নো ল্যান্ডস ম্যান : ধারে না কাটলেও ভারে কাটবে । জন মার্টিন

  
    

সিডনির তাপমাত্রা এখন ৩-৪ ডিগ্রি হলেও ভারী গরম। এক মাসে ছয়টি বাংলা সিনেমা চলছে। তাও আবার অস্ট্রেলিয়ার মূল ধারার সাথে পাল্লা দিয়ে Hoyts -এ এই ছবিগুলো চলছে। পাশাপাশি সিডনি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হয়ে গেল।  কিছুদিন আগে গানের অনুষ্ঠান জলসা হয়ে গেল। এতো উত্তেজনায় কি আর নিম্ন তাপমাত্রা গায়ে লাগে? এই যে এতগুলো সিনেমা বিভিন্ন সিনেমা হলে চলছে – সেখানে দর্শক কেমন যাচ্ছে? আমার  স্বল্প অভিজ্ঞতায় বলি আমরা সিনেমা দেখার আগে দেখি কে বানালো? কে কে অভিনয় করেছে? তারা কি স্টার? নাকি সাধারণ? এমন বেশ কিছু হিসাব কষে তারপর সিনেমা হলে পা দেই। এটার অর্থ হচ্ছে- এখানে সিনেমা ‘ভারে’ কাটে। আর এই হিসাব তো আমরা জানি যে এই দুই ধরনের ‘কাটার’ মধ্যে তফাৎ আছে। সেই তফাৎ কারো চোখে পড়ে – আবার কারো চোখে পড়ে না। 

ছয়টি সিনেমার মধ্যে তিনটি দেখে ফেলেছি। বাকিগুলো দেখার পায়তারা চলছে। চব্বিশ ঘণ্টা তো যথেষ্ট নয়। সিডনি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী একজন বিচারক হিসাবে এসেছে। শুনেই মনটা ভরে গেল। গল্প এখানেই শেষ নয়। ফারুকী সাথে করে ওর ছবি ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ নিয়ে এসেছে। এই ছবি নিয়ে তো কত গল্প, কত প্রস্তুতি, ছবি বানানোর আগেই বেশ কয়েকটা পুরষ্কার প্রাপ্তির কথা শুনেছি। অতএব ছবিটি দেখার আগ্রহ তো থাকবেই। তা ছাড়া ফারুকীর ছবি নিয়ে একটি প্রচারণা সবার চোখেই পড়ে।  

আমার একা একা সিনেমা দেখতে ভাল লাগে না। তাই দল বল নিয়েই সিনেমা দেখতে গেলাম। ফারুকীর ছবি – অতএব একটু রমরমা প্রচারণা তো হবেই। আমি টের পাচ্ছিলাম যে ছবিটির ‘ভার’ অনেক বেশী। তাই অপেক্ষা করছিলাম ছবিটির ‘ধার’ কখন পরখ করবো। আমার আগ্রহের আরো একটি কারণ আছে। এই ছবির বেশ কিছু অংশ আমার দেশ অস্ট্রেলিয়াতে শুটিং হয়েছে। তার উপর অস্ট্রেলিয়ার ‘পথ প্রোডাকশন’ এই কাজের সাথে জড়িত ছিল। উত্তেজনা তো একটু বেশী থাকবেই।

নো ল্যান্ডস ম্যান নিয়ে কিছু বলার আগে আর একটু ভূমিকা আছে। কয়েক বছর আগে ফারুকী ‘শনিবার বিকেল’ নিয়ে সিডনি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এসেছিল। ছবিটি দেখার পর মনে হয়েছিল আমি কেন ছবিটি দুবার দেখলাম না? ছবি শেষে আমি আর গোলাম মোস্তফা রাত দুটা পর্যন্ত রাস্তার পাশে এক  রেস্তোরায় বসে ফারুকীর সাথে ওর ছবি নিয়ে গল্পও করেছি। পরের দিন ‘শনিবার বিকেল’ নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। ছবিটি আমার এতো ভাল লেগেছিল যে আমার মনে হয়েছিল- সুন্দরবনের এক বাঘ গর্জন শুরু করেছে – আর সেই শব্দ এখন অনেকেই শুনবে। ফারুকীর অনুরোধে লেখাটি এখনও ছাপাইনি – কারণ ছবিটি এখনও বাংলাদেশে মুক্তি পায়নি। আমি লেখাটি জমিয়ে রেখেছি। 

‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ আমি প্রবল আগ্রহ নিয়ে দেখতে গিয়েছি। হল ভরা দর্শক। একজন পরিচালকের জন্য ভীষণ আনন্দের বিষয়। আমি দম বন্ধ করে বসে রইলাম। আর কত অপেক্ষা করা যায়? ছবি শুরু হলো। মন দিয়ে দেখছি। দশ মিনিট, পনের মিনিট চলে গেল- কিন্তু  ছবির গতি আর গল্পের গতির সাথে মিলাতে পারছিলাম না। ভীষণ স্লো পেসে ছবি চলছে। গল্প যেন এগুতে চায় না। বুঝলাম একজন অভিবাসীকে নিয়ে এই গল্প। অভিবাসনের গল্প সরলরেখায় আঁকা যায় না। কত হাজার, কোটি অলিগলি আছে সেই গল্পের পরতে পরতে।  আরো মন খুলে, চোখ মেলে অভিবাসীর গল্পও শোনার জন্য নড়ে চড়ে বসি। কারণ আমি একজন অভিবাসী। কারো কারো জন্য অভিবাসন ট্রমা’র মত যন্ত্রণাময়। একটি বট গাছ উপরে নিয়ে ভিন্ন আলো বাতাসে বাঁচিয়ে রাখা যায়? সেই বট গাছ স্রেফ বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের কত চেষ্টা। আর যার পায়ের নিচে মাটি নেই- তাঁর যাত্রা তো ‘পুলসিরাত’ পারি দেবার মত। সেই যাত্রায় যোগ হয় ভুরি ভুরি মিথ্যে গল্প, সুযোগ সন্ধানী চোখ, মন ভোলানো কথা সহ আরো কত কি? আমি মাঝে মাঝে ভাবি যে মানুষটি দশ- পনের বছর ধরে প্রতিদিন মিথ্যে কথা বলে – স্রেফ বিদেশে থেকে যাবার জন্য, সেই মানুষটি স্বপ্নের কাগজটি হাতে পাবার পর – মিথ্যে বলার সেই অভ্যাসটি কি ছাড়তে পারে? নতুন কেউ তাঁর সাহায্য চাইলে – সেই মানুষটি তো গর্বের সাথে তাঁর ‘গৌরব ভরা’ চালাকী আর মিথ্যে বলার গল্প গুলো বলবে।

ছবির নায়ক কে মনে হোল উনি একজন অভিবাসী। ভিন দেশের আলো বাতাসে পাখা মেলার চেষ্টা করছে। মনে হলো – এমন গল্প তো আমরা অনেক জানি। দেখি সরোয়ার কি গল্প বলে?  আমরা নায়কের অভিবাসনের গল্প শুনবো বলে তৈরি হলাম।  কিন্তু প্রথমেই ধাক্কা খেলাম । একটি মেয়ে ছবির  নায়ককে ট্রেনে দেখে ভয় পেয়েছে। নায়ক ট্রেনে কি করছিল? কিচ্ছু না! বসে ছিল। ব্যস! পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে পায়ে ‘ট্র্যাকিং ডিভাইস’ লাগিয়ে দিল?

দাঁড়ান…… দাঁড়ান……দাঁড়ান। নায়কের কাছে কি এমন ছিল যে কারণে পুলিশ পায়ে টুপ করে ট্র্যাকিং ডিভাইস লাগিয়ে দিল? আমি অনুমান করি – নায়কের আমেরিকা  থাকার পারমিশন আছে। অবৈধ হলে ওই পুলিশ স্টেশনে একটা নতুন গল্প শুরু হতো। নির্দেশক কি ভেবেছেন যে আমরা নিজে নিজে এই ট্র্যাকিং ডিভাইস লাগানোর গল্প বানিয়ে নিব?  এই ট্র্যাকিং ডিভাইস নিয়ে নায়কের বেশ অসুবিধা হলো। রাস্তায় হাটতে, বাসে চড়তে। কেউ জানে না ওর পায়ে একটি ডিভাইস লাগান আছে। আর কেউ একজন হয়ত কান পেতে শুনছে। কিন্তু এই ডিভাইসের কথা ওর প্রেমিকাও টের পেল না? এমনকি বিছানায় একসাথে উত্তেজনায় ডুব দিয়েও মেয়েটি জানল না এই ডিভাইসের কথা? প্রেমিকা সকাল বেলা জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি তো হিন্দু। তাহলে তুমি সারকুমসাইজড কেন?’ 

যে মেয়ের মনে এই বিষয়টি উঁকি দেয়, প্রেমিককে মাথা থেকে পা পর্যন্ত আদর করে, সেই মেয়ে পায়ে লাগানো এই ডিভাইস দেখবে না? গল্পে আরো দেখলাম যে এই মেয়ে বুড়িগঙ্গা থেকে উঠে আসেনি। এই মেয়ে অস্ট্রেলিয়াতে বেড়ে উঠেছে। অতএব ডিভাইস কি তা এই মেয়ে জানে। কিন্তু মেয়েটি কিছুই জানল না। এই কাজটি ভীষণ অপরিকল্পিত মনে হয়েছে। 

এবার বিছানার উত্তেজনার কথা বলি। যৌনতা মানুষের জীবনের অংশ। কিন্তু তাই বলে এতো লম্বা সময় ধরে সেই যৌনতা দেখিয়ে ফারুকী কি বুঝাতে চাইল? এই দৃশ্য গুলো যদি না থাকতো – তাহলে আমরা গল্পের কোন অংশটি বুঝতে পারতাম না। আমার জানা মতে – কোন বাঙালী নির্দেশক এই প্রথম এমন খোলামেলা – দীর্ঘ সময় ধরে একটি যৌন মিলনের দৃশ্য দেখিয়েছে। ফারুকী অনেক কিছুতে ‘প্রথম’ হবার রেকর্ড করেছে। এবার এই বিষয়টি সেই লিস্টে যোগ হোল। কিন্তু সিনেমার কোন লাভ হোল না। এই ছবির প্রচারণায় আমি রেটিং দেখিনি। আপনারা কেউ দেখেছেন? আমার চৌদ্দ বছরের মেয়েকে নিয়ে সিনেমাটি দেখতে চেয়েছিলাম। টিকেটও কিনেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ও না গিয়ে আমাকে অশ্বস্থি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আমি যৌনতা বিরোধী নই। সিনেমার প্রতিটি ফ্রেম দামী। এই ফ্রেমে আমি যা দেখাব – তা অবশ্যই গল্পের অংশ হবে। মুসলমান-হিন্দুর রাজনৈতিক- সাংস্কৃতিক- ধর্মীয় তফাৎ বুঝানোর জন্য  সারকুমসিসন এর মত বিষয় নিয়ে সংলাপ হতে পারে। কিন্তু সেটার প্রেক্ষাপট বুঝানোর জন্য এই লম্বা বিছানার দৃশ্য কি এমন আহামরি কাজ করলো? আমার মাথায় ঢুকেনি।

এই ছবি যে বাংলাদেশে মুক্তি পাবে না – তা আমি যেমন বুঝলাম – তেমনি ফারুকী নিজেও বুঝেছে। সিনেমার নায়ক পাকিস্তানে নির্যাতিত হয়েছে, ইন্ডিয়াতে থেকে শুরু করে আমেরিকা এবং শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়াতে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে নির্যাতিত হয়েছে। অভিবাসন সহজ প্রক্রিয়া নয়। অনেক চরাই উতরাই এর গল্প আছে এই মানুষগুলোর বুকে। কেবল বিদেশে দেশে থেকে যাবার জন্য কত মিথ্যে কথা, কত মিথ্যে গল্প, মিথ্যে মুখোশ পড়ে মিথ্যে প্রমাণ তৈরি করতে হয়। অতএব আমাদের নায়ক ও এমন অনেক মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছে। কারণ নায়ক জানে মিথ্যে বলা পাপ না। ‘মিথ্যেগুলো’ হচ্ছে এই ভিন দেশে টিকে থাকার অস্ত্র। শেষ সম্বল। কেউ সেই মিথ্যে দিয়ে পাড় পেয়ে যায়। আর কেউ কেউ পাথরের নিচে পড়ে কেবল আর্তনাদ করে। কারো কারো জন্য এই যাত্রা তো ট্রমার মত।

বৈষম্য কোথায় নেই? আমি ধারনা করি ওই স্বর্গেও বৈষম্য আছে। অভিবাসনেও বৈষম্যের গল্প আছে। তাই এই নায়ক কোন দেশে গিয়ে বৈষম্য এর স্বীকার হয়েছে সেটা কোন তর্কের কথা নয়। মুল বিষয় হচ্ছে মানুষ এখনও বৈষম্যের স্বীকার হয়। আর এই ছবিটি সেই বৈষম্যের গল্প বলতে গিয়ে – বিষয়টি একদম হালকা করে ফেলেছে। ফারুকী তর্ক করতেই পারে এই ভাবে যে – ওর চোখে এই ছিল প্রবাসের বৈষম্য। হ্যাঁ এটা ওর গল্প। এই ভাবেই ও বলতে চেয়েছে। কিন্তু এমন অনেক গল্প আছে যেখানে এই আমাদের মত গাঢ় চামড়ার মানুষদের ভিড়ে সাদা চামড়ার মানুষেরা হারিয়ে গ্যাছে। এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ এই সিডনিতেই আছে। তাই সিডনিতে যখন নায়কের মৃত্যুর জন্য ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’ কে প্রধান কারণ দেখান হয় তখন প্রবাসীদের অনেকই মনে মনে জিজ্ঞেস করে, ‘সিরিয়াসলি? এটা কি আমার শহর?’

ফারুকী বলল যে ও যখন সিডনী এসেছিল তখন খবরে পড়েছে/শুনেছে যে একজন মাইগ্রেন্ড মহিলাকে প্যারাম্যাটাতে কাজ থেকে ফেরার পথে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে – একদল সাদা চামড়ার মানুষ। এই ঘটনাটি সিনামার গল্প লিখতে ওঁকে প্রভাবিত করেছে। এই একটি ঘটনা দিয়ে  কি পুরো সিডনী/ অস্ট্রেলিয়া জেনারালাইজড করার জন্য যথেষ্ট? আমি কনভিন্সড হলাম না। কিন্তু গল্পের খাতিরে মেনে নিলাম। তারপরও অভিবাসনের সেই অলিগলির গল্প শুনলাম না।

সিনেমা শেষ হোল। ফারুকীর কথা শুনলাম। স্ক্রিনে নামকরা মানুষদের চেহারা এবং নাম দেখলাম। কিন্তু গল্পটি দেখলাম না। আমি প্রথমে গল্প দেখি, তারপর দেখি গল্পটি কি ভাবে বলল? এরপর খেয়াল করি কি ভাবে ছবিটি বানালো? ছবির সিনেমাটোগ্রাফি কেমন? লোকেশন কেমন? আর ফারুকীর ছবিতে এমন অনেক রসদ থাকে যা দেখে ভাল লাগে। কিন্তু এই গল্পটি আমাকে ধরে রাখতে পারেনি। তারমানে কি ছবিটির কিছুই ভাল হয়নি? না না। ঠিক তা নয়। চমৎকার কাস্টিং। নউয়াজুদ্দিন কে মনে হয়নি অভিনয় করছে। গেটাপ, মেকাপ – পারফেক্ট। এই দলে ছিল এ আর রহমান। আমার মনে হয়েছে – দলে ভাল খেলোয়ার থাকলেই হবে না। ওদের পায়ে একটি সঠিক বল দিতে হবে। তবে না খেলাটি জমবে। ফারুকী অনেক কথা বলতে চেয়েছিল – কিন্তু শেষ পর্যন্ত কথাগুলো আমার মনে বাসা বাঁধেনি। আমি স্ক্রিনে কেবল বড় বড় মানুষগুলোর নাম দেখলাম। ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ এ ফারুকীর গল্প যত না দেখলাম তার চেয়ে  অনেক বেশী দেখলাম ওর ইন্টারন্যাশনাল কানেকশন। বুঝলাম – ছবিটি ধারে না কাটলেও ভারে কাটবে।   

ফারুকী বলতে পারে যে সমস্যাটি আমার। কারণ আমি অনেক প্রত্যাশা নিয়ে গিয়েছিলাম। 

পুনশ্চঃ পথ প্রোডাকশন এই প্রযোজনায় সাহস নিয়ে অংশগ্রহণ করেছে। কারণ একটি – ফারুকীর কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশী। এই সাহসী দলটিকে এবার অনুরোধ করব যাদের ওজন তেমন ভারী না – তাঁদের উপর নজর দেয়া হোক। কে জানে অনেক ভাল কাজের সম্ভাবনা নিয়ে কেউ কেউ বসে আছে।

জন মার্টিন, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া । 

 

 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments