‘নারীবাদ’ ব্যাপারটা কি, জানতাম না। এখনও যে পুরোপুরি জেনে ফেলেছি, তা নয়। কিন্তু নারীবাদের জ্ঞান অথবা ধারণা ছাড়াই, একজন স্বাবলম্বী মেয়ে হয়ে উঠার ব্রত নিয়ে বেড়ে উঠেছি। এক্ষেত্রে আমার পরিবারের কিছুটা ভূমিকা অবশ্যই আছে। মা বলতেন, ‘তোমাকে এম.এ পাস করতে হবে, তাহলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে।’
সেটা মাথায় রেখেই পথ চলেছি। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ধাপ পেরুতে পেরুতে, নিজের মধ্যেই সমতার ধারণাটা কখন জন্ম নিয়েছে, তা বুঝতেই পারিনি। যে কারণে বাসে উঠলে কখনও আশা করিনি, একজন পুরুষ আমাকে তার সিটটা ছেড়ে দেবেন। ব্যাংকে বিল দিতে গিয়ে, লাইনে না দাঁড়িয়ে কখনও মেয়ে হিসেবে সুযোগের অপব্যবহার করিনি। কেউ সুযোগ দিতে চাইলেও, সেই সুযোগ গ্রহণ না করে, নিয়ম অনুযায়ী লাইনে দাঁড়িয়ে বিল দিয়ে এসেছি। ক্লাশের ছেলেদেরকে বা শিক্ষকদেরকে মিষ্টি হাসি দিয়ে, নোট বা সুবিধা আদায় করতে চাইনি। সেজন্য আমি খুব একটা জনপ্রিয়ও ছিলাম না। সেটা নিয়ে আফসোসও হয়নি কখনও। যখন মেয়েরা স্বপ্ন দেখে বরের গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াবে, তখন আমি ভাবতাম, বরকে পাশে বসিয়ে গাড়ি হাকিয়ে বেড়াবো। বরের কাছ থেকে নয় বরং আমি বরকে গাড়ি উপহার দেব। সেই স্বপ্ন আমি একদিন পূরণ করতে পেরেছি।
এসব আমাকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি। কোন নারীবাদী বইও পড়তে হয়নি। বরং একটি গল্পের বই আমাকে নারী হিসেবে কেমন হওয়া উচিৎ, তা কিছুটা বুঝতে শিখিয়েছিল। তা হল ‘সাতকাহন’। মনে মনে কখনও কখনও দীপাবলীর মত হতে চেয়েছি।
আমার কাছে ‘নারীবাদী নারী’ অর্থ হলো, নিজের পায়ে দাঁড়ানো একজন স্বাবলম্বী মানুষ। যে কারো মুখাপেক্ষী হয়ে বেঁচে থাকে না, বরং নিজের জীবন নিজে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে। নিজস্ব অধিকার ও সম্মান রক্ষা করতে পারে। নিজের মতামত প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
নিরক্ষর, অল্প শিক্ষিত, অসহায় মেয়েদের কথা না হয় বাদই দিলাম, আমরা শিক্ষিত মেয়েরা কি করছি? শিক্ষিত অনেক নারীই ‘নারীবাদ’ ‘নারীবাদ’ বলে গলা শুকিয়ে ফেলি, কিন্তু কোন দায়িত্ব কাঁধে নিতে চাইনা। সংসারে/সমাজে সমান অধিকার পেতে চাই, কিন্তু সমান দায়িত্ব গ্রহণে এগিয়ে যাইনা।
শিক্ষিত হয়েও অন্যায়কে মুখ বুঝে সহ্য করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রুমানা মন্জুরকে নিশ্চয়ই আমাদের মনে আছে। শিক্ষিত, স্বাবলম্বী হবার স্বত্বেও তাকে চোখ দুটি হারাতে হয়েছিল। অথচ শুরুতেই রুমানা যদি প্রতিবাদ করতো, সমাজের পরোয়া না করে সংসার ভেঙ্গে দিত, তাহলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতো না। নিজের সম্মান নিজেকেই রক্ষা করতে হয়। একজন শিক্ষিত, স্বাবলম্বী মেয়ে যদি তা না পারে, তাহলে কে পারবে?