নিজেকে যোগ্য করে তুলতে পারলেই বদলে যাবে পৃথিবী – তানজিলা মিম

  
    

অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রাণী  নারী জাতি  প্রতিনিয়ত  কোন না কোন ভাবে নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে ।  পেপার পত্রিকা খুললেই  নির্মম সব নিউজ গুলি চোখের সামনে আসে।  বিষয়টা  আমাকে ভাবিয়েছে বারবার। কেন ? কি কারন থাকতে পারে ? ধর্মতো মেয়েদেরকে স্বাধীনতা দিয়েছে! অন্য ধর্মের কথা বলতে পারব না তবে আমার ধর্ম মেয়েদেরকে সত্যিকার অর্থে ফেমিনিস্ট করেছে! অন্তত আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান তাই বলে।  তাহলে মেয়েরা কেন নির্যাতিত?  আগেরকালের নানী দাদি মা খালাদের দিকে তাকালে দেখি  তাদের অধিকাংশেরি নিজের পরিচয় বলে কিছু ছিল না। তাই তারা মুখ বুজে সংসার করে গিয়েছে। আসলেই কি তাই? আমার দেখা আমার বাবা মায়ের সংসার জীবন ছিল সত্যিকারে সুখের স্বর্গ। আমি কোনদিন আমার বাবা মা কে আমাদের সামনে এমন ঝগড়া করতে দেখি নাই যেটা আমাদের মানসিক বিকাশের অন্তরায় হতে পারত। আমার মা কিন্তু খুব বেশি পড়াশুনা করবার সুযোগ পায় নি। তবে তার সোশাল লাইফ কিন্তু কোন অংশে পিছিয়ে ছিল না। আর   লেখাপড়া কম জানা কিংবা স্টে হোম মাদার হিসেবে তার কোন আফসোসও ছিল না। আমার বাবা, আমার মায়ের উপর ডিপেন্ড করত অনেক । তবে এটা ভাবার কোন কারন নাই যে আমার বাবা বাড়িতে কোন কাজ করতেন না। আমার বাবার মত রান্না অনেক মহিলারাও হয়ত করতে পারবে না। যাইহোক আমি বলছিলাম নির্যাতনের কথা।  এর কারন খুঁজতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করলাম যে আসলে আমরা যা পাই সেটা নিয়ে সন্তস্ট থাকতে পারি না। আবার যা পাই না তা নিয়ে আফসোস থাকে মনের ভেতর। আমরা বর্তমান নিয়ে কয়জন সুখি থাকতে পারি? আমরা কি নিজেকে ভালোবাসি? আমরা কি কাজ করবার আগে ভাবি? না কি ঘটনা ঘটে যাবার পর জল্পনা কল্পনা করি ?  আকাশ কুসুম কল্পনা করে রাজাকো রানিসে পেয়ার হো গ্যায়া  টাইপ সিধ্বান্ত নিয়ে ফেলি?

নিজের ব্যক্তিগত এবং প্রফেশনাল কিছু অভিজ্ঞতার আলোকে আজকের এই লেখাটা লিখতে বসেছি। এছাড়া সাম্প্রতি দুটি নির্মম ঘটনার প্রেক্ষিতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি প্রশ্নের জবাবও এই লেখার মাধ্যমেই দিতে চাই।

প্রথমত আমি বলতে চাই যে নির্যাতন আসলে একচেটিয়া মেয়েদেরই ভাগ্যে ঘটেনা। ছেলেরাও নির্যাতিত হয় কখনো কখনো। তবে নির্যাতিত সে যেই হোক নির্যাতন আমাদের কাম্য না।

দ্বিতীয়ত  প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। এখানে আমি বলব যে এই প্রতিরোধ টা একদম ছেলেবেলা থেকে শুরু করা উচিত। একটা মেয়ে যদি ছেলেবেলা থেকে বুঝতে শেখে যে মেয়ে বলে কোন অংশে তাকে জীবনে পিছিয়ে থাকতে হবে এমন কোন বাধ্য বাধকতা নাই। আবার একজন ছেলেকে  যদি  পরিবার থেকে শেখানো হয় যে মেয়েদের কিভাবে সন্মান করতে হয়। মেয়েদের গায়ে হাততোলা আসলে কাপুরুষের নামান্তর। এই দিয়েই প্রাথমিক প্রতিরোধ শুরু হতে পারে। এটাই হয়ত হতে পারে সামাজিক  ভ্রান্ত ধারনার বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদের শুরু।

এছাড়া আরেকটা কথা বলব যে বিয়ে করাটা যেমন কোন সমাধান না ঠিক তেমনি সংসার ভেঙ্গে ফেলাটাও কোন সমাধান না। দেশের বাইরে থাকা পাত্র পেয়ে তড়িঘড়ি মেয়ের বিয়ে দেবার আগে পাত্র সম্পর্কে ভালোভাবে খোজ খবর করা আমাদের পরিবারের দ্বায়িত্ব । পরিবারের কথা এইজন্য বললাম কারন আমাদের দেশে এখনো বিয়েটা পরিবার পরিজন রাই দিয়ে থাকেন। আর প্রতিটা মেয়েরই উচিত নিজের পরিচয় সৃষ্টি করা। তা সে যত সামান্যই হোক না কেন।

বিয়ের আগে পাত্র কে মার্জিত সীমায় থেকে যাচাই বাছাই করে নেওয়া। অনেক পরিবার আছে ছেলের মাথা  খারাপ তাই  বিয়ে দিয়ে দাও  মাথা ভালো হয়ে যাবে এটিটিউড।  এসব বিষয় আগেই খোঁজ নেওয়া জরুরি।  কারন এগুলি অবিদ্যা। এগুলি ভুল দৃষ্টিভঙ্গি। আসলে প্রথমেই দেখা উচিত যে ছেলেটিকে / মেয়েটিকে  আপনি বিয়ে করছেন তিনি আপনার ভবিষ্যৎ সন্তানের মা /বাবা হবার যোগ্য কিনা।  একে অপরকে সন্মান করতে পারবেন কিনা।  আসলে বিয়ের মত একটা সিদ্ধান্ত আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ঝোঁকের বসে নিয়ে ফেলি, চেহারা দেখে মুগ্ধ হয়ে বা  সামজিক মর্যাদা দেখে  বাকি আর কিছু দেখার দরকার বোধ করিনা। জীবনে বিয়ে করতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নাই। বিয়ে কে বিশাল কিছু ভাববারও কিছু নাই। কারন বিয়ে মাধ্যমে একজন নারী এবং একজন পরুষ একত্রে থাকবার বৈধ অধিকার পায়। বিয়ের মাধ্যমে শারীরিক, মানসিক , আর্থিক, আত্বিক ও  সামাজিক  চাহিদা পূর্ণতা পায়। এছাড়া আর কিছুই না। আর সব দিক বিবেচনা করে  বিয়ের পিড়িতে  যখন বসেই গেলেন  তখন তাকেই শারুখ খান / মাধুরী ভেবে জীবন শুরু করা উত্তম।  আজকাল যেটা হচ্ছে  টেকনলজির কারণে  জগত হাতের মুঠয়। কাজেই অমুকের বউ সুন্দর কিংবা তমুকের হাসবেন্ড অনেক পয়সাওয়ালা এইসব নানা রকম আফসোস মনের মাঝে বাসা বেধে সংসার অসহিষ্ণু করে তোলে।

এই ক্ষেত্রে আমাদের নৈতিক অবক্ষয় কোথায় গিয়ে ঠেকেছে ভাবলেই গা শিউরে ওঠে।  যখন শুনি ৬ বছরের শিশু ধর্মীয় শিক্ষা গুরুর হাতেও নিরাপদ না।  এর মানে কি আমার ধর্ম  এমন অমানবিক আচরণ শিক্ষা দিচ্ছে? না । এর কারন প্রযুক্তি।  প্রযুক্তির অন্ধকার আমরা দেখতে পাইনা।  দেখতে পাইনা বলেই  ঘটনা ঘটে গেলে মিটিং মিসিল করি।  মুল রহস্যের সন্ধান করবার অবকাশ আমাদের নেই। প্রযুক্তিকে আমরা ভাল না কি খারাপ ভাবে ব্যবহার করব  সেই সিদ্ধান্ত আমরা তখনই নিতে পারব যখন আমরা আমাদের ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। আমি অবাক হয়ে দেখি মানুষের  হেট স্পিচ গুলি।  মানুষের মাঝে মমত্ববোধ  বলতে অবশিষ্ট কিছু কি আছে?  বায়বীয় সম্পর্কের বেড়াজালে আমাদের পারিবারিক বন্ধন গুলি কখন যে হারিয়ে যাচ্ছে আমরা কি সে খেয়াল একবার রেখেছি?  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা নিজেদের যতটা  সহজোগিভাবাপন্ন করে প্রকাশ করি বাস্তবেও কি আমরা তাই? আমরা কি পারছি নিজেদের রাগ ক্ষোভ ঘৃণা  হিংসা ঈর্ষার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে?  বাইরে হাসি মুখে কথা বললেও   বাড়িতে আমরা কয়জন প্রিয়জনের কুশলাদি   নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি? সংসার করতে গিয়ে একে অন্যের প্রতি সমমর্মী হতে কি পেরেছি আমরা?

বিদেশ বিভূঁই এই আমাদের আপনজন থেকে লক্ষযোজন দুরে থাকতে হয়।  আমরা কি কমিউনিটিতে এমন সাপোর্ট গোড়ে তুলতে পেরেছি  যেখানে  আমরা  নিজেদের সত্যিকার অবস্থা প্রকাশ করলে জাজমেন্টেড হব না?  প্রতি উইক এন্ড এ দাওয়াত খাওয়া বা দাওয়াত দেওয়া  আমরা কি মনের টানে করতে পারছি?  নাকি প্রতিযোগিতা  চলছে কে কার থেকে বেশি আইটেম করতে পারে?   আমি আসলে কাউকে ছোট বা বড় করবার জন্য কিছু বলছি না। এগুলি আমার মত হয়ত অনেকেরই প্রশ্ন।

আমি আগেই বলেছি মুখ বুজে সয্য করা কখনো কোন সমাধান না।  আমি একবারও বলিনি যে সয্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলেও সংসার টিকিয়ে রাখতে হবে।  আসলে আমার কি মনে হয় জানেন?  আমরা মেয়েরা নিজেরকে সন্মান করতে জানিনা।  কিছু মানুষ আছেন যারা মরে যাবেন অথচ নিজের জন্য সাহায্য চাইতে কুণ্ঠিত বোধ করেন। আবার কেউ কেউ সিস্টেম কে এবিউজ করে  সংসার ভেঙ্গে দিব্যি আছেন। যাইহোক আইনি ভাষায়  হাজার  অপরাধী  পার পেয়ে গেলো একজনও নিরপরাধী যেন বিনা দোষে শাস্তি না পায়। আমি এটা খুব মানি।  আমাদের কে জানতে হবে বুঝতে হবে কতটা  সয্য সীমার মাঝে আর  কতটা সীমালঙ্ঘন। জনে জনে বলে বেড়াবার কথা হচ্ছে না। আর এখানে নিজের পরিচয় গোপন রেখে অনেক সার্ভিস আছে যেখানে টেলিফোনেই সহযোগিতা দেওয়া হয়। আর সব থেকে বড় কথা হল আমরা অস্ট্রেলিয়াতে থাকি।  বাংলাদেশেও আজকাল  অনেক কাউন্সেলিং সার্ভিস শুরু হয়েছে।  আমাদের জ্বর  হলে আমরা যেমন পচে যাই না। ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খাই। ঠিক তেমনই  মনের জ্বর মানেই পাগল না।  বিশেষজ্ঞ এর পরামর্শ নিলে মনের অসুখও ভাল হয়ে যায়।

পরিস্থিতি চরমে যাবার আগেই আসলে এগুলি করা প্রয়োজন। খুনের মত ঘটনা হঠাৎ ঘটে না। এর পেছনে অনেক দিনের রাগ ক্ষোভের জের লুকিয়ে থাকে। তাছাড়া অন্যায়ের প্রতিবাদ না করাটাও কিন্তু অন্যায় কে প্রশ্রয় দেওয়া।  হয়ত  কাপল  কাউন্সেলিং কিংবা বিশেষজ্ঞের সাথে সামান্য একটু কথা বলবার সুযোগ বাঁচিয়ে দিতে পারে অনেক সংসার। এড়ানো   যায় অপঘাতে  মৃত্যুর  মত  নির্মম  ঘটনা।

যারা এখনো ভাবছেন  আমার তো  কোন সমস্যা হচ্ছে না তাদের কে বলি নিজের কথা গুলি  বলার মত সাহসী হন। তবে সবজায়গাতে না।  যেখানে বললে আপনার প্রাইভেসি রক্ষা হবে সেখানেই বলেন। তবে বলেন।  প্রয়োজনে কাপল কাউন্সেলিং করেন।  বিদেশ বিভূঁই জীবনে নানা রকম স্ট্রেস আসতে পারে। যার থেকে সৃষ্টি হতে পারে হীনমন্যতা।  আমরা বাঙ্গালিরা দেশে যে কাজ করিনি হয়ত সেটাই করতে হয় জীবনের তাগিদে।  এইসব  স্ট্রেস সংসারজীবনকে দুর্বিষহ করবার আগেই আমরা প্রতিরোধ  গোড়ে তুলতে পারি।

আর  এসব করবার পরও যদি দেখেন ঠিক হচ্ছে না আজই স্টেপ নিন।  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সুখি হবার নাটক করে ভেতরে ভেতরে সেশ হবার থেকে সুন্দর ভাবে বাঁচতে শিখুন।

আগে জানুন আপনার অধিকার কি কি? নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিন। তবে প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পিছপা হবেন না।

আমার সাথে পারসোনালি যোগাযোগ করতে চাইলে ইমেইল করে জানালেই আমার কন্টাক্ট নাম্বারটি পেয়ে যাবেন।  প্রশান্তিকার সাথেই থাকুন।  আবার নতুন কোন টপিকে আপনাদের প্রশ্ন নিয়ে হাজির হব ইনশাল্লাহ।

তানজিলা মিম
কাউন্সেলর  (মাল্টিলিঙ্গুয়াল কাউন্সেলিং ক্যাফে), কনভেনর  (কোয়ান্টাম মেডিটেশন সোসাইটি মেলবোর্ন )
ইমেইল: proshantika@gmail.com

 

 

 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments