নোবেল, পুরো নাম মাইনুল আহসান নোবেল। ওপার বাংলার জী বাংলা সারেগামাপা ২০১৮তে অংশ নেয়ায় বাংলাদেশী প্রতিযোগী গায়ক। লিখতে চাইছিলাম তাকে নিয়ে, সব মিলিয়ে হয়ে উঠছিলোনা। একের পর এক পর্ব হয়ে যাচ্ছে, শেষমেশ ভাবছিলাম টপ টেন সিলেকশন রাউন্ডটা হয়েই নিক।
অবশেষে এই ২২ জুন, শনিবার পাওয়া গেল অনেক লম্বা জার্নির পর ২১জন বাছাইকৃত শিল্পী নিয়ে প্রতিটি পর্ব পার হয়ে অর্ধশত পর্বেরও বেশী হয়ে যাওয়ার পরই এই টপ টেন। অংকিতা, গৌরব, অনন্যা, প্রীতম, ঋতি, স্নিগ্ধজিৎ, সুমন, স্নেহা, গুরুজিৎ এবং বাংলাদেশের নোবেল, এই হল টপ টেন।
সঙ্গীত প্রিয় মানুষ আমি। সঙ্গীতের কোন আসর, বিশেষ করে প্রিয় কোন শিল্পীর গান অনুষ্ঠান বা গানের রিয়েলিটি শো হলে তো কথাই নেই। তার মাঝে এই সময় বাংলা গানের যে কটি, রিয়েলিট শো হয় জী বাংলা সারেগামাপাকে সেরা বলতেই হয়।
আমি শুরু থেকেই দেখার চেষ্টা করছি। একটু বলে নেই এই প্রোগ্রামটা শুরুতে দেখার আমার বাস্তবতা।
আমার বাসায় এই মুহূর্তে বাংলা চ্যানেলগুলো সরাসরি দেখার কোন ব্যবস্থা নেই, অনলাইন ছাড়া।
জী বাংলার এই শোটি দেখার জন্যে ইউটিপিপি সাবসক্রাইব করলাম এবং অতীব দুঃখের বিষয় হচ্ছে লাইভ এই শোটি শুরু হয় অস্ট্রেলিয়া সময় শনি এবং রবিবার রাত ২টা ৩০ মিনিটে।
শনি এবং রবিবার এই শো লাইভ দেখে শেষ করে ঘুমাতে যেতে যেতে ভোর প্রায় ৫টা হয়ে যায়।
আমি উইকেন্ডে, মানে শনি, রবিবারে কাজ করি। সকালে কাজ থাকলে বলাই বাহুল্য খুব এলোমেলো হয়ে যায় সারাটা দিন আগের রাতের এই কম ঘুম ঘাটতিতে।
তবে আশার কথা হচ্ছে, কিছুদিন যেতে না যেতেই সন্ধান পাই, জী বাংলার ZEE5 এপটির। শনি রবিবার লাইভ না দেখে, রেকর্ডকৃত অনুষ্ঠান দেখি যদিও। তারপরও সময় করে বসে টানা দেখে নেয়া যায় বিজ্ঞাপন বিরতি ছাড়াই।
নোবেলকে নিয়ে কিছু বলার আগে, একদম শুরুর দিকের কিছু ঘটনা শেয়ার করি। ওপার বাংলা এবং এপার বাংলার হাজার হাজার প্রতিযোগীর অডিশন পর্ব পার হয়ে মূল তিন বিচারক জনপ্রিয় সুরকার গীতিকার শান্তুনু মৈত্র, শিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য এবং শিল্পী মোনালী ঠাকুরের সাথে অতিথি বিচারক কৌশিকি চক্রবর্তিকে নিয়ে শুরু হয় গ্র্যান্ড অডিশন পর্ব। সম্ভবত ৩০ জন প্রাথমিক সিলেকশন থেকে তাঁরা বেঁছে নেবেন ২০ জন, মানে ২০টা চেয়ার রাখা হয় সারেগামার মঞ্চে। এবং সেই গ্রান্ড অডিশনেই মজার ব্যাপার হচ্ছে ২০টা চেয়ারে ২০জন প্রতিযোগী সিলেক্ট হয়ে যাওয়ার পরই গ্রান্ড অডিশনে আসে বাংলাদেশের নোবেল।
জনপ্রিয় অভিনেতা শিল্পী যীশু সেন গুপ্ত, জনপ্রিয় এই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মঞ্চে যখন নোবেলকে ডেকে নিয়ে বলেন, নোবেল আমাদের ২০টা চেয়ার তো ফিল আপ হয়ে গেছে, এখন তোমার কি মনে হচ্ছে… পারবে কি ওদের সাথে যেয়ে যোগ দিতে? বসতে তো পারছোনা… নোবেলের ভীষণ সরল এবং হিউমারাস উত্তর ছিল, সিট না পেলে দাঁড়িয়ে যাব, কী আর করা!!!
নোবেলের এহেন উত্তরে বিচারকরা স্বাভাবিক ভাবেই মজা পান… এবং শান্তুনু মৈত্র বলে উঠেন, নোবেলের গান তাঁদের মন জয় করলে তিনি তাঁর চেয়ারটি ছেড়ে এগিয়ে দেবেন এবং সেই অডিশনেই জেমসের বিখ্যাত ‘’ভিগি ভিগি’’ গেয়ে এবং গোল্ডেন গিটার পেয়ে, যার মানে সব বিচারকরা তাকে ফুল মার্ক, দশে এ দশ দিতে বাধ্য হউন শুরুতেই।
শুরুতে বাংলাদেশের আরো বেশ কজন প্রতিযোগী ছিল তবে মূল এই পর্বে নোবেলের সাথে উঠে আসে কেবল বাংলাদেশের আরেক প্রতিযোগী অবন্তী সিঁথি।
গ্র্যান্ড অডিশনে, প্রায় সব প্রতিযোগীর সাথে বিচারকদের গান গাওয়ার আগেই সাধারণ কিছু কথা হচ্ছিল। এই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের একজন প্রতিযোগী, গান পরিবেশনের আগে বিচারকদের সাধারণ প্রশ্নে বলে যাচ্ছিল তার এখানে আসার প্রেক্ষপট কেমন ছিল… মেয়েটি কী বলছিল তা বলার আগে ওপার বাংলার অন্য এক প্রতিযোগীর গল্পটা বলে নেই।
তাঁর নাম শম্পা কুণ্ডু, কলকাতা থেকে আসা। প্রাথমিক দুই একটা বিচারক প্রশ্নেই বুঝা যায় তাঁর গানের জগতে উঠে আসার পিছনে বেশ লম্বা গল্প আছে। গল্প সেইদিকে যেতে না যেতেই, শম্পা নিজেকে নিবৃত্ত করে, বলে আমি আগে গানটা গেয়ে নেই, তারপর বলবো আমার কথা। মূলত ফোক গান করে শম্পা। বাংলাদেশের ফজলুর রহমান বাবুর গান ‘ইন্দুবালা গো’’ তার কন্ঠে ছিল অসাধারণ। দুর্দান্ত ভালো গেয়ে বিচারকদের মন জয় করেই সে তাঁর একান্ত গল্পটা বলা শুরু করে। উঠে আসে তাঁর দারিদ্রতা, কিশোরী বয়েসে বিয়ে এবং এরপর শুধু গানের জন্যেই একমাত্র মেয়ে এবং মাকে নিয়ে তাঁর সংগ্রামী সংসার শুরুর কথা। তাঁর গল্প শুনে চোখ ভিজে উঠে সবার, কিন্তু তাঁর সেই বলা এবং ব্যাক্তিত্বের প্রতি জাগে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা।
আমাদের বাংলাদেশের যে মেয়েটির কথা প্রসঙ্গে এই বিষয়টি বললাম, মেয়েটির পেছনের গল্প হয়তো আরো করুণ, কিন্তু তার প্রকাশভঙ্গীর জন্যেই হোক বা এই সময় বিবেচনাটা না থাকার জন্যেই হোক দর্শক হিসেবে আমার এক ধরণের অস্বস্থি হয়েছে। মেয়েটি গান দিয়ে বিচারকদের মুগ্ধ করতে পারলে হয়তো এতোটা হতোনা।
জী বাংলার এই শোটিতে গান নিয়ে হয় অনেক অনেক অভিনব এবং মনোমুগ্ধকর সব পরিবেশনা। গানের প্রতিযোগীদের শুধু নির্বাচন করে মঞ্চে তাদের উপস্থাপন করার আগে প্রতিটি গানই গ্রোমাররা ঠিক করে দেন এবং চেনা গানের সাথে প্রায় সময়ই ফিউশন বা ক্লাসিক্যাল রাগ জাতীয় কিছু বাড়তি কাজ যোগ করে অসাধারণ করে তোলেন।
একজন প্রতিযোগীর গানে যোগ দেয় অন্য প্রতিযোগীরা প্রয়োজন হলেই। তা কোরাসই হোক বা হোক নিতান্তই কোন একটা ব্যাকগ্রাউন্ড হামিং।
টপ টেন এ যে প্রতিযোগীরা উঠে এসেছে তাঁদেরকে একের পর এক ভ্যারাইটি দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে তাঁদের ভার্সেটাইলিটি। ফোক, ক্লাসিক, রোমান্টিক, দেশাত্ববোধক, হেমন্ত, আর ডি বর্মণ, কিশোর কুমার, জাজেস চয়েজ, ইন্সট্যান্ট কোন গান এবং এবং প্রতিযোগীদের একজন আরেকজনের সাথে ফেইস টু ফেইস পর্বের মত সকল পর্বেই দেখাতে হয়েছে নিজেদের বিশেষত্ব।
বলাই বাহুল্য টপ টেন এ উঠে আসা ১০ জনই যে সেরাদের সেরা এতে কারো কোন সন্দেহ নেই। তারপরও যাঁদের দেখা হয়নি ছোট্ট করে ধারণা দেই আমাদের নোবেলকে নিয়ে বলার আগে।
স্নেহা বলে যে মেয়েটা সে মূলত ওয়াইল্ড কার্ডে বিচারকদের পছন্দে উঠে আসা। তার মূল স্ট্রেংথ কিছু গান গায় সে অনবদ্য। বিশেষ করে তার কন্ঠে ‘’লায়লা ও লায়লা’’ এবং ‘’ভ্রমর কইয়ো গিয়া গানের মত কিছু গানের পরিবেশনা ছিল, অনেকদিন মনে রাখার মত।
গুরুজিৎ বলে দুর্গাপুর থেকে আসা যে প্রতিযোগী সে মূলতঃ শ্যামা সঙ্গীত গায়। তার কন্ঠ উপচে পরে ভক্তি। সে যখন অডিশনে গেয়ে উঠে ‘’মা আমার সাধ না মিটিল, আশা না ফুরিল’’ বিচারকরা যেমন চমকে উঠেন, দর্শক হিসেবে যারা এই ধরণের গান পছন্দ করেন তাঁদের মনেও করে নেয় জায়গা।
অনন্যা, সন্তোষপুর, দঃ ২৪ পরগনার মেয়ে, আশ্রমে বেড়ে উঠা যার কন্ঠে প্রথমদিনেই, কার্ত্তিক বাউলের সঙ্গে ‘’কলঙ্কিনী রাধা’’ শুনে মুগ্ধ হউন বিচারক এবং যারা এই ধরণের ফোক বা লালন পছন্দ করেন তাঁরা। ওর গলার রেঞ্জ ভীষণ প্রশংসনীয়।
সুমন নদীয়া থেকে আসা সবচেয়ে জুনিয়র যে ছেলেটা গাইতে আসে, সে প্রথম যখন মঞ্চে গেয়ে উঠে, ‘’গ্রামের নওজোয়ান, হিন্দু, মুসলমান’’ বিচারক এবং দর্শকদের যেন নিমিষেই ওর কন্ঠ যে একদম মাটির কাছাকাছি, সবুজ সতেজ বলে যে একট ব্যাপার আছে সেটা ছুঁয়ে যায় সবাইকে। কম বয়েসী রীতিমত নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা এক বিস্ময়কর বালক গায়ক।
ঋতি, কলকাতা থেকে আসা এই শিল্পী ব্যাক্তিগতভাবে আমাকে মুগ্ধ করেছে প্রথমদিনেই। না ঠিক কারো মত না এই কন্ঠ। যারা বলিউডের জনপ্রিয় অন্যধারার শিল্পী, রেশমা, রেখা ভারদ্বাজ, শোভা মুদ্গাল, শিল্পা রাও এমন শিল্পীদের গান শুনে অভ্যস্ত তাঁদের মনে এই শিল্পী যে একটা গান শুনেই আলাদা জায়গা করে নেবে। মোটকথা, ঋতি একদমই স্বতন্ত্র। তবে ওর কন্ঠে একটু স্যাড ক্লাসিক্যাল বা রোমান্টিক গানগুলোই পায় আলাদা সৌন্দর্য।
স্নিগ্ধজিৎ রায়গঞ্জ থেকে আসা এই প্রতিযোগী বলা যেতে পারে আগামী দিনের সিনেমার গান গাইতে যাওয়া এক গায়ক। খুব আলাদা করে বলতে পাওয়ারফুল গলা এবং সিনেমার রক ধরণের গানের জন্যে ক্রমশই ভালো হতে থাকা এক প্রতিযোগী।
গৌরব, কলকাতার এই গায়ক আসর জমানো ক্লাসিক্যাল ধাঁচের এক গায়ক। পুরোনো দিনের গান বিশেষ করে মান্নাদের ক্লাসিক্যাল গানগুলো গাইতে শুরু করলে সারাদিন ধরে ওর কন্ঠে শোনা যাবে। কোন এক পর্বে গোপী গাইন বাঘা বাইন সিনেমার ‘’পায়ে পড়ি বাঘ মামা’’ গৌরব যে মাত্রায় গেয়েছে মুগ্ধ বিচারকদের পাশাপাশি রাগভিত্তিক গান পছন্দ করা আমার মত দর্শকের মনে থাকবে তা সব সময়। শুদ্ধ সঙ্গীতের সাধনায় থাকা এক শিল্পী গৌরব, আমার শুরু থেকেই ভালো লেগেছে।
প্রীতম নৈহাটি থেকে আসা এই গায়ক, সুফী ক্লাসিক্যাল ঘরানা গানের সাধক বলা যেতে পারে। বিশেষ করে কাওয়ালী, গজল জাতীয় গানে যে মুন্সিয়ানা প্রীতমের তা পুরোপুরি আছে। গানের সাথে যে ওর বসবাস রীতিমত তা ওর গান শুনেই যে কেউ বুঝে নেবে। সুরের খেলা দিয়ে ও তাই বিচারকদের বিমুগ্ধ করেছে শুরু থেকেই।
অংকিতা, উঃ ২৪ পরগণার মেয়ে, শুরু থেকে প্রায় প্রতিটা পর্বে, বিস্মিত করেছে। প্রথম দিকে ওর গান শুনেই আমার মনে হয়েছে, কলকাতা থেকে বছর বছর বলিউড যেমন দুই/এক জন দুর্দান্ত সিঙ্গার পাচ্ছে, এই যেমন শ্রেয়া ঘোষাল, অন্বেষা ঠিক এই ধারাবাহিকতার আরো একজন। কমপ্লিটলি তৈরী একটা গলা এবং সুরেলা। অংকিতার গান ভালো না লাগার কোন কারণ নেই। তবে ওর গান শুনে শুরু থেকেই আমার বারবারই মনে এসেছে, এমন গায়িকা ওপার বাংলায় আছে এবং আরো আসবে।
এবার আসি নোবেল প্রসঙ্গে, নোবেল শুরুতেই জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, মাইলসের গান গেয়েছে একের পর এক এবং এই সব গানগুলোতেই ওকে সবাই পেয়েছে দুর্দান্তরুপে। জেমস, এল আর বি’র গান আমরা অন্য কারো কন্ঠে শুনে অভ্যস্ত নই বা ভালো লাগেনা পুরোপুরি। নোবেল এসে এই ধারণা প্রথম ভেঙ্গে দিল। প্রতিটি গানকেই দিয়েছে নূতন মাত্রা।
কিন্তু নোবেল তাকে ঘিরে থাকা এই ধারণাও ভাঙ্গতে সময় নেয়নি যে সে শুধুই ব্যান্ডের গানে স্বছন্দ। অনুষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী, নজরুলের ‘’কারার ঐ লৌহ কপাট’’ ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি’’ ‘’মুক্তির মন্দিরও সোপান তলে’’ ‘’আমার ভাইয়েরই রক্তে রাঙানো’’ ‘’আমারও পরানও যাহা চায়’’ ‘’তুমি কত যে দূরে’’ ‘’কফি হাঊজের সেই আড্ডাটা’’ এবং ‘’বাবা বলে ছেলে নাম করবের’’ মত বলিউডি অনেকগুলো মুভি সং। এই গানের প্রায় প্রতিটিতেই নোবেল পেয়েছে গোল্ডেন গিটার। নোবেলের কন্ঠে গোল্ডেন গিটার পায়নি, বিচারকেরা চুল চেরা বিশ্লেষণ করেছেন কিন্তু দর্শকদের অনেক ভালো লেগেছে এমনও হয়েছে বেশ কবার। আমার খুব ভালো লেগেছে ‘’আরো একবার চলো চলে যাই’’ রুপম ইসলামের গান, মূল গান থেকেও ভালো লেগেছে বা ‘’মিলন হবে কত দিনের’’ মত লালন পরিবেশনাও।
প্রায় পর্বেই প্রতিযোগীদের সাথে মা বাবা বা কাছের আত্মীয় স্বজনেরা এসেছেন। একটি পর্বে নোবেলের বাবা এবং আরো কজন কাছের আত্মীয় গিয়েছিলেন। বিচারক এবং উপস্থাপকদের সাথে নোবেল এবং তার বাবার কথোপকথন পর্বটা বেশ উপভোগ্য ছিল। বাংলাদেশের একজন স্মার্ট বাবা হিসেবে নোবেলের বাবার কথা দর্শক হিসেবে আমাকে রীতিমত আনন্দিত করেছে। এবং নোবেল এই পর্বেই যখন ‘’খাজা মেরে খাজা’’র মত গান পরিবেশন করে, সেটা ছিল এই সিজনের ওয়ান অব দ্যা বেষ্ট পরিবেশনা। একজন বাংলাদেশী দর্শক হিসেবে আমার খুব গর্ব হয়েছে ওকে নিয়ে সেদিন। মনে হয়েছে ছেলেটা এই প্রতিযোগিতায় থাকা অন্য বেশ কজনের মত গানের স্কুলিং না থাকলেও আলাদা একটা কিছু আছে যা আর কারো নেই।
একটা পর্ব ছিল, প্রতিযোগীরা তাঁদের পরিবারের কারো না কারো সাথে কোন গান গাইবে। কেউ গানের গুরু, কেউ প্রিয় গায়ক/গায়িকা এবং তাদের মা বা বাবার সাথে গাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এই পর্বে অংকিতা তার মাকে নিয়ে ‘’আমি যে তোমার, শুধু যে তোমার’’ হিন্দি বাংলা ভার্শনে গেয়ে সবার সেরা পরিবেশনাটাই তুলে ধরে। তবে নোবেল তার বাবাকে নিয়ে ‘’আকাশ ভরা’’ রবীন্দ্র সঙ্গীতটিতে, ওর বাবা আবৃত্তির একটা অংশ করেন শুধু, তারপরও মুগ্ধ করেন বিচারক শ্রোতা দর্শকদের।
একটা পর্বে, নোবেলের কন্ঠে জেমসের মা গানটির সাথে ওপার বাংলার একজন মঞ্চ অভিনয় শিল্পীর ‘’মাকে আমার পড়েনা মনে’’ আবৃত্তির অংশটুকু করেন। নোবেলের এই গোটা পারফর্মেন্সে পুরো দর্শক এবং বিচারক ছিল মন্ত্র মুগ্ধ। নোবেল এই গান শুরুতেই ডেডিকেট করে উপস্থাপক যীশুকে… গান শেষে যীশু এবং বিশেষ করে বিচারক মোনালী অনেক বেশী আবেগে আপ্লূত হয়ে উঠে।
বলা যেতে পারে জী বাংলার এই অনুষ্ঠানে আসলে নোবেলের মত বাংলাদেশের একজন গায়ককে এক্সপ্লোর করা ছিল দুই বাংলার দর্শকদের জন্যেই অন্যতম আনন্দময় এক জার্নি।
নোবেলের শুরুর পরিবেশনা থেকেই দেখা গেছে বিচারকরা অনেকবার ওর ভূয়সী প্রশংসা করছেন। মোনালি ওর সাথে গান গাইতে চেয়েছে এবং একটি পর্বে ‘’পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে’’ অংশ বিশেষ পরিবেশনও করে। মোনালী নোবেলের গান শুনে একবার বলছিল, খুব কম গানের শিল্পীই আছেন যারা গান করার সময় দর্শকদের কাছে লিরিক্সগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারে। তুমি যখন গানে ‘’ফল ইন লাভ এমন ফিলিং নিয়ে আস’’ আমি তা বিশ্বাস করি। এবং আসলেই তাই, নোবেলের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব গানের লিরিক্সকে দারুণভাবে তুলে ধরা। ঠিক কোন না কোন শব্দ নিয়ে নোবেল যে কাজটা করে সেটা ভালো না লাগার কোন কারণ নেই।
শান্তুনু মৈত্র অনেকবার অনেকভাবে নোবেলের প্রশংসা করেছেন মঞ্চে, বলেছেনও নোবেলকে দিয়ে তিনি গান গাওয়াতে চান।
নোবেলের এই অনুষ্ঠানের শুরু থেকে প্রাপ্তির খাতায় শুধু যোগই হতে থাকে। বিচারকরা মন খুলে প্রাণ খুলে প্রশংসা করলেও নানান সময়ে বাংলাদেশী দর্শকদের সমালোচনা এড়াতেও পারেননি। যদিও কিছু বাংলাদেশীর এর মাঝে বিশেষ করে ফেসবুকের কিছু প্রচার প্রচারণা, ইউটিউবে ফালতু আপলোড এবং নোবেলকে নিয়ে অন্য প্রতিযোগী বা বিচারকদের বিরুদ্ধে আজেবাজ প্রোপাগান্ডা রীতিমত অস্বস্থিতে ফেলেছে।
তবে হ্যাঁ একজন দর্শক হিসেবে আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, দুইটা বিষয় মানে প্রশ্ন জাগিয়েছে মনে, শেয়ার করি। ফেস টু ফেস পর্বে নোবেলের সাথে ছিল, সুমনের পরিবেশনা। পর্বটা এমন ছিল, যে সেদিন যে গান রেডি করে নিয়ে এসেছে, সেটা না গেয়ে, একে অন্যেরটা গাইবে এবং একটা সময় সেই গান ডুয়েটও করতে হবে। সুমন সেদিন নিয়ে এসেছে ‘’দে দে পাল তুলে দে, যাব মদিনা’’ নোবেল, পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে… সুমনের গান যখন নোবেল ধরে সেদিন স্পষ্টতই বুঝা যায়, নোবেলের বিশেষত্ব, অসম্ভব সুন্দর করে মিলিয়েছে গলা সুমনের সাথে। আর নোবেলের গানটা সুমন অনেক চেষ্টা করেছে, তবে নোবেলের মত না। বলাই বাহুল্য সেদিন গোল্ডেন গিটার নির্ভর করছিল, দুজনের পরিবেশনার উপর জাজ করে। তবে মার্কিং আলাদা করেও দেয়া হচ্ছিলো। নোবেলের দুটো পরিবেশনা অনবদ্য হওয়া সত্বেও বিচারক শ্রীকান্ত আচার্য সেদিন কেন যেন ১০ এ ৯ দেন, অন্য দুজন বিচারক নোবেলকে ১০ এ ১০ এ দেন, যা রীতিমত চোখে পড়ার মত ছিল।
শেষের দিকে এসে নোবেল এই গেল এক সপ্তাহ আগেই গাইলো, মাইলসের নীলা… ফুল মার্কস। মোনালী চ্যালেঞ্জ দিল, একটা রোমান্টিক গান গাইতে… নোবেল তাহসানের ‘’বিন্দু আমি ধরলো’ বিচারকেরা যখন গান শেষে বললো এটা একটু কম ভালো হয়েছে, দর্শক শ্রোতা হিসেবে আমার রীতিমত হাসি পাচ্ছিলো। কারণ আমি শিউর বিচারকদের কেউ এটা মূল গায়কের কন্ঠে হয়তো শুনেইনি। নোবেলের কন্ঠে, এই গানের দুর্দান্ত লিরিক্স উঠে এসেছে বরাবরের মতোই সুন্দরভাবে।
নোবেলের কন্ঠে আমার খুব খুব প্রিয় গান শিলাজিৎ এর ‘’জলফড়িঙ’’ শুনে আরো একবার মনে হয়েছে, এই ছেলেটা গানের মাঝে কী ভীষণ করে ঢুঁকে যেতে পারে। ওর কন্ঠে নচিকেতার ‘’বৃদ্ধাশ্রম’’ মঞ্চে আসা মায়েদের উপস্থিতি, ওর কাছের কিছু বন্ধু বড় ভাই রোড এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর ‘’আলবিদা’’ গানটি ডেডিকেট করে যে পাওয়ারফুল পরিবেশনা দিয়েছে, এই সব কিছু দর্শকের মনে গেঁথে থাকবে।
এই অনুষ্ঠান চলা সময়েই নোবেলকে বাংলাদেশে নানান টিভি চ্যানেল এবং সংবাদ মাধ্যমে গান নিয়ে হাজির হতে দেখলেও প্রতিযোগিতা নিয়ে কথা বলতে দেখা যায় ‘মেরিল প্রথম আলোর এওয়ার্ড অনুষ্ঠানে’। কথা প্রসঙ্গে ঐ অনুষ্ঠানে নোবেল কোন এক প্রশ্নের উত্তরে জানায় ‘’জী বাংলার এই অনুষ্ঠানে গিয়ে আসলে, ওর জন্যে বিষয়টা এমন যা যে সে অনেক কিছু শিখে ফেলেছে বা আগের থেকে ভালো গাইছে। সে বরাবর এমনই গাইতো, বাথরুমেও সে এমনই গায়… বুঝাই যাচ্ছে মজা করে উত্তর দিতে যেয়ে জাস্ট হয়তো তেমন কিছু না চিন্তা করেই এমন উত্তর সে দিয়েছে। তবে জী বাংলার নানান ফ্যান পেজে উঠে এসেছে খুবই মিশ্র প্রতিক্রিয়া ওর এই উত্তরের। বিশেষ করে ওপার বাংলার কিছু দর্শক প্রতিক্রিয়া ছিল, ক্ষুব্ধ।
আমার মনে হয়েছে, নোবেলের কম বয়েস এবং বেসিক্যালি আমরা বাংলাদেশীরা একটু এমনই। আরোপিত বা অতি বিনয় দুটোর মাঝের দুর্দান্ত সমন্নয় খুব কম শিল্পীর মাঝেই আছে।
জী বাংলার মঞ্চেই দেখা যায় অন্য প্রতিযোগীদের মাঝে একটা অন্য রকম বোঝাপড়া আছে। কেউ ভালো গাইলে অন্যরা তাকে নানানভাবে উৎসাহিত করে, আর হাত তালিটা তো নিতান্তই সৌজন্যতা। নোবেলকে দেখা যায় প্রায় সময়ই চুপ করে বসে থাকতে। ব্যাক্তিগতভাবে আমার মনে হয়না নোবেল খুব মিন মাইন্ডেড বা হিংসুটে বা ইচ্ছে করে এমন করে। …ও হয়তো বুঝতেই পারেনা এমন কিছু যে করা উচিত। কিছু ম্যানারিজম জানলে ও যে আরো বড় আইডল হয়ে উঠবে এটাতে তো ভুল নেই। বিনয় হয়তো আছে, তবে অন্য অনেক প্রতিযোগীর মত চোখে পড়েনা।
এই মুহূর্তে নোবেল আছে টপ ৬ এ। শোনা যাচ্ছে আগামী ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য ফাইনাল পর্ব অলরেডি রেকর্ড হয়ে গেছে এবং আনঅফিসিয়াল ফলাফল নিয়েও হচ্ছে নানান নিউজ।
ব্যাক্তিগতভাবে আমি মনে করি, নোবেল যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন বা রানার আপ হওয়ার মত কেউ শুধু ওর স্বকীয়তার জন্যেই। তবে কোন কারণে সেটা না হলেও নোবেল বা তার ভক্তদের কষ্ট পাওয়ার এতটুকু কিছু নেই।
নোবেল যেদিন মঞ্চে অনুপম রয়ের সাথে ‘’ আমাকে আমার মত থাকতে দাও’’ গেয়েছে সেদিনই ও আমাদের চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে। নোবেল যেদিন অনুপম রয়ের সুরে ওপার বাংলার সিনেমার গান ‘’তুমি দেখছো যাকে ভাবছো যাকে সে আসল মানুষ নয়’’ গাইতে পেরেছে ওকে ঘিরে ভক্তদের পাওয়া পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। নোবেল এই সময়ের জনপ্রিয় কবি লেখক শ্রীজাতের কথা এবং শান্তুনু মৈত্রের সুরে এসিড দগ্ধ নারীদের নিয়ে করা গান ‘’আগুন পাখি’’ গাওয়ার জন্যে সিলেক্ট হয়ে গানটি সারেগামাপার মঞ্চে করতে পেরেছে সেইদিনই ও চ্যাম্পিয়ন। গানের জগতে ওর এই পদচারণা অবিশ্বাস্য সুন্দর এবং ভালোবাসাময়।
শেষ করার আগে আরো একটি বিষয় ছোট করে বলি। এই প্রতিযোগিতায় প্রতিটি পর্বে একজন সিঙ্গার অব দ্যা ডে নির্বাচিত হয় এবং সপ্তাহ শেষে সেই সিঙ্গারদের মাঝেই একজন উইকের সেরা হয়। পুরস্কার হিসেবে তুলে দেয়া হয়, নগদ টাকার চেক, ভাউচার এবং একটা সরস্বতি মুর্তি। এটার মাজেজা বুঝলামনা। জী বাংলা এটা কেন করে আমি জানিনা আসলে। বাই দ্যা ওয়ে, এটা না দিয়ে যদি, তসবি টুপির মত কোন কিছুও দেয়া হত, তবেও আমি এমনই বিস্মিত হতাম। মানে এটা আমি রিলেট করতে পারিনা।
যাই হোক, নোবেলকে নিয়ে লেখা, ওর কথা দিয়েই করি আজ শেষ।
নোবেলকে এপার বাংলা ওপার বাংলা কাজে লাগাতে পারলে নিঃসন্দেহে গানের জগত দারুণ কিছু পাবেই এতে আমার কোন সন্দেহ নাই।
জয়তু নোবেল, মাটির কাছাকাছি থেকে, মানুষের এমন প্রিয়ভাজন হয়েই এগিয়ে যাও। দুই বাংলার মানুষের এমন উপচে পড়া ভালোবাসা এর আগে আর কে পেয়েছে… ইউ আর অলরেডি আমাদের চ্যাম্পিয়ন এন্ড ট্রুলি ব্লেসড।
ভালোবাসা নোবেলের জন্যে সবটুকু। ফলাফল যাই আসুক, অগ্রিম অভিনন্দন!!!
নাদিরা সুলতানা নদী
কলামিস্ট/সংস্কৃতি কর্মী
উপস্থাপক, রেডিও বাংলা
সহযোগী সম্পাদক, প্রশান্তিকা।