মিশনারি হাসপালের দক্ষ ও অভিজ্ঞ নার্সদের একজন এসে জানালেন আপনার একটি পুত্র সন্তান হলো এইমাত্র। সাথে সাথেই সম্ভাব্য পিতা থেকে সত্যিকারের পিতা হয়ে গেলাম। যেমনটি সম্ভাব্য ক্রেতা বা ভোক্তা থেকে প্রকৃত ভোক্তা হয়। কুড়ি ত্রিশ মিনিট পর ধবধবে নরম তুলতুলে তোয়ালে জড়ানো একটি তুলতুলে মানুষের ছানা আমার কোলে দিতে দিতে সেই সুখবর প্রদানকারী নার্স বললেন, দায়িত্ব বাড়ল। নিজের সময়ও কমলো আর কমলো নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার প্রবণতা। এই ক’টা কথা শুনেই নড়েচড়ে সজাগ হলো মস্তিষ্কের ঝিমিয়ে পড়া কোষ। নিউরনে ছড়িয়ে গেলো অণুরণের ঢেউ। বাবাকে ফোনে জানাতে হবে।জানাতে হবে শ্বশুর বাড়িতে। বাকিদের ব্যক্তিগত ভাবে জানানোর দায় বাঁচে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করলে।
বাবা ফোন রিসিভ করেই জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছে ওরা? আমার মায়ের সাথে দেখা হলো? না, বাবা। ওকে এখনও বেডে দিয়ে যায়নি। পরে শ্বাশুড়িকে ফোন করতেই জেরা শুরু, কার মতো দেখতে হলো? নাকটা কার মতো? চোখ? আমার এক বড় দোষ আমি শিশুদের দেখে কার মতো দেখতে হলো বুঝিনা, আসলে বুঝে উঠতে পারিনা, আজও পারিনি। তাই তাকে বললাম, আপনি এলে দেখে নেবেন ক্ষণ। ব্যস্ত হয়ে একজন বললেন, স্যার সরে দাঁড়ান, আপনার স্ত্রীকে বেডে আনা হচ্ছে আর বেবিটাকে আমাকে দিন। তখনই আমার দীর্ঘদিনের সখা কোথা থেকে উড়ে এসে হৈ হৈ করে বললো, দাঁড়ান বাপ-বেটার প্রথম ছবিটি তুলে নিই। ভারী কালো একটা ক্যামেরা দিয়ে সশব্দে বেশ ক’টা ছবি তোলা হলে শিশুটি নিয়ে নার্সটি চলে গেলেন। মনের ভেতরে কী যে নতুন অনুভূতি উথাল পাতাল উড়াউড়ি করছে ! সদ্য মা হওয়া মানুষটির জন্য গোপনে রাখা উপহারটি নিয়ে তার কাছে গেলাম, পকেট থেকে বের করে কাবেরীর গলায় পরিয়ে দিলাম একটা হার। আমার মা মারা যাবার প্রায় বছর কুড়ি পর কাবেরী এসেছে আমাদের বাপ-বেটার সংসারে। আজ তার মাধ্যমে এলো নতুন আরেকজন।
বাবা হয়ে কেমন লাগছে? খুব খু-উ-উ-ব খুশি। তুমি খুশি না? তোমরা পিতা-পুত্র কত সহজে আপন করে নিয়েছো। কোনো দিন মনে হয়নি আমি অনিরাপদ। তবে তুমি আমার জীবনে অনেক বড় উপহার। যেদিন তোমাকে দেখেছি সেই দিনই প্রার্থনা করেছি তোমাকে যেন পাই নিজের করে। কোনদিন কোন অভিযোগ ছাড়াই চার বছর পার করলাম। আমি অনেক ভালো কপাল নিয়ে তোমাদের সাথে আছি। কি ন্যাকা ন্যাকা কথা। কেমন লাগছে বললে না তো! বুঝে নাও। খুব কষ্ট হলো? এখন থাক ওসব। দুপুরে বাবাকে নিয়ে এসো। মুখভার না করে এখন যাও, ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দিয়েছে, চোখ খোলা রাখতে পারছি না, প্লিজ।
বাবার সাথে আমার অনেক গোপন শলাপরামর্শ সেই শৈশব থেকে। মা গত হবার পর তা আরো বেড়েছে। বাজার করে ঘরে ফিরে আসার পথে মা দুর্ঘটনায় মারা যান। আমি আর বাবা, বাবা আর আমিময় জীবন আমাদের। মাঝে মাঝে বড় পিসি এসে বাবাকে বকাঝকা করতেন। বাবা কারো কথা শুনতেন না। সবার কথা ছিলো তিনি যেন আবার বিয়ে করেন, আর বাবা আমাকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে গেলেন যেখানে যান না কেনো আমি তার ছায়াসঙ্গী। আমরা ধান ক্ষেতের আলে বসে সবুজ মাঠে বাতাসের খেলা দেখতাম, বড়শি নিয়ে পুকুরঘাঁটে সারাটা বিকাল কাটিয়ে ঘরে ফিরতাম কোন দিন একটা পুঁটি মাছ নিয়ে, আবার কোনোদিন দশ পনেরটি নিয়ে। ঘরে এসে সযতনে মাছ কুটে যত্ন করে রান্না করা। বাবার ব্যাডমিন্টন খেলার নেশা, শীতকালে বড়দের খেলা দেখতে যেতাম, বাবার খেলোয়াড় হিসেবে একটা পরিচিতি ছিলো। তখন মা ছিলেন আমাদের সঙ্গে, ফাইনাল ম্যাচ খেলতে যাবেন অনেক দূরে কোন এক বন্ধুর অনুরোধ রক্ষা করতে। আমি তো নাছোড় বান্দা, আমাকে না নিয়ে যেতে পারবেন না। অগত্যা নিয়ে গেলেন, খেলতে নামার সময় বললেন, তুমি চুপচাপ থাকবে। খেলা শেষে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। বাবারা সরাসরি সেটে জিতে আমাকে নিয়ে ফিরে আসতে আসতে গভীর রাত। মা তখন জেগে আছেন, না খেয়ে আছেন। আমার ভীষণ ভয় হলো মাকে নিয়ে, যদি মায়ের কিছু হয়ে যেতো, আমি না গেলেই পারতাম। মাকে যেই বললাম ওনি আমাকে বললেন, এতোই যদি ভয় তবে যাও কেন মাকে ঘরে একা রেখে! মাকে সাথে নিব কী মা-ই তো আমাদের একা রেখে গেছেন! মনে মনে অনেক চিন্তা আজ, আমার বাবা আমার জন্য যা যা করেছেন আমার ছেলের জন্য আমার তা তা করা চাই -ই চাই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি করা চাই, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে।
একবার স্কুল থেকে পিকনিকে যাবে পাহাড়ি ঝর্না দেখতে আমার খুব ইচ্ছে করছিল যেতে। বাবাকে একা রেখে যেতে ভয় হচ্ছিল। আবার বন্ধুদের সাথেও যেতে ইচ্ছে করছিল। বাবা মনের কথা বুঝতে পেরে আমাকে যেতে দিলেন। স্কুল প্রাঙ্গন থেকে গাড়ি ছাড়ার পর বাবার বয়সী কাউকে দেখলেই মনে হচ্ছিলো একা বাড়িতে থাকতে না পেরে বাবা আমার সাথে সাথে চলছেন। বুকের ভিতরটা এমনভাবে খাঁ খাঁ করে উঠলো যে গাড়ি থামিয়ে বাড়ি ফিরে তবেই শান্তি। আমার ছানাটিও আমার জন্য অমন ছটফট করবে! করা না করা তার ব্যাপার, আমার তো করবেই। আমিও বাবার মতো ছানাটিকে ওড়তে শিখাবো, আপদে বিপদে সবার পাশে দাঁড়াতে নিয়ে যাবো, পেয়ারা গাছের ডালে বসে কিভাবে গায়ের গেঞ্জিতে মুছে পেয়ারা খেতে হয়, আধাপাকা কাঁঠাল পেড়ে খড়ের গাদায় কীভাবে গুঁজে রাখলে পেকে সুগন্ধি ছড়াবে, মাতামুহুরীর চরে বসে ক্ষেতের বাদাম তুলে বালি ঝেড়ে ধুয়ে কাঁচা খেতে হয়, মাছের ধরার চারা তৈরিতে কি কি লাগে, কোন মাছ কিসের গন্ধে ছুটে আসে, বসন্তের উদাসী হাওয়ায় রঙিন কাগজ কেটে গরম ভাতকে আটা হিসেবে ব্যবহার করে ঘুড়ি বানানো, সুতোয় কিভাবে কাঁচ লাগাতে হয়, অশ্বিনের শেষে শেষে ও কার্তিকের শুরুতে ধান ক্ষেতের পানি কমে তুলনামূলক গভীর অংশে মাছেরা জমা হলে ধান নষ্ট না করে কিভাবে জালের ঘেরা তৈরি করে মাছ ধরতে হয় সব সব শিক্ষা তাকে দিতে হবে। আমাদের প্রাচুর্য নেই স্বচ্ছলতা আছে। বাবার এই নীতির চর্চা চাই, যেন কখনও বিলাসী আয়েশী না হয়ে ওঠে।
আমি যখন মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা লাভের আশায় দেশের সেরা কলেজে ভর্তি হলাম। হোস্টেলে থাকতে শুরু করলাম। বাবার জন্য সবসময় কষ্ট হতো। ছুটিতে বাড়িতে ছুটে আসার ছটফটানি দেখে বন্ধুরা কৈশোর-প্রেমের গন্ধের খুঁজ পেতো তাদের বোঝাতে পারতাম না কেনো এই ছুটে বাড়ি ফিরে আসা। আর যা-ই হোক মানুষ করার সকল চেষ্টা করে যাবো। গাড়ি কখন ঘরের সামনে এসে থামল টের পাইনি। উবারের চালকের ডাকে সজাগ হলাম। রেশম পোকার মতো নিজের মতো স্বপ্ন বুনে যাচ্ছি। বাকিটা সময়ই ঠিক করে দেবে।
অলংকরণ: দীপঙ্কর গৌতম