নিজের একটা বাড়ি বনাম নারী । পিয়ারা বেগম

  
    

বর্ষার পানি নামলে বাবা বাড়ি থেকে আমের চারাগাছ ওঠায়ে পুকুরপাড়ে লাগাতেন। আশ্বিন-কার্তিকে বৃষ্টি কমে গেলে গাছের গোড়ায় জগ দিয়ে পানি দিতাম। মুরুব্বীরা বলতেন, আহারে, এত্ত যত্ন করে আম গাছের গোড়ায় পানি দিচ্ছিস। কই যে তুই থাকবি রে বেটি, কই থাকবে তোর আমগাছ! তোর তো নিজেরই তখন বাড়িঘর অইব। শুনে ভাবতাম, এটা কী বলে? নিজের বাড়ি? এটাই তো আমার নিজের বাড়ি। ঘরের বেবাক জিনিষপত্র যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতাম। বলতাম, এটা আমাদের, ওটা আমাদের।

বিয়ের পর আগলেরাখা জিনিষপত্র বেবাক ছেড়ে এলাম শ্বশুর বাড়ি। কিন্তু মন টিকতনা কিছুতেই। উড়নচণ্ডী মন নিজের বাড়িতে আসার জন্য পাগলপারা থাকত। হালে  দেখলাম, নিজের বাড়ি হয়ে গেল বাবার বাড়ি। যেখানে বিয়ে হলো এটা হলো শ্বশুর বাড়ি। কারণ, শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি এলে প্রতিবেশীরা জিজ্ঞাসা করত, কী রে শ্বশুর বাড়ি থাইক্যা কবে আইলি? আবার বাবার বাড়ি থেকে নাইয়র শেষে শ্বশুর বাড়ি এলে বলত, কি গো বউ, বাপের বাড়ি কয়দিন থাইক্যা আইলা? কর্মস্থল থেকে আবার কোন অনুষ্ঠান উপলক্ষে গ্রামের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলে কেউ না কেউ জিজ্ঞাসা করে বাড়ি কোথায়? বলতাম
-ওমুক উপজেলায় তমুক গ্রামে।
– শ্বশুর বাড়ি, না বাপের বাড়ি?
-শ্বশুর বাড়ি।
–  ঢাকায় ভাড়া বাড়ি, না স্বামীর নিজের বাড়ি?
-স্বামীর নিজের বাড়ি।

এমনি করে রাস্তায় রাস্তায় বাড়ি সম্পর্কে ইন্টার্ভিউ দিতে দিতে যেতে হতো। বার্ধক্যে পা রাখলাম। এখনো সেই একই প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে। এটা কেন হচ্ছে? কারণ, আমরা নারী বলে। একজন পুরুষ মানুষকে বড়জোর বাড়ি কোথায় জানতে চাওয়া হয়, এর বেশি কিছু নয়। এতটা বছর পার করে দিলাম এতদিনে বুঝলাম, আদৌ কী নারীদের নিজের বাড়ি আছে? নাকি কখনো ছিল?
জন্মগ্রহণ করলেই কন্যা সন্তানকে বলা হতো পরের পোষ। কারণ, বিয়ে হলে পরের বাড়ি যেতে হয় বলে। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িই নাকি নিজের বাড়ি। কিন্তু বাস্তবে দেখি, বিয়ের আগে বাবার অধীনে। বিয়ের পর একটা সময় শ্বশুর-শাশুড়ির অধীনে তারপর স্বামীর অধীনে। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে মেয়েদের অধীনে থাকার পালাবদল ঘটে। শেষ বয়সে সন্তানদের অধীনে। মানে ছেলের বাড়ি কিংবা মেয়ের বাড়ি। পোড়া কপাল! মেয়ের বাড়ি তো নয়ই, বলে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি কিংবা জামাইর বাড়ি। ধরে নিলাম নিজের নামে কেনা বাড়ি? এটাও কী নিজের থাকে? ‘স্বাস্থ্য’ নামক সম্পদ যখন আর নিজের থাকে না তখন নিজের বাড়িও আর নিজের থাকেনা। বিনা দলিলে দখলস্বত্বের হাতবদল হয়।

তাছাড়া নারীদের নিজের নামে বাড়ি থাকলে-ই-বা কী? নারীদের “নিজের বাড়ি” বলে পরিচিতিটা সমাজে প্রচলিত অর্থে প্রচার পায় না। বাবার নাম বা স্বামীর নামেই পরিচিতি পায়। তারপরেও শেষমুহুর্তে পুরুষদেরও কী বাড়ি থাকে? পৈতৃক সূত্রে যারা বাড়ি পান কিংবা নিজেদের অর্থায়নে যিনি বাড়ি তৈরি করেন তারা-ই-বা কতদিন সেখানে বাস করতে পারেন? মানুষের আয়ু সত্তর-আশি-নব্বই, বড়জোর একশো কিংবা তার চেয়েও কিছু অধিক। এর চেয়ে বেশি তো নয়? এই পৃথিবীতে তো এতটুকুন সময়ের জন্যই আমাদের আসা। তথাপি আমরা কত-ই-না স্বপ্ন-রঙিন বাসগৃহ নির্মাণ করি। শেষমেশ তা কী আর নিজের থাকে? মৃত্যুর ডাক আসলেই সব ছেড়ে চলে যেতে হয়।
অথচ দু’দিনের দুনিয়ায় কদিনের জন্য আতিথ্যগ্রহণ করে কেন আমরা হকদারের হক আত্মসাৎ করি? মৃত্যুর পর সেই তো খালি হাতেই যেতে হচ্ছে সব্বাইকে। তবে কেন কিছু কিছু মানুষ কন্যা সন্তানদেরকে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেন? উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার সম্পত্তির একজন মেয়ে তার এক ভাইয়ের অর্ধেক সম্পত্তির মালিক হন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় কোন কোন পিতা জীবদ্দশায় মেয়েদেরকে ঠকিয়ে ছেলেদের সম্পত্তি লিখে দিয়ে যান। কখনো ভাইয়েরা বা পরবর্তী প্রজন্মরা আত্মসাৎ করে নিজেদের নামে রেকর্ড করে নেন। উদ্দেশ্য, ভবিষ্যতে কোন ওয়ারিশ যেন অধিকার সত্ত্ব দাবী করতে না পারে। অতীতে মেয়েরা বাবার বাড়ির সম্পত্তির অংশের ভাগ কখনো দাবী করত না। ভাইয়েরা উৎসব-পার্বণে বোনদের তত্ত্বতালাশ করত। এইটুকুতে তারা সন্তুষ্ট থাকত। বর্তমানে জমিজমার দাম বেড়ে যাওয়ায় কোন কোন পরিবারের মেয়েরা তাদের পাওনাটুকু দাবী করে। দাবী করাটা কোন অন্যায় আবদার নয়। তবে ভাই-বোন মিলে আপোষ-সমঝোতার ভিত্তিতে একটা সুষ্ঠু সমাধানে আসা যায়। এতে ভাই-বোনের সম্পর্কও অটুট থাকে। কিন্তু সমস্যা বাঁধে তখনই যখন হক অনাদায়ে ভাইয়েরা ষোলআনা অনড় অবস্থান নেয়।

সমাজে মেয়েরা কখনো মা, কখনো বোন, কখনো কন্যা, কখনো স্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন। আবহমান বাংলার নারী হৃদয়ে বিশ্বজনীন স্নেহ- মমতার এক দুর্লভ ভান্ডার আছে। তাই তো স্ব স্ব অবস্থানে থেকে নারীরা নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে এতটুকু অবহেলা করেন না। আবার বাবারাও ছোট বেলা মেয়েদেরকে কত-ই-না ভালোবাসেন। আর ছোট বেলা ভাই-বোন সম্পর্কটাও স্নেহমমতার মাধুরীতে ভরপুর থাকে। কিন্তু সেই তারাই আবার হক আত্মসাৎ করার পায়তারা করেন? মূলত সম্পদই যেন সব। সম্পর্ক বলতে আসলে কিছুই নেই। তাই তো শেষমেশ সম্পর্কের ভিতকে নড়বড়ে করে দেয় সম্পদ। কিন্তু তারা অবশ্যই জানেন, একটি আল্লাহর হক, একটি বান্দার হক। আল্লাহর কোন বিধান লঙ্ঘন করে ফেললে পরে নতচিত্তে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ ক্ষমা করতে পারেন। কারণ,আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল ও দয়ালু, তাঁর দয়ার কোন শেষ নেই। কিন্তু একজন বান্দার প্রতি অন্য বান্দা কোন অন্যায় করলে বা হক আত্মসাৎ করলে আল্লাহ তা ক্ষমা করেন না, যতক্ষণ না ঐ বান্দা এজন্যে ক্ষমা না করেন। তাই বলছি, এমন গর্হিত পাপ করে তাদের কী এতটুকু অনুশোচনা আসেনা? অপরাধবোধ কী তাদেরকে এতটুকুন তাড়া করেনা? না-ই যদি করে তবে কী তারা এসবের উর্ধ্বে? তাই যদি না হয় তবে অনৈতিক ভাবে বা অন্যের সহায়-সম্পত্তি আত্মসাৎ করে যারা ভোগদখল করছে তারা কী আদৌ সুখী? যদি সুখী হন তবে বলার কিছু নেই। আর যদি সুখী না হন তবে আমার দু’খান কথা আছে। আত্মসাৎ করা অর্থ-সম্পদ বা অসৎ পথে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সুখই যদি কিনতে না পারেন তবে অন্যের হক নষ্ট করে অনৈতিক পথে অর্থ-সম্পদ যোগার করার জন্য এতটা দৌড়ঝাঁপ কেন?

২৭/০৭/২০২১, নারায়ণগঞ্জ।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments