নীল দরিয়ার নোনাজলে (তৃতীয় পর্ব)- সাদাত হোসাইন

  
    

 


সম্প্রতি প্রশান্তিকা ও মাসিক মুক্তমঞ্চের আমন্ত্রণে অস্ট্রেলিয়ায় সিডনি, মেলবোর্ন ও ব্রিসবেনে এসেছিলেন সাদাত হোসাইন। শুনিয়ে গেলেন তাঁর ‘জীবনের গল্প, গল্পের জীবন’ শীর্ষক আলেখ্য। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই এই প্রথম ভ্রমণ কাহিনী লিখছেন সাদাত হোসাইন…

           দ্বিতীয় পর্বের শেষে:
ছবির মতো সুন্দর এই শহরে নামতে নামতে আমার হঠাৎ মনে হতে লাগলো, এই শহর, এই সুন্দর এয়ারপোর্ট, এই পাহাড়, সমুদ্র, এই আকাশ ছোঁয়া ভবনগুলো কোন এক অদ্ভুত যাদুমন্তরে হঠাৎ যদি হয়ে যেতো ঢাকা শহর, হয়ে যেতো বাংলাদেশ! এই এখন, এক্ষুণি।
যদি আমি প্লেন থেকে নেমেই ছুঁয়ে দিতে পারতাম বাংলাদেশের মাটি, বুক ভরে টেনে নিতে পারতাম বাংলাদেশের বাতাস!

            তৃতীয় পর্ব: চাতক চোখ

হংকং এয়ারপোর্ট বিশাল। বিশাল মানে আসলেই বিশাল। এয়ারপোর্টের ভেতরেই আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন স্টেশন আছে। সেখান থেকে ট্রেনে চেপে এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে যেতে হয়। আমার দিশেহারা লাগে। তবে সেই দিশেহারা ভাব বেশিক্ষণ থাকে না। কারণ জাস্টিন। সে আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে, ‘তোমার চোখ-মুখজুড়ে এতো ভয় কেন?’
আমি হাসি, ‘না, তেমন কিছু না’।
– তুমি কী তোমার পরের ফ্লাইট ধরা নিয়ে টেনশন করছো?
– হ্যাঁ, করছি। আমি অকপটে বলি। জাস্টিন হাসে। বলে, ‘চলো, আমি তোমাকে পৌঁছে দেই।
সে আমাকে অবাক করে দিয়ে এই গেট থেকে সেই গেট, এই ফ্লোর থেকে সেই ফ্লোর, এস্কেলেটরের পর এস্কেলেটর হেঁটে যেতেই থাকে। আমিও তার সাথে হাঁটতে থাকি। তারপর আমরা আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনে চাপি। তারপর আবার এস্কেলেটর, আবার লম্বা লম্বা করিডোর, আবার এই গেট থেকে সেই গেট পেরিয়ে পৌঁছাই ক্যাথে প্যাসিফিক এর নির্ধারিত গেটে।

এখান থেকে সরাসরি সিডনির ফ্লাইট। আমি গেটের ভেতর ঢোকার আগে জাস্টিন হঠাৎ আমার কাঁধে হাত রাখে, ‘হ্যাভ আ সেফ ফ্লাইট’।
সে হাসে। আমিও। ফিরে যেতে গিয়েও খানিক থমকে দাঁড়াই আমি। তারপর আচমকা জড়িয়ে ধরি। অচেনা-অজানা, বিদেশ বিভূঁইয়ে এমন একজন মানুষ, এইটুকু সময়ে এমন করে মমতার স্পর্শে ছুঁয়ে যাবে, ভাবিনি। বুকের ভেতর কোথায় যেন জমে ওঠে খানিক আর্দ্র অনুভূতি। সেই অনুভূতি বুকে পুষেই আমরা বিচ্ছিন্ন হই। হয়তো এই জীবনে আর কখনোই দেখা হবে না আমাদের। বন্ধু, এই দেখা শেষ দেখা?
এয়ারপোর্টে একা একা বসে আছি। এরমধ্যে আবিষ্কার করলাম, এরা বাথরুমে পানি ব্যবহার করে না। টিস্যু ব্যবহার করে। আমি তীব্র আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম প্লেনের। প্লেনে নিশ্চয়ই বাথরুমে পানির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু প্লেনের ওয়াশরুমে ঢুকে রীতিমত আতঙ্ক বোধ করতে লাগলাম। পানির কোন ব্যবস্থা নেই! এর কারণ আমি জানি না। অনভ্যস্ত আমি তীব্র আতঙ্ক নিয়ে, ভয়াবহ শারীরিক অস্বস্তি নিয়ে বসে থাকি সিটে। সিনেমা দেখার চেষ্টা করি, গান শোনার চেষ্টা করি, গেম খেলার চেষ্টা করি। কিন্তু আমার অস্বস্তি কাটে না। খানিক চোখ বন্ধ করলেই ঘুম ঘুম ভাবে শরীর ভেঙে পড়ে। কিন্তু ঘুম আসে না। ছটফট করি। এপাশ ওপাশ করি। পাশের যাত্রিটি বারবার আড়চোখে তাকায়। বিরক্ত হয়। কিন্তু কিছু বলে না। আমি জানালা খুলে বাইরে তাকানোর চেষ্টা করি। কিন্তু চোখ ঝলসানো রোদ ছাড়া আর কিছুই নেই সেখানে। যেন আস্ত একটা চকমকি টিনের ওপর সূর্যের তেজী রোদ এসে পড়ে রিফ্লেক্ট করছে। তাকাতেই চোখ ঝলসে যায়। আমি জানালা বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকি। আর ক’ঘণ্টা বাকী?
দীর্ঘ নয় ঘণ্টার যাত্রায় আমি কিছু খাই না, না জল, না খাবার। খেতেও ইচ্ছে হয় না। মনে হয় তীব্র যন্ত্রণাকাতর এই যাত্রা কখন শেষ হবে!
তবে একটা সময় গিয়ে সবকিছু কেমন স্বাভাবিক মনে হতে থাকে। যেন শারীরিক অস্বস্তির সাথে আমি অবচেতনেই মানিয়ে নেই।
সিডনির ঘড়িতে রাত তখন দশটা। রাতের আলো ঝলমলে সিডনি। কত শত বার পত্রিকার পাতা, টেলিভিশনের স্ক্রিন, ক্যালেন্ডার আর পোস্টারে এই শহরের ছবি দেখেছি। সেই সিডনি! ভাবতে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয়। মনে হয়, এই শহর কী খানিক স্বপ্নেরও নয়? নাকি স্বপ্নই? আচমকা ঘুম ভেঙে যাবে। আমি চোখ মেলে তাকাতেই দেখবো, ঢাকায় আমার ঘরে শুয়ে আছি। এক্ষুণি দরজায় কলিং বেল বাজবে। উঠে দরজা খুলতেই দেখবো ময়লাওয়ালা ময়লা নিতে এসেছে, ‘মামা, ময়লা দেন। এতো বেলা কইর‍্যা ঘুমান ক্যান? সেই কুনসময় থেইক্যা বেল দিতাছি, টের পান না!’
আমার সম্বিৎ ফেরে তীব্র ঝাঁকুনিতে। প্লেন ল্যান্ড করেছে। আবারও বিশাল এক এয়ারপোর্ট। আমি অন্যান্য যাত্রীদের স্রোতের ভেতর মিশে যাই। হেঁটে যেতে থাকি তাদের পেছনে পেছনে। আবারও ধড়ফড় করছে বুক। আচ্ছা, ঢাকা এয়ারপোর্টে না হয় ভিসা বিহীন পাসপোর্ট নিয়ে চলে এলাম, যদি এখানে আটকে দেয়? যদি এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে না পারি!
ফোন করার উপায় নেই। ইন্টারনেট নেই। ফেসবুক নেই। কী করবো তখন আমি? কার সাথে যোগাযোগ করবো? কীভাবে যোগাযোগ করব?
আমি ভেবে পাই না। প্রবল অস্বস্তি, অস্থিরতায় হেঁটে চলি। কিন্তু আমাকে চমকে দিয়ে জীবনের সবচেয়ে দ্রুততম এবং সহজ উপায়ে ইমিগ্রেশন ক্রস করি। ভেতরে ভেতরে তখন যেন মুক্তির আনন্দ! এইতো আরেকটু পরেই আমার চেনা মুখগুলোর সাথে আমার দেখা হবে। আরিফ ভাই, শুভ ভাই সহ পরিচিত হবে আরও কত কত মানুষের সাথে! তারা সবাই আমার দেশের মানুষ। আমার মতো করে কথা বলবে। আমার মনে হবে, আমি ঘর থেকে ঘরেই ফিরছি। বুকটা হালকা হয়ে যায়। কিন্তু সেই আনন্দ বেশিক্ষণ টেকে না। কাস্টমসে আটকে গেলাম আমি। হলিউড সিনেমায় দেখা দীর্ঘাঙ্গিনী রূপবতী তরুণী পুলিশ অফিসারের মতো এক পুলিশ অফিসার দূর থেকেই বলতে থাকেন, ‘হ্যালো মিস্টার রাইটার?’
আমি এদিক সেদিক তাকাই, আমাকে বলছে কী? নাহ, আমাকে কী করে বলবে! এই এয়ারপোর্টে কে জানবে যে আমি রাইটার! নিশ্চয়ই অন্য কাউকে বলছেন! আমি হাঁটতে উদ্দত হই। আর ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি দূর থেকেই বলতে থাকেন, হ্যালো মিস্টার হোসাইন, উইল ইউ ওয়েট প্লিজ?
আমি এবার নিশ্চিত হই, এই রাইটার আমিই। আমার পাসপোর্টে ভিসার সিল না থাকলেও তারা আমার নাড়িনক্ষত্র জানেন, অক্ষরে অক্ষরে জেনেছেন আমার সম্পর্কে। আমি এখানে কেন এসেছি, কী কাজে এসেছি, সব?
খানিক অবাক হলেও আতংকিত হই না। তরুণী পুলিশ অফিসার কাছে আসেন, তার হোলস্টারে কাউবয়দের মতো পিস্তল ঝোলানো। তিনি এসে ডেস্কে বসেন। হোলস্টার থেকে পিস্তলটা খুলে পাশে রাখতে রাখতে বলেন, ‘হ্যাল্লো’।
আমি স্মিত হেসে বলি, ‘হাই’।
– আপনি কী লিখেন?
– উপন্যাস, গল্প, কবিতা।
– দ্যাটস গ্রেট। আপনার ব্যাগের ভেতর অনেকগুলো প্যাকেট দেখতে পাচ্ছি আমরা। আপনি কী কাইন্ডলি প্যাকেটগুলো আমাকে দেখাবেন?’
আমি পকেট থেকে চাবি বের করে ব্যাগ খুলি। ব্যাগ ভর্তি বই, কিছু নতুন টি শার্ট। সৌজন্য উপহার হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলাম। আর? বইয়ের প্যাকেট। প্যাকেটের গায়ে বড় করে আমার ছবি। তিনি সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখেন। তারপর বলেন, হ্যাভ আ ওয়ান্ডারফুল অস্ট্রেলিয়া ট্যুর মিস্টার রাইটার। হোপ ইউ উইল গেট সাম এমেইজিং এক্সপেরিয়েন্স হিয়ার… অ্যান্ড রাইট ডাউন…

আমি লাগেজ নিয়ে আঁকা বাঁকা সরু করিডোর ধরে আগাই। কিন্তু দুশ্চিন্তা আমাকে ছাড়ে না, আচ্ছা, যদি আরিফ ভাইরা এই সময়ে এয়ারপোর্টে না পৌঁছান? যদি তাদের লেট হয় আসতে? কিংবা এতো বড় এয়ারপোর্টে যদি আমাকে খুঁজে না পান? কী করবো আমি?
করিডোরটা পেরিয়ে উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াই। তেষ্টাক্লান্ত চোখ, আর নুয়ে পড়া শরীর খুঁজে ফেরে একজোড়া চেনা চোখ, মুখ, মানুষ। এই অসংখ্য অচেনা মানুষের ভিড়ে। আর বুকের ভেতর দুশ্চিন্তার চাপা দীর্ঘশ্বাস! সেই দীর্ঘশ্বাস ছাপিয়ে আচমকা জলোচ্ছ্বাসের মতো বুকের ভেতর আছড়ে পড়তে থাকে অদ্ভুত আনন্দের ঢেউ। সেই ঢেউ জুড়ে প্রবল মমতা আর ভালোবাসার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ! ওই যে আরিফ ভাই, আতিক ভাই। সাথে আরও কত কত মুখ। তাদের হাতে ক্যামেরা। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসায়। আমার হঠাৎ কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে, অপ্রস্তুত লাগে। আরিফ ভাই দৌড়ে আসেন। আমাদের চারপাশে অসংখ্য মানুষ তাকিয়ে আছেন। তিনি তার থোড়াই কেয়ার করে আমাকে বুকের সাথে চেপে ধরেন। আমিও। শুভ ভাই ছুটে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। হাতে ফুলের তোড়া। আমার চোখের ভেতরটা কেমন জ্বালা করে ওঠে। কে জানে, জল জমে কীনা! কিন্তু আড়ালে, আবডালে, আলগোছে, সেই জল আমি লুকিয়ে ফেলি। এই সাত সমুদ্র তেরো নদী দূরের এক দেশেও কেউ কারো জন্য এতো এতো ভালোবাসা, মমতা, স্নেহ জমা করে অপেক্ষায় থাকেন?
এই জোড়া জোড়া চাতক চোখের কাছে আমার নিজেকে হঠাৎ বৃষ্টি মনে হয়। মনে হয় রুক্ষ মরুভূমির শান্ত পুকুর। কিন্তু খানিক বাদেই তীব্র অপেক্ষা শেষে আমার তৃষ্ণার্ত চোখের কাছে এই মুখগুলোকে, এই মানুষগুলোকেই আমার প্রচন্ড দাবাদাহে শ্রাবণের অবিরল বর্ষণ মনে হতে থাকে। আহা চোখ, আহা চাতক, আহা বৃষ্টি। বুকের ভেতরটা কেমন শীতল হতে থাকে। শান্ত, শীতল, স্নিগ্ধ এক সরোবর যেন।
আমি কথা বলতে পারি না। কেউ একজন ফোনে ফেসবুক লাইভ করছেন, ‘এই মাত্র অস্ট্রেলিয়া এসে পৌঁছালেন সাদাত হোসাইন, আপনারা নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন। তাকে নিয়ে আমাদের বিশেষ আয়োজন শুরু হবে… আমরা এখন সাদাত হোসাইনের কাছ থেকে কিছু শুনবো…
কী বলবো আমি? কথা বলতে গিয়ে টের পেলাম, আমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, গলা কাঁপছে। এতো এতো ভালোবাসা জমে আছে এখানে? আমি অনুভব করি কেবল, কিন্তু প্রকাশ করতে পারিনা। শব্দের সাধ্য কী অনুভূতি বোঝায়!
আমি সেই মুখগুলোর সাথেও পরিচিত হই, শামিম ভাই, মুক্তমঞ্চ পত্রিকার সম্পাদক। কবি ও আলোকচিত্রী ফাহাদ, রুবেল এবং নামিদ ভাই। মানুষগুলো এমন কেন? যেন কতদিন, কত বছর থেকে এই মানুষগুলোকে আমি চিনি। এই মুখগুলোকে আমি চিনি। যেন মুহূর্তেই জন্ম জন্মান্তরের অনুভবে তারা আমায় ছুঁয়ে দেন। চারপাশজুড়ে যেন পাখির কলকাকলি। কত কত গল্প, কত কত অনুভব। সব যেন ঢেউয়ের মতো একের পর এক ছুটে আসতে থাকে। অনর্গল। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকি। এই মানুষগুলো এই বিদেশ বিভূঁইয়ে রোজ রোজ এমন করে কত শত কথা এভাবে বুকের ভেতর জমিয়ে রাখে। বলবে বলে। আমি সেইসব গল্প শুনতে থাকি, উচ্ছ্বাস অনুভব করতে থাকি। আমার মনে হতে থাকে, এখানে আলোর রঙ আলোকিত আরও।
মমতা স্নেহের বোধ প্রগাঢ়, প্রগাঢ়।
বাইরে তখন রাতের অন্ধকারের বুক চিরে বিশাল বিলবোর্ডে ঝলমলে আলোর নিয়ন সাইনে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে, ‘ওয়েলকাম টু সিডনি’।
আর আমার মনের মধ্যে তখন জ্বলজ্বল করে জ্বলছে আরও একটা গুরুতর প্রশ্ন, ‘এখানে বাথরুমে জল আছেতো?’
চলবে।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments