নিঃশব্দ আততায়ী । গল্প । এস এম জাকির হোসেন

  
    

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল কাজলের। ধড়মড় করে উঠে বসলো। সারা ঘরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাথার পাশের বেড সুইচটা জ্বেলে দিতেই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো চারিদিক। তবে কি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল সে? কী ভয়ানক! টকটকে লাল আগুনের শিখাটা ক্রমশ এগিয়ে এসে গ্রাস করছিলো তাকে। শরীরে কী অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিলো তখন!

রাত একটা। এই শীতের রাতেও দরদর করে ঘামছে কাজল। গাঁয়ে হাত দিয়ে দেখে সারা শরীর ছুপছুপে ভেজা। পাশের টেবিলে রাখা জগ থেকে ঢকঢক করে গোগ্রাসে পানি খেল। চোখে ভেসে উঠলো সন্ধ্যার দৃশ্যটি!
শহরের এক-প্রান্তে কাজলের বাস। বাসা থেকে সামান্য দূরেই একটা নদী। এখন যদিও সরু হয়ে আসছে ক্রমশ, শোনা যায় একসময়ের বেশ দাপুটে আর খরস্রোতা ছিল। রাস্তা থেকে নদীর দূরত্ব খুব একটা বেশী নয়। তবে রাস্তা ও নদীর মাঝখানে বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা। এই এলাকায় এখনও লোকালয় গড়ে ওঠেনি তেমন। কিছু হাউজিং কোম্পানি বালু ফেলে ভরাট করছে কেবল, তাই লোকে বলে বালুর মাঠ। সন্ধ্যার পর একটা আলোআঁধারি পরিবেশ বিরাজ করে নদী থেকে রাস্তার মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটায়। মাঝে মাঝে নানা ঘটনা ঘটে এই বালুর মাঠে। খুন খারাপিও হয়। কিছুদিন আগে একটি অপরিচিত লোককে মারাত্মক জখম অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিলো হাউজিং কোম্পানীর লোকজন।
টিউশনী করেই নিজের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে হয় কাজলকে। প্রতিদিন নদীর পাড়ের এই রাস্তা ধরেই ফেরে সে। আশেপাশে বাড়িঘরের সংখ্যা খুব একটা না থাকায় সন্ধ্যার পর এই এলাকাটা বেশ নীরব হয়ে যায়। এখানে দশটা মানে অনেক রাত।

আজ টিউশনী শেষে ফিরতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিলো কাজলের। নদীর পাড়ের রাস্তা ধরে ফিরছিলো। চারিদিকে সুনসান নিরবতা। ক্রমশ এগিয়ে প্রথম বাঁকটার কাছে আসতেই আচমকা নদীর দিক থেকে ঠাণ্ডা বাতাসের একটা ধাক্কা লাগে গায়। কাজলের গা ছমছম করে ওঠে। গাঁয়ের ছেলে হলেও এই মুহূর্তে কেন জানি ভয়টাকে তাড়াতে পারছে না। সামনের পথটুকুর দিকে তাকায়। আরও প্রায় মিনিট পনেরোর মত পথ বাকি, তারপর একটা মোড়। ওখানে পৌঁছুতে পারলেই লোকালয়।
হঠাৎ বাঁচাও বাঁচাও বলে একটা চিৎকার ভেসে আসে। কাজল এদিক-ওদিক তাকায়। শব্দের উৎস খোঁজে। কেবলই মনে হয় নদীর দিক থেকে ভেসে আসছে চিৎকার। কাজল তাড়াতাড়ি পা ফেলে সামনে এগিয়ে চলে। কিছুটা এগোয়, আরও বেশ কিছু পথ বাকি। আবার সেই চিৎকার। রাস্তা থেকে কিছুটা নিচে মাঠের মধ্যে একটা ছোট গাছ। গাছটা থেকে আরও কিছুটা সামনে দৃষ্টি পড়তেই ভিতরটা কেঁপে ওঠে কাজলের। একটা মস্তকবিহীন দীর্ঘকায় মানুষ চিৎকার করতে করতে এদিকেই এগিয়ে আসছে; তার সারা শরীরে আগুন জলছে। পেছনে তাড়া করে আসছে কিছু ছায়ামুর্তি। কিছুক্ষণের জন্য কাজলের পা দু’টো যেন ওখানেই আটকে যায়। সম্বিত ফিরে পেয়ে মুহূর্তকাল বিলম্ব না করে সোজা সামনের দিকে দৌড়ায়। পেছনে বাঁচাও বাঁচাও বলে ক্রমাগত চিৎকার ভেসে আসে।
লোকালয়ে পৌছার আগে কাজল আর থামে না। মোড়ের চায়ের দোকানের সামনে হাঁপাতে থাকে। উৎসুক লোকজন সবারই জিজ্ঞাসা কি হয়েছে, এমন করে হাপাচ্ছে কেন সে। কাজল পেছনের ঘটনা খুলে বলে। কেউ কেউ বলে, এই জায়গাটা ভাল না। এরকম নানান ঘটনা অনেকেই দেখেছে। অনেকেই উপদেশ দেয়, এই পথে বেশী রাত করে ফিরবেন না।
বাসায় ফিরে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে। এখন হঠাৎ স্বপ্নে সেই আগুন দেখে চমকে উঠলো।

আসাদ আজও আসেনি। দুই সপ্তাহ হল বাড়ি গেছে। কবেই তো ফেরার কথা। তবে কি বাড়ি থেকে রওনা হয়নি? চারিদিকের যা অবস্থা! আসবে কি করে? এত দূরের পথ, তার উপর আজ কতদিন ধরে গাড়ি চলাচলও বন্ধ। ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ে কাজল।
কাজল, কাজল, দরজা খোল…। নিজের নাম ধরে ডাকার শব্দে আবার ঘুম ভেঙে গেল কাজলের। দরজায় কড়া নড়ার শব্দ হচ্ছে। মোবাইলে সময় দেখে, রাত দুইটা। আবার কড়া নড়ার শব্দ।
কে?
আমি আসাদ। দরজা খোল, বড্ড ভয় লাগছে।
কাজল উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢোকে আসাদ। ভয়ে কেমন ফ্যাকাসে হয়ে আছে।
কী রে! তুই এত রাতে কোত্থেকে এলি?
বাড়ি থেকে ফিরলাম।
কিন্তু এত রাতে!
রাস্তায় গাড়ি আছে? অনেক কষ্ট করে আসলাম, তাইতো দেরী হয়ে গেল।
বাড়ি থেকে ফিরেছিস, তোর ব্যাগ কোথায়? আর তোর মোবাইলে কি হয়েছে? আজ সন্ধ্যায়ও কত চেষ্টা করলাম তোর নম্বরে! পেলাম না।
সব হারিয়ে গেছে।
হারিয়ে গেছে! কিভাবে?
আমরা যে বাসটাতে ফিরছিলাম, হরতালকারীরা ওটায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। বাস থেকে বের হতে গিয়ে সবকিছু হারিয়ে গেছে।
বলিস কি! ব্যাগ, মোবাইল হারিয়েছে যাক, ভাগ্য ভাল যে তোর কিছু হয়নি।
আসাদ চুপ করে থাকে। তারপর বলে,
কাজল, কত লোক পুড়ে গেছে! সে এক ভয়ানক দৃশ্য।
কাজলের মন খারাপ হয়ে যায়। সন্ধ্যার ঘটনা আর রাতের স্বপ্নের কথা আর বলে না আসাদকে। মনে মনে ভাবে, এতো রাতে এই পথ দিয়ে কি করে আসলো আসাদ?
অনেক ধকল গেছে। যা, এখন ঘুমিয়ে পড়। সকালে কথা হবে।
সকাল হয়। ঘুম থেকে জেগে কাজল দেখে আসাদ ঘরে নেই। কাজলও টিউশনীতে বেরিয়ে যায়।
সারাদিন টিউশনী, ক্লাস শেষে বাসায় ফিরতে প্রতিদিনই সন্ধ্যা হয়ে যায় কাজলের। আসাদেরও তাই হয়। দু’জনের দেখা হয় কেবল রাতে আর ছুটির দিনে। দু’জন বাল্যবন্ধু। একই গ্রামে বাড়ি ওদের। ছেলেবেলা থেকেই একসাথে বেড়ে ওঠা, তাই ঢাকায় বসতিটাও গেড়েছে একই ঘরে। বিপদে-আপদে দু’জন দু’জনের পাশে থাকে।

সারাদিন শেষে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে কাজল। আসাদ তখনও ফেরেনি। মনে মনে ভাবে হয়ত কাজ শেষ হয়নি। সময় হলেই ফিরবে।
আসাদের জন্য অপেক্ষা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়ে একসময়। ঘুমের মধ্যেই আবার দরজায় কড়া নড়ার শব্দ। বেড সুইচ টিপে আলো জ্বালে কাজল। রাত একটা। বিছানা থেকে নামতে নামতেই জিজ্ঞেস করে কাজল,
কে?
আমি আসাদ, দরজা খোল।
তুই আজও এত দেরী করলি ক্যান? এত রাত পর্যন্ত বাইরে কি কাজ তোর?
একটা জরুরী প্রয়োজনে আটকে গেছিলাম।
কি এমন জরুরী প্রয়োজন তোর যে এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকতে হয়?
হাসপাতালে গিয়েছিলাম।
হাসপাতালে কেন? কে আছে ওখানে?
কত মানুষ! তাদের আর্তনাদে হাসপাতালের বাতাস ভারী হয়ে আছেরে কাজল।
কিন্তু তুই কার কাছে গেছিলি?
কার কাছে আবার? আহত মানুষদের কাছে।
তুই সারাদিন হাসপাতালে ছিলি?
হ্যাঁ, আর কোথায় যাব?
তোরে অনেক বিধ্বস্ত লাগছে, এখন ঘুমা।
ঘুম যে আসে নারে কাজল। আগুনে পোড়ার যে কি যন্ত্রণা! তুই না দেখলে বুঝবি না।
ঠিক আছে, কাল হাসপাতালে যাবার সময় আমাকে নিয়ে যাস।
তোকে নিয়ে যেতে হবে কেন, তুই নিজেই তো যেতে পারিস। বার্ন ইউনিটে গেলেই সব দেখতে পাবি।
আচ্ছা যাব। তুই এখন ঘুমা।
আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে দু’জন।

পরদিন সকালেও আসাদের সাথে দেখা হয় না কাজলের। ঘুম থেকে উঠতেই দেখে আসাদ ঘরে নেই। প্রতিদিনের মত কাজলও তার প্রয়োজনে বেরিয়ে পড়ে। যথারীতি রাতে ঘরে ফেরা। তবে সেই রাত্রির ঘটনার পর আর রাত করে ফেরে না কাজল। আসাদের জন্য অনেক রাত অবধি অপেক্ষা করে অবশেষে গুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে সে…
একটা ধূধূ ফাঁকা মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছে কাজল। সে মাঠের আশেপাশে কোন গাছপালা কিংবা লোকালয় নেই। নিরালা-নির্জন গা ছমছমে পরিবেশ। হঠাৎ অনেক দূর থেকে একটা চিৎকার ভেসে আসে। কাজল থমকে দাঁড়ায়। ক্রমশ জোরালো হচ্ছে শব্দটা। মনে হচ্ছে চিৎকার করতে করতে তার কাছে এগিয়ে আসছে কেউ। কণ্ঠস্বরটা বেশ পরিচিত লাগে কাজলের। ওখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। অনেকক্ষণ পর একটা অবয়ব চোখে পড়ে। দৌড়ে আসছে তার দিকেই। ধীরে ধীরে আরও কাছে এগিয়ে আসছে সে। কাজল একবার ভাবে ঘুরে দৌড় দেয়। কিন্তু কেন জানি পারে না। কোন এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে আটকে রাখে। হঠাৎ দূর থেকেই লোকটি চিৎকার করে বলে,
কাজল, আমাকে বাঁচা।
নিজের নাম শুনে থমকে দাঁড়ায় সে। কিছুটা কৌতূহলী হয়ে ওঠে। চিৎকার করতে করতেই লোকটা একেবারে সামনে এসে পড়ে। লোকটার দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে কাজল। দৃশ্যটা বীভৎস। লোকটার সারা শরীর আগুনে ঝলসানো, জয়গায় জায়গায় ফোসকা পড়া। লোকটা কাজলের উদ্দেশ্যে বলে,
আমাকে বাঁচা, কাজল।
কে? অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করে কাজল।
আমি আসাদ।
আসাদ! তোর এ অবস্থা কেন?
আমি মরে যাচ্ছি, আমাকে বাঁচা।
তোর গায় আগুন লাগলো কখন?
ওরা আমাকে বাঁচতে দিলো না। আমি মরে যাচ্ছি। কাজল, তুই আমাকে বাঁচা।
কাজল কোন কথা বলতে পারে না। যেন শক্ত সাঁড়াশির মত একটা হাত ওর গলা চেপে ধরেছে। শ্বাস নিতে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিলো কাজলের। ধড়মড় করে উঠে বসে সে। সারা শরীর ঘামে ভেজা। তখন ঘড়িতে রাত আড়াইটা। স্বপ্ন এত ভয়াবহ আর বীভৎস হয়!
আজ দু’দিন হল ঘরে ফেরে না আসাদ। দিনরাত হাসপাতালে কি করে ও? কাজল ঠিক করে আজ একবার হাসপাতালে যাবে। ওকে নিশ্চয়ই হাসপাতালে পাওয়া যাবে।

সকালে উঠে যথারীতি টিউশনীতে বেরিয়ে পড়ল কাজল। টিউশনী শেষে আজ আর ক্লাসে যায় না সে। হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। হাসপাতালে সামনে পৌঁছে দেখে ভিন্ন এক চিত্র। মেইন গেটে লোক গিজগিজ করছে। অনেক কষ্ট করে বার্ণ ইউনিটে প্রবেশ করলো সে। সবগুলো ওয়ার্ড পরিপূর্ণ। হাসপাতালের বারান্দায়ও কত লোক ছটপট করছে! সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। কয়েকবার রাউন্ড দিয়েও আসাদকে কোথাও দেখতে পায় না কাজল। হাঁটতে হাঁটতে বারান্দার শেষ মাথায় চলে আসে কাজল। বেরিয়ে যাবার মুহূর্তে একটা অস্ফুট গোঙানি শুনে বারান্দার পাশে আবছা অন্ধকারে ফ্লোরে শুয়ে থাকা একজন রুগীর দিকে ঘুরে তাকায়। লোকটার সারা শরীরে ব্যান্ডেজ বাঁধা আর মুখমণ্ডল পুড়ে জায়গায় জায়গায় কালো ফোসকা পড়ে গেছে। কাজলের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে সে। কাঁপা কাঁপা ঠোঁট দু’টো একটু নড়ে ওঠলো যেন! কি যেন বলতে চায়। কাজল ঘুরে লোকটার দিকে এগিয়ে যায়। কাছে গিয়ে বসতেই চমকে ওঠে।
আসাদ!
আসাদের দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কাজল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার শৈশব-কৈশোরের একমাত্র বাল্যবন্ধুটির দিকে। চোখে ভেসে ওঠে গতকাল রাতে স্বপ্নে দেখা সেই ফাঁকা মাঠের মধ্যে চিৎকার করে ছুটে আসা আসাদের আকুতিমাখা কণ্ঠস্বর- কাজল, আমাকে বাঁচা।

অলংকরণ : দীপংকর গৌতম 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments