভরশীল। এখানে ফুল রূপ নারীর ভূমিকা রং-রূপ-ঘ্রাণে জীবনকে মাতিয়ে রাখা; আর মালীরূপ পুরুষের কাজ গাছটিকে রক্ষা করা ও সজিব রাখা। ফুলটির অবদান বুঝতে অপারগ পুরুষটির পক্ষেই সম্ভব গাছটিকে পদদলিত করে রংহীন-কুৎসিত-দুর্গন্ধময় একটি জীবনের সূচনা করা। ফুলের অবদান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথেই মালীর অবদান সুস্পষ্ট হয়। পুরুষটি মালীর ভূমিকায় থাকার ব্যাপারে অসম্মত হতে পারে; তদ্রূপ, নারীটিও ফুলের ভূমিকা পালনে অপারগতা প্রকাশ করতে পারে। ফুলের ভূমিকা আপাত:দৃষ্টে সহজ মনে হলেও, অবদানটির ফল রূপে বাস্তবায়নে অদৃশ্য অন্তক্রিয়ার বিস্তৃতি যে কম নয়, তা বিচক্ষণ মালীটির অনুধাবন যোগ্যতায় প্রবেশ করা অসম্ভব নয়। সুতরাং, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কেউ দুটির একটি কর্ম সম্পাদন করতে পারে। পরিচর্যা ও পানি দানকারীর প্রতি ফুলটি কৃতজ্ঞতাবোধ স্বরূপ তার রং-রূপ-ঘ্রাণ, আর রং-রূপ-ঘ্রাণের বিনিময়ে মালীটিও কৃতজ্ঞতা স্বরূপ অধিকতর ভালবাসায় স্বযত্নে পরিচর্যা অব্যহত রাখবে। এ যেন সুন্দর পৃথিবী রচনায় সম্মিলিত পদচারনা। পুরুষ মনস্তত্ত্বের এ ন্যায়সংগত ও বিশুদ্ধ রূপটির ধারন ও ব্যবহার নারীটিকে, তার অস্তিত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট আহলাদ, সাধ, স্বাদ, স্বাধীনতা ও পূর্ণতা লাভের মাধ্যমে, সম্পূর্ণ বিকশিত থাকতে সহায়তা করবে, এটি নিশ্চিত।
দীন মোহাম্মদ মনির
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।