শুধু বিয়ে, সংসারের মত একটা সাময়িক পার্থিব বন্ধন বা সম্পর্ক যাই বলি, অনেকেরই এক জীবনে ঠিক ঠাক কাজ করেনা। দেশে দেশে এই সম্পর্ককে ঘিরে আছে একটা মানুষের পুরো জীবন আবহ বদলে যাওয়ার নানা আয়োজন। থাকে ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক আচার আচরণ এবং প্রত্যক্ষ পরোক্ষ নানান চাপিয়ে দেয়া বিষয়াদি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশীর ভাগ বিবাহিত মানুষ, সময়ের সাথে সাথে সেই সবকিছু মেনে নেয়, মানিয়ে নেয়! এরপর ‘’তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো’’ বা ”আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম” এই রকম এক ঘোরেই ‘বিভোর’ হয়ে কাটিয়ে দেয় বিবাহিত একটা জীবন!!!
সময় অল্প অল্প করে বদলাচ্ছে। আমাদের নানী-দাদী, মা-খালা-মাসী-পিসি, বড় ভাই/বোন এবং এই ‘’আমরা’’ থেকে সময় অনেকটাই বদলেছে। এই সময়ের অনেক ছেলেমেয়েই নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে পারছে অনেক অবলীলায়। বিয়ের মত বিষয়টাতে জড়ানোর আগে বা পরে ভীষণ করে নিজের মতামত রাখতে পারছে। বিয়ে সম্পর্কটা এঞ্জয় করতে দুজনকেই দেখা যায় অনেক বেশী সচেষ্ট এবং কোন কারণে সেটা ওয়ার্ক আউট না করলে সিদ্ধান্ত নিতেও দেখা যায় ঠিক সময়েই, অনেককেই!
এবং আজকাল খুব স্বাভাবিকভাবেই একটা সম্পর্ক থেকে বের হয়ে অন্য একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন অনেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে পূর্ব সম্পর্কের তীক্ততা ভুলে গিয়েই!!!
বিয়ে মানেই, অনেকগুলো স্যাকরিফাইস, নুতন কিছুতে অভ্যস্ত হওয়া এবং জীবন থেকে কিছু সংযোজন, বিয়োজন। বলাই বাহুল্য, ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে ঘর বাঁধলে এক রকম হিসেব নিকেশ আবার ভালো না বেসে ঘর বাঁধলেও নুতন একটা মানুষকে ঘিরেও অনেক সময় সবকিছু ইতিবাচক হতে পারে দুই পক্ষেরই।
একটা মেয়ে যে এক সময় বয়েস হওয়ার পর ধারে কাছে কেউ থাকলেও ঘুমাতে পারতোনা। সেই মেয়েটাই বিয়ের ২/৪ বছর পর, একটা হাত তাকে ছুঁয়ে না থাকলে হয়তো ঘুমাতেই পারেনা।
যে ছেলেটা কিচেনে ঢুঁকে কোন কাজ করাকে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম কাজের একটা মনে করতো, সেই দেখা যায় সঙ্গিনীর জন্যে বিকেল ছোঁয়া সন্ধ্যায় দুই কাপ চা/কফি বানিয়ে এক সাথে বসে কিছু সময় কাটানোটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় কাজের একটা মনে করে।
জীবনের এমন সব আয়োজনে মেতে অনেকেরই জীবন আগায় কাঙ্ক্ষিত রূপেই। উপভোগ করে দুইটা জীবন জীবনেরই নব নব আনন্দ। অনেকের হিসেব নিকেশে হঠাৎ এসে যায় গোলমাল। ভালোবাসার টান, শ্রদ্ধা, অশ্রদ্ধা, সম্পর্কে পরিবারের অন্য মানুষের ঢুঁকে যাওয়ার মত বিষয়গুলো নিয়ে সাময়িক টানা পোড়েনে কেউ ভোগেন দীর্ঘ মেয়াদী, কেউ সেটা কাটিয়েও উঠেন।
কেউ কেউ পারেনা আর কিছুতেই জীবনে ফিরতে। না পাওয়াটা তীব্র থেকে তীব্রতর হলে, কোন না কোন সময় ঠিক সেটা ফুঁসে উঠে। অনেক বেশী সমস্যা মোকাবেলা করতে যেয়ে, অনেকে ভেতরে অনেক স্ট্রং হলেও, ক্লান্ত হয়ে পড়ে, জীবন থেকে টুপ করে হারিয়ে যান নীরবে, অলক্ষ্যে শারীরিক এবং মানসিকভাবে!!!
আরো একজন বাংলাদেশী মেয়ে, সিডনী প্রবাসী, নিরুপমা, গতকাল মৃতদেহ পাওয়া গেছে তাঁরই বাড়ীর গ্যারেজে। আরো একজন বলছি, এর মাঝেই এমন নিউজ আরো পেয়েছি আমরা। প্রাথমিকভাবে জানা যাচ্ছে হাজবেন্ড নামক পরিচয়ে থাকা মানুষটিই তাঁকে মেরে ফেলেছে। যে সময় নিরুপমার অবুঝ দুই ছেলে মেয়ে ঘরে ঘুমাচ্ছিলো।
এখানে থাকা প্রবাসীরা এই নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন, নানানভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। সমস্যায় থাকা কারো না কারো হয়তো কাজে লাগবে। আমি এমন অনেকের সমস্যা খুব কাছ থেকে দেখেছি, আন্তরিকভাবে কাজ করেছি পজিটিভ সমাধানের, পেরেছিও কখনও কখনও।
অনেক সময় আন্তরিক ইচ্ছে থাকা সত্বেও আর কিছু করা যায়না কিছু সম্পর্ককে নুতন করে জোড়া লাগাতে। ইন ফ্যাক্ট লাগানোর চেষ্টাও করা উচিত না অনেক ক্ষেত্রেই।
এমন না যে, নিজ জীবনে সমস্যা নেই। সে রকম হলে, সমস্যা খুব কাছের দুই একজন বন্ধুর সাথে শেয়ার করি, যাদের খুব ভালোবাসি, আস্থা রাখি। কাউন্সেলিং নিজেও নিজেকে করি। সব সময় সব কিছু নিজের মত করে পাইনা, বা ভাবনা কাজ করেনা। তারপরও নিজের ভিতরের ইতিবাচকতা দিয়ে চেষ্টা করি জীবনকে বেঁধে রাখতে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে।
দাম্পত্য কলহ কম আর বেশী সব পরিবারেই আছে। কেউ কেউ আছে ডিনার মেন্যু এটা না হয়ে কেন ওটা হলো, বাসার সোফা, উয়াইফ বলেছিলো ওটা কিনতে, কিন্তু সেটা না কিনে হাজব্যান্ড কেন অন্যটা কিনে ফেললো এই নিয়েই একবেলা না খেয়ে থাকার মত একটা ঝগড়া হয়ে যেতে পারে।
কিছু সমস্যা এমন নয়।
দুইটা মানুষের আর্থিক বা পারিবারিক কোন টানা পোড়েন না থাকা সত্বেও নিজেদের মাঝে হঠাৎ সুর কেটে যেতে পারে। দুজনের কেউ একজন আবিষ্কার করতে পারেন, যার সাথে আছেন সে আসলে তার জীবনে ভুল মানুষ। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষেরা চেষ্টা করে সেটা নিয়ে কাজ করতে। সময় নিয়ে আবার ফিরতে… না পারলে, নিজেদের মাঝে, বোঝাপড়াটা যতোই কঠিন হোক সময়ে ঠিক করে নেন সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত একজন আরেকজনের জীবন থেকে।
কিছু সমস্যা এই ছকের মাঝে থাকেনা। দুটি মানুষের ব্যক্তিত্ব এবং সমস্যাগুলো পুরোপুরিই দুই মেরুর হয়ে যায়। তাকে এক বীণাতে এনে সুরে বাঁধার সাধ্য প্রকৃতির বাইরে যায় চলে।
আর এমন সম্পর্ককে পিছনে ফেলে আবার এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখার সাহস রাখেনা অনেকেই। অনেক ক্ষেত্রে নিজের ইমেজ, পারিবারিক মূল্যবোধ, সামাজিক চাপ সব নিজের মাঝে নিয়ে দিনের পর দিন চেষ্টা করে যায় মানিয়ে নিতে।
আমাদের এই পরবাসে কাছের কারো এমন সমস্যা হলে, আপনি আমি কোন না কোনভাবে তার বন্ধু হলে, আমাদের কী কিছু করার আছে? আমি মনে করি আছে, চেনা হলে, কাছের হলে তো আছেই, অচেনা হলেও আছে। ধরুন আপনার জুনিয়র, সিনিয়র, স্বল্প পরিচিত বা বন্ধু আপনার সাথে তার সমস্যাটা শেয়ার করলো, আপনি ঠিক কী করতে পারেন; আমি আমার মত করে বলতে চাই…
১। আপনি আপনার বন্ধুকে মানসিকভাবে সবটুকু সাপোর্ট দিন। তাঁর সঙ্গী/সঙ্গিনীকে ছোট না করেও তাকে সবার আগে যা বলা উচিত স্ট্রং হয়ে বিষয়টা মোকাবেলা করতে।
২। আক্রান্ত সে যেই হোক যদি হুমকীর মুখে থাকে তাকে এই রকম একটা সভ্য দেশে বসবাস করার নুন্যতম সুবিধাটুকু নিতে বলুন।
৩। কেউ কাউকে দিনের পর দিন এবিউজ করে এবং যাকে করা হচ্ছে, সে যদি তা মোকাবেলায় যথেষ্ট স্ট্রং এবং ক্যাপাবল না হয় তবে অবশ্যই বিষয়টা কাউন্সেলিং পর্যায়ে নেওয়া উচিত।
৪। কারো জানের উপর হুমকী আছে, আপনি আমি জানলে সবটুকু আন্তরিকতা নিয়ে তাকে সেখান থেকে সাময়িক হলেও বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করা উচিত। এরপর পরিস্থিতিই বলে দেবে করণীয়।
৫। এই লেখা পড়ছেন, পারিবারিক সমস্যায় আছেন, এমন কেউ হলে প্লিজ, আর যাই হোক ভাবুন বিশাল এই পৃথিবী এখানেই শেষ নয়। এর বাইরে আছে অনেক মানুষ যাঁদের কেউ না কেউ আপনাকে খুব ভালোবাসে, আপনি ভালো থাকুন এটাই চায়। কেন নয় তাঁদের কথা ভেবে শুধু একটা মানুষকে ছেড়ে অন্ধকার এই পৃথিবী ছেড়ে পালান আজই, সময় থাকতেই।
প্লিজ শেয়ার ইউর প্রব্লেমস, কারো না কারো সাথে, শেয়ার করা মানুষটা যদি আপনি হউন, সহানুভূতিশীল হউন. জাজমেন্টাল হবেননা। এক কথায় অন্য কারো সাথে এই আলোচনায় যাবেননা যে, অমুক বা তমুক খুব খারাপ!!!
খুব কাছ থেকে দেখা এক মেয়ের কথা দিয়ে শেষ করি আজ। না বিয়ের মত ব্যপারটা খুব দুর্দান্ত রুপে কাজ করেনি তাঁর জীবনে। একটা সময় পর্যন্ত নিজেকে নানানভাবে শাপ শাপান্ত করলেও সেই মেয়েটি তা কাটিয়ে উঠেছে। ভদ্র মহিলা, লম্বা সময়ের সংসার এবং একমাত্র সন্তানের যে বাবাকে নিয়ে এক ছাদের নীচে আছেন বলাই বাহুল্য, এটাকে ওভাবে সংসার বলা যায়না। আর দশটা পরিবারের ছকে তো নয়ই। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, কেন এবং কিভাবে আছেন এক ছাদের নীচে। সে বলতে থাকেন, না আমার সন্তানের বাবাকে ঘিরে আমার কোন কমপ্লেইন নেই। যা আছে, নিজের উপর, সঠিক সময় অনেক ব্যাপারে সঠিক ডিসিশন নিতে পারলে আমাদের দুজনের জীবনই হয়তো অনেক উপভোগ্য হতে পারতো। শুধু বিয়েটা কাজ করেনি তাই জীবন আমার আজও থেমে যায়নি। তারপরও আমি জীবনকে ভালোবাসি। একজন আরেকজনকে মেরে ফেলার অবস্থা হয়তো আজ নেই। আজও আমরা আছি একসাথে, কালকের কথা জানিনা। তবে এখনও খুব খুব চাই আমার জন্যে আমার সঙ্গীর জীবন যেন বিষাক্ত না হয় আর একটি দিনও। সেও তাঁর জীবনটা উপভোগ করুক ভীষণ করে নিজের মত করে, আমিও এই বিপুলা পৃথিবীতে মুক্ত বাতাস নিয়ে বাঁচি আমৃত্যু।
এই পরবাসে আছেন সেই মেয়েটি ভীষণ দৃঢ় চিত্তে আরো বলেন, আমি যা বলতেই চাই, ”নিজের মত করে নিজের একটা জগৎ থাকা খুব বেশী জরুরী এখন পর্যন্ত আমার জীবনের অন্যতম দর্শন এটাই’’ বেঁচে থাকুন বেঁচে থাকাকে ভালোবেসে !!!
আমিও তাঁর সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলি এই কথাই আজ ‘’জীবন ভালোবাসাময় না হলে, বেঁচে থাকাটা উপভোগ্য হতে পারেনা, বেঁচে থাকাটাকে ভালোবাসা যায়না’’!!!
আহ নিরুপমা, কেউ কী ছিলোনা তাঁর পাশে, এই নিষ্ঠুর কালো থাবা থেকে সরিয়ে স্বাভাবিক পৃথিবীতে নিয়ে যেতে, যে তার এই অকাল মৃত্যু ঠেকাতে পারতো? কোথাও কী কেউ ছিলোনা, ওর কী কোন বন্ধু ছিলোনা!!!
ওর কন্যা সন্তানদের জন্যে এই পৃথিবী কতোটা সদয় হবে জানিনা, শুধু মন থেকে হৃদয়ের সবটুকু রক্তক্ষরণ চাপা দিয়ে চাইছি, ওরা যেন এই নিষ্ঠুরতা ভুলে বেঁচে থাকতে পারে, আহা জীবন, আহারে জীবন!!!
নাদিরা সুলতানা নদী
কলামিস্ট/উপস্থাপক
সাংস্কৃতি কর্মী
সহযোগী সম্পাদক, প্রশান্তিকা