[ আজ ২৫ জুন উদ্বোধন হলো স্বপ্নের পদ্মা সেতু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে পদ্মা সেতু উম্মোক্ত করেন। ব্রিজের মাওয়া প্রান্তে আয়োজিত এই উদ্বোধন অনুষ্ঠানটি টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশে বিদেশে কোটি কোটি বাঙালি অবলোকন করে। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়ন নিয়ে লিখেছেন মেলবোর্ন প্রবাসী লেখক, শিল্পী ও সংগঠক মিতা চৌধুরী।]
আজ থেকে, ২৫ জুন ২০২২ বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি স্বর্ণালী ও গৌরবের দিন হয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে, দেশী বিদেশী সকল কুচক্রীর ষড়যন্ত্র ডিঙিয়ে ও সকল মিথ্যা কল্পকাহিনীকে মিথ্যা প্রমান করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা আজ উদ্বোধন করছেন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলির একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত “পদ্মা বহুমুখী সেতু”। নিজস্ব অর্থায়নের প্রথম স্বাক্ষর এই “পদ্মা সেতু” প্রকল্পটি যা শুধু আন্তঃ-আঞ্চলিক সংযোগ ও শক্তি‘ই বৃদ্ধি করবে না, সেই সঙ্গে সমগ্র এশিয়ার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করে বাংলাদেশের “জাতীয় ভিত্তিকে” এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
একটি সেতু, একটি দেশ বা জনপদের জন্য নিতান্তই একটি স্থাপনা নয়, তার চেয়েও বড় কিছু ! একটি সেতু একটি জাতির অবকাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা মানুষের অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত এবং পণ্য ও সামগ্রীর স্থানান্তর উভয়কেই সক্ষম করে, বিশেষ করে প্রান্তিক জনপদের মানুষের জীবনে অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে সক্ষম এই সেতু। একটি সেতু দেশের প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনে মূলস্রোতের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগের যে সুবিধা দেয়, তাতে তারা যেমন আধুনিক সুবিধা ও প্রযুক্তিগুলো সহজেই ব্যবহার করতে পারবে তেমনি তাদের নিজস্ব সম্ভাবনাগুলোও সহজেই উপস্থাপন করতে পারবে। একটি সেতু, শুধুই একটি সেতু থেকে জাতীয় গৌরবের অধ্যায়ে পরিণত হতে পারে, ইতিহাসে এর নজীর ঢের । উদাহরণস্বরূপ, চীনের নানজিং ইয়াংজি নদী সেতু, টার্কির বসফরাস সেতু, যা দেশগুলোর জাতীয় চিত্রকে চিরতরে বদলে দিয়েছে – এর পরিবেশ-রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের মাধ্যমে! আমাদের নিজ যমুনা সেতু এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত! যমুনা পারের জনগোষ্ঠী–মাত্রই জানে এই সেতু তাদের জীবন ও জীবনযাত্রাকে কতটা পরিবর্তন দিয়েছে। পদ্মা বহুমুখী সেতুটিও দেশটিকে অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিকভাবে চ্যাম্পিয়ন করবে বলে আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স ২১ জুন ২০২২ “পদ্মা সেতু কি বাংলাদেশের “জাতীয় পুনরুজ্জীবনের” পূর্বাভাস” শিরোনামে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেছে! যেখানে বলা হয়েছে শুধু এই পদ্মা সেতুর কল্যাণে বাংলাদেশের নির্মাণ খাতে ২৯ শতাংশ, কৃষিতে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ এবং উৎপাদন ও পরিবহন খাতে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে, যা নিঃসন্দেহে জাতীয় অর্থনীতির চাকাকে আরো গতিশীল করবে! বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার জেরেমি ব্রুয়ার বলেছেন, পদ্মা সেতু বাংলাদেশীদের জন্য একটি বড় অর্জন যা নিয়ে সকল বাংলাদেশীর গর্বিত হওয়া উচিত।
দেশের সর্ববৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প – পদ্মা সেতু যা দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলাকে ঢাকা ও দেশের অন্যান্য জেলাগুলির সঙ্গে সংযুক্ত করবে। ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর দেশ বাংলাদেশ। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জনগোষ্ঠী। পদ্মা বহুমুখী সেতু বিশাল এই জনগোষ্ঠীর জীবনকে পরিবর্তন করবে, শিল্প ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে উন্নীত করবে এবং অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করবে, যা এই সেতু প্রকল্পের প্রধান অর্থনৈতিক প্রভাবের উপর বিভিন্ন গবেষণা ও পর্যালোচনার তথ্যের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যার পঞ্চমাংশ এই ব্রিজ থেকে সরাসরি লাভবান হচ্ছে।
একটি সমীক্ষায়, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে যে পদ্মা সেতু নির্মাণ জাতীয় ও আঞ্চলিকভাবে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করতে সহায়তা করবে। সংস্থাটি পূর্বাবাস দিচ্ছে যে, সেতুটির সাথে, মূলধনের প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে, শিল্প ও বাণিজ্যিক কার্যকলাপের প্রচার এবং স্থানীয় জনগণের জন্য অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। ‘কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার’ একটি মার্কিন অলাভজনক থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক, তারা গবেষণায় বলেছেন, পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ করা প্রতিটি টাকায় প্রায় ২ টাকা মূল্যের সামাজিক উপকার হবে! বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণ অনুযায়ী,পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব দক্ষিণ-পশ্চিমে জিডিপি ২% এবং দেশের মোট জিডিপি ১%-এর বেশি বৃদ্ধি করবে।
৬.১৫ কিলোমিটার বা ৩.৮ মাইল দৈর্ঘ্যের পদ্মা সেতু দেশের একটি উল্লেখযোগ্য অবকাঠামো এবং বিশ্বের দীর্ঘতম নদী পারাপারের একটি। সেতুর উভয়পাশের রাস্তার নির্মাণ কাজ ২৪ নভেম্বর ২০১৪ সালে শুরু হলেও মূল সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের শেষের দিকে। উভয় দিক থেকে সেতু পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তার সংযোগগুলি ৭২০ মিটার থেকে ৮৭৫ মিটার দীর্ঘ। রেলওয়ে র্যাম্পগুলি ২.৩৬ কিমি এবং ২.৯৬ কিমি দীর্ঘ সেতুটিতে মোট ৪২টি পিলার ও ৪১টি স্টিলের গার্ডার বা স্প্যান রয়েছে। প্রতিটি স্প্যান ১৫০ মিটার দৈর্ঘের, এবং তাদের প্রতিটির ওজন ৩,৩৭৬ টন। এই স্টিলের গার্ডারগুলি বিশেষ জাহাজ দ্বারা ৪২টি বিশাল কংক্রিটের স্তম্ভের উপর স্থাপন করা হয়েছিল। রেলওয়ে অংশটির নকশা করা হয়েছে তিনটি একক লাইনে, এতে করে বাংলাদেশের বর্তমানে ব্যবহৃত ওয়াইড গেজ এবং মেট্রিক গেজ ট্রেন দ্বারা ভ্রমণ করা যায় এমন দুই ধরনের রেল‘ই চলাচল করতে পারবে।
কোভিড-১৯ এর মহামারীর কালে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোবাংলাদেশেও এর প্রভাব পরে সর্বক্ষেত্রে। স্বাভাবিকভাবেই সেতুটির নির্মাণ কাজ অতিমারীর কারণে পিছিয়ে পরে। আজ ২৫ জুন সেতুটির সড়ক চলাচল বিভাগ উদ্ভোধন হলেও এর রেলওয়ে উদ্ভোধন হবে আগামী বছর। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, প্রকল্পের মোট ব্যয় ২৬.৯৩ বিলিয়ন (২৬,৮৯৩ কোটি টাকা)।
১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার পর থেকেই পদ্মার মতো একটি বিশাল স্রোতস্বিনী নদীতে সেতু নির্মাণ দক্ষিণ-পশ্চিম জনগোষ্ঠীর একটি স্বপ্নের প্রকল্প ছিল। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে ১৯৯৮-৯৯ সালে প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়েছিল। শত প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা, ভুয়া দাবি, বিশ্বব্যাংকের ষড়যন্ত্রের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ তা বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। তাঁর বাবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মতোই তিনিও একজন আপসহীন, দৃঢ়চেতা ব্যাক্তিত্ব এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তি রাখেন; যার ফলাফল এই পদ্মা সেতু।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শিল্পায়নে সহায়ক পদ্মা সেতুর সুফল এখন মংলা বন্দর শিগগিরই পেতে শুরু করবে। উন্নত ও দ্রুত যাতায়াতের কল্যানে স্থানীয় শিল্প ও বাণিজ্য চাঙ্গা হয়ে উঠবে ও নতুন নতুন শিল্প গড়ে উঠবে, যা মূলত স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য শ্রমবাজার ও আয়ের দ্বার উন্মোচন করবে।
নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ, এর বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি বৃহৎ অংশ এখনো প্রান্তিক। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষ উপলব্ধি করতে পারে এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো কতটা পিছিয়ে আছে দেশের অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে। আমি নিজে ও আমার পরিবার সেই জনগোষ্ঠীরই একজন।
পদ্মা পারের জনগোষ্ঠীর প্রতিটি মানুষ জানে, অসুস্থ ও মুমূর্ষু রোগীগে নিয়ে পথে অপেক্ষার যন্ত্রনা, বা ফেরিঘাটে দীর্ঘ লাইনে অনন্ত অপেক্ষার কষ্ট। আমি ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি আমি সেই পদ্মা পারের জনগোষ্ঠীরই একজন, যার প্রতিটি নিঃশ্বাসে পাওয়া যায় পদ্মার পলিমাটির উপস্থিতি। আমার ব্যাক্তিগত জীবন অভিজ্ঞতাটাই তাই বলছি। আমার দাদা বাড়ি শরীয়তপুরের গোসাইর হাটের কাকৈসার গ্রামে। আমাদের বাড়ির কোল ঘেঁষে বয়ে চলে পদ্মার শাখা নদী কীর্তিনাশা। এই কীর্তিনাশা নাম নিয়ে অনেক গল্প আছে তা অন্য একদিন লিখবো। তো সেই পদ্মা পারের মানুষ হিসেবে আমি নিজে একজন ভোক্তভোগী। আমার বাবার চাকরির কারণে আমাদের গাজীপুরে আসা। আমার বাবা তার নিজ পিতৃভূমিকে তার নিজের চাইতেও হয়তো বেশি ভালোবাসতো। আমরা বড় পরিবার হওয়ায়সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে শরীয়তপুর যাওয়াটা আমার মা–বাবার জন্য শুধু কষ্টসাধ্যই ছিলোনা বরং ব্যয়বহুলও ছিল। কিন্তু আমার বাবা যখন সময় পেতো তখনই ছুটে যেত তার ফেলে আসা সেই কাকৈসার গ্রামে, কীর্তিনাশায় ডুব দিতে। আমার বাবা অনেকটা হুট্ করেই আমাদের একা করে চলে যায় উপরওয়ালার কাছে। আমার বাবাকে আমরা তার সেই কাকৈসার গ্রামে চিরনিদ্রায় শোয়াতে পারিনি শুধু এই দীর্ঘ ও ঝামেলাপূর্ণ যাতায়াত ব্যাবস্থার কারণে। তখন কোনো পদ্মা সেতু ছিল না, সদরঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়ে রাতে, আর ট্রাকে করে রওয়ানা দিলে ভাঙা রাস্তা আর ফেরিঘাটের দীর্ঘ অপেক্ষার পরে ঠিক কখন যে আমরা গ্রামে পৌঁছাতে পারতাম তার হিসাব বোধ করি কারোরই জানা নাই। তারপর আমার মা‘কে ভাবতে হয়েছে আমাদের নিয়ে, আমরা কি পারবো ইচ্ছা করলেই আমার বাবার কবরের পাশে যখন তখন ছুটে যেতে, তাকে একটু অনুভব করার জন্য? উত্তরটা ছিল, না আমরা পারবো না! তাই আমরা পারিনি আমার বাবাকে তার প্রিয় মাটিতে, তার গ্রামে তাকে সমাধিস্থ করতে। এখন আর কোনো সন্তানদের এই কঠিন হিসাব মিলাতে হবে না তার পিতামাতার জন্য।
২০০৭ থেকে পরবাসী জীবন। চেষ্টা করি প্রতি বছরই একবার দেশে যেতে, যদিও করোনার অতিমারীর কারণে প্রায় তিন বছর হয়ে গিয়েছে যেতে পারিনি। শুধুমাত্র মাওয়া ঘটে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হবে এই ভয়ে ছোট বাচ্চা নিয়ে শরীয়তপুর যেতে পারি না। তবে এই বছর আর সেই ভয় নেই, এই বছর যাবো আমার সেই গ্রামে! কীর্তিনাশার পশে গোসাইর হাটের কাকৈসার গ্রামে।
কিশোর কবি সুকান্তের ভাষায় বলতেই হবে,
” সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয়
জ্বলে পুড়ে-মরে ছাড়খার
তবু মাথা নোয়াবার নয় “!
এই হলো শেখের বেটি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি কোনোদিন মাথা নোয়াননি এবং নোয়াবেন না।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
মিতা চৌধুরী
চিত্রশিল্পী, সংগঠক, লেখক
প্রশান্তিকা প্রধান, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।