পশ্চিমবঙ্গ: উৎকণ্ঠার অবসান কিন্তু নিরুদ্বিগ্ন কি? । রণেশ মৈত্র

  
    

পশ্চিমবাংলার রাজ্য নির্বাচন সমাপ্তির পর যথারীতি গত ২ মে তার ফলাফল ঘোষিত হলো। ফলাফলে পশ্চিমবঙ্গে, ভারত ও বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের উৎকণ্ঠার অবসান হলো উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি “বঙ্গজয়ের” লক্ষ্যে দিল্লীর সার্বিক সামর্থ্যকে ব্যবহার করেও পরাজিত হওয়ায়। দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, কঠিন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের এবারের নির্বাচনকে ঘিরে। বিজেপির “বঙ্গজয়ের” স্বপ্ন যদি সফল হয়-এমন দুশ্চিন্তার কারণেই সৃষ্টি হয় ঐ উদ্বেগ-কিন্তু ফলাফল ঘোষণার পর যখন দেখা গেল ২৯২ টি আসনের মধ্যে ২১৪ টিতেই বিজয়ী হয়েছেন মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস আর পরাজিত হয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল বি.জে.পি।

স্মরণ করা যেতে পারে মার্চ এপ্রিল মাস ধরে দফায় দফায় এবং পৃথকভাবে হেলিকপ্টারে উড়ে পশ্চিম বাংলার জেলাগুলিতে দফায় দফায় এসেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রতি দফায় তিনি ৪/৫টি বিশাল বিশাল জনসভা করে যাবার ২/১ দিনই পরই এসেছেন মোদি সরকারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তিনিও দফায় দফায় একইভাবে বিশেষ হেলিকপ্টারে এসে ৫/৭ টি জেলার নানা জায়গায় বেশ কয়েকটি জসসভা করে দিল্লী ফিরে যেতে না যেতেই হেলিকপ্টারযোগে দিল্লী থেকে পাড়ি জমিয়েছেন বিজেপির সভাপতি নাড্ডা। তিনিও অনুরূপ সংখ্যায় জনসভায় ভাষণ দিয়ে ফিরে যেতে না যেতেই আবার চলে আসতেন নরেন্দ্র মোদি। তাঁর ফিরে পাওয়ার পর আবার অমিত শাহ-তিনি ফিরে গেলে আবার নাড্ডা। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সরকারি দলের সভাপতিকে কোনদিনই অতীতের পশ্চিমবাংলা কেন-ভারতের অতগুলি রাজ্যে কোনটির নির্বাচনেই এসে এমন ধরনের নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে দেখা যায় নি।

নেতাদের বক্তৃতায় বিজেপি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে তারা এবার পশ্চিমবাংলার নির্বাচনে কমপক্ষে ২০০ আসনে জিতবেনই। মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রটাতে নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং যখন জনসভায় “দিদি-ও দিদি” বলে উল্লেখ করে তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করতে পরোয়া করেন নি-তখন ভারতের রাজনীতিতে যে সংস্কৃতির নমুনা তিনি তুলে ধরেছেন-তা কখনোই একজন প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে উচ্চারিত হওয়া প্রত্যাশিত ছিল না বরং তা ভারতের পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রচলিত সংস্কৃতিরও পরিপন্থী।
একই সাথে বিজেপি একের পর এক তৃণমূল কংগ্রেস দলীয় বিধায়ককে তাঁদের নিজ দল পরিত্যাগ করিয়ে বিজেপিতে টেনে নিয়ে অনৈতিকভাবে এক ক্ষতিকর রাজনীতি চালু করে। কথিত আছে, অনেক টাকার বিনিময়ে এবং মন্ত্রীত্ব প্রধানমন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়েও কাউকে কাউকে দল ত্যাগ করানো হয়েছে। নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেল, জনগণ এগুলি ভালভাবে দেখেনি।
বিজেপির করোনা প্রতিরোধে অস্বাভাবিক উদাসীনতা সমগ্র ভারতের মানুষকে কম-বেশী বিজেপি-বিরোধী করে তুলতে অথবা বিজেপির ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতেও সহায়ক হয়েছে। লক্ষ্যনীয় নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হলো যখন সমগ্র ভারতে করোনা ভাইরাস কোটি কোটি ভারতবাসীকে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এনে দাঁড় করিয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার যৌক্তিক এবং বিজ্ঞান সম্মত পরামর্শকে উপেক্ষা করে নির্বাচনী শিডিউল অক্ষুন্ন রাখতে একদিকে বিজেপির সরকার-অপরদিকে নির্বাচন কমিশন উভয়েই গণবিরোধী ভূমিকা পালন করেন। অংশ গ্রহণকারী কোন কোন রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের সাথে সাক্ষাত করে নির্বাচন পিছানোর দাবী জানালে নির্বাচন কমিশনের সাথে সাক্ষাত করে নির্বাচন পিচানোর দাবী জানালে নির্বাচন কমিশন তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে দেওয়াতে কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রচারাভিযান চালাতে যে বিশাল বিশাল জনসমাবেশ প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চালানো হয়-তা কেন্দ্র করে করোনা সর্বত্র ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এ বিষয়েও বিশেষজ্ঞদের অভিমত উড়িয়ে দেওয়া মানুষ যৌক্তিক বলে মনে না করে বিজেপি বিরোধী মনোভাবই তীব্রতর করে তোলে। সমাবেশগুলিতে অংশগ্রহণকারী নেতা-কর্মী ও হাজার হাজার শ্রোতার বড় অংশকে মাস্ক পরতে বা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার জন্য আবেদনটুকুও জানান হয় নি।

নির্বাচন কমিশন ৮টি ধাপে পূরা এক মাস ধরে ভোটগ্রহণের আয়োজন করে। পশ্চিমবাংলা ভারতের অন্যতম ক্ষুদ্র রাজ্য-ভোটার সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট কম। ফলে আট ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন দল সমালোচনা করে অতীতের মত একদিনে বা দুই দিনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যুক্তিসম্মত দাবী জানালে কমিশন তা-ও অগ্রাহ্র করে। নির্বাচনী ময়দানের অভিজ্ঞতায় দেখা গেল, আট ধাপে নির্বাচন বিজেপির স্বার্থের অনুকূল হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীদের, প্রধানমন্ত্রীসহ । এর ফলে রাজ্যবাপী দিনের পর দিন ব্যাপক প্রচার অভিযান পরিচালনার পক্ষে সহায়ক হয়েছে এই আট ধাপে নির্বাচনের আয়োজন।
এভাবে ব্যাপক নির্বাচনী অভিযান অত্যন্ত ব্যয় বহুল। ফলে তা বিজেপিকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে-অন্যদলগুলির ক্ষেত্রে তা প্রতিকূল পরিস্থিতির তৈরী করেছে।

নির্বাচন অবশেষে সম্পন্ন হলো। কিন্তু সকলের নজর যে কেন্দ্রের দিকে নিবদ্ধ ছিল সেটি হলো নন্দীগ্রাম। ঐ কেন্দ্রের প্রার্থী মমতা ব্রানার্জি। কিন্তু ফলাফল ঘেষণায় ঐ কেন্দ্রটি নিয়ে এক অশোভন নাটকীয়তা দফায় দফায় দেখিয়ে একবার জেতা, একবার হারা-এভাবে বহু সময় কাটিয়ে জানান হলো মমতা হাজার তিনেক ভোটে জিতেছেন। পরক্ষণেই ঐ ঘোষণা স্থগিত ঘোষণা করে ঘোষক জানান হলো মমতা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী শুভেন্দু অধিকারীর কাছে পরাজিত হয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দা হওয়াতে এবং বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সরাসরি সমর্থনের কারণে শুভেন্দু একজন শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী নি:সন্দেহে কিন্তু তা এমন নয় যে তিনি মমতা ব্যানার্জিকে হারিয়ে দিতে পারেন। ফলে কারচুপির সন্দেহ ছড়িয়ে পড়ে।
যা হোক মমতার জনপ্রিয়তা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে কত ব্যাপক, নির্বাচনী ফলাফলে তা সুষ্পষ্টরূপে জানা গেল। তৃণমূল কংগ্রেস যেখানে ২১৪ টি আসনে জিতেছে (মমতা ব্যানার্জি বাদেই), সেখানে বিজেপির অর্জন ৭৬। দাবীকৃত ২০০’র ১৭৪ কম।

মমতা ব্যানার্জি এই ফলাফলে একদিকে যেমন খুশী অপর দিকে ব্যক্তিগতভাবে তাঁর পরাজয়কেও মানতে নারাজ। এ ব্যাপারে তিনি আদালতের সরণাপন্ন হবেন বলে জানিয়েছেন। তবে এতে তাঁর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর বিধানসভার যে কোন আসন থেকে জিতে আসতে হবে এই যা।
বাম কংগ্রেস-আইএসএফ মোর্চার ব্যর্থতা পশ্চিমবঙ্গের এই নির্বাচনে মর্মান্তিক পরাজয় ঘটেছে এই মোর্চার। এই তিন দলের ম্েযধ বামফ্রন্টের দলগুলি এবং জাতীয় কংগ্রেস অত্যন্ত প্রাচীন এবং সুপরিচিত সর্বভারতীয় দল হওয়া সত্বেও এমন পরাজয় কল্পনাতীত। বুথ ফেরত সমীক্ষাগুলিতেও মোর্চা ১৫ থেকে ২০টি আসন পাবে বলে অনুমান করেছিল। কিন্তু ব্সাতবে দেখা গেল প্রাচীন দুটি দল পেয়েছে প্রত্যেকে শূন্য আসন এবং নতুন দল আইএসএফ একটি মাত্র আসনে জয়লাভ করেছে।

বাম-কংগ্রেসের এমন পরাজয় কেন?
সর্বভারতীয় দল এবং দীর্ঘদিন সারাভারত (কংগ্রেস) এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারে আসীন এবং বহু সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী হওয়া সত্বেরও এমন পরাজয় কোন হিসেবেই মেলে না। তবুও সাদা চোখে এই পরাজয়ের যে যে কারণ আমি দেখেছি তাতে প্রথমত: এই দুই দলই বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসকে সম-শত্রু হিসেবে গণ্য করে সেই মত প্রচার করায় তারা গণবিচ্ছিন্ন জনতার আস্তা হারিয়েছেন বলে মনে করি। কারণ দৃশ্যত: দেখা গেল হিন্দুত্ববাদী বিজেপির বিরুদ্ধে কঠোরভাবে দাঁড়িয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস ও তার নেত্রী মমতা ব্যানার্জি। পরিণতি দাঁড়িয়েছে যখন মোর্চা বিজেপির বিরুদ্ধে সমালোচনা করেছে বিজেপি অনুগামীরা তাদেরকে তৃণমূল সমর্থক বলে মনে করেছে। আবার যখন তারা তৃণমূলের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেছে-তখন তৃণমূল অনুগামীরা তাদেরকে বিজেপি সমর্থক বলে মনে করেছে। জনগণ কিন্তু দেখেছে বিজেপির সাম্প্রদায়িক নীতির বিরুদ্ধে সর্বাধিক সোচ্চার হলে তৃণমূল কংগ্রেস। এবং সাম্প্রদায়িকতাই যে জনগণের সর্বাধিক বড় শত্রু-পশ্চিমবঙ্গবাসী তা ভালই জানেন। সাম্প্রদায়গতভাবে যদি ভাবি ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বিজেপির কঠোর সমালোচক হওয়ার কারণে এক যোগে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন বলে বিশ্লেষকদের অনুমান। অপরদিকে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী বিপুল সংখ্যক নির্দলীয় ভোটার ও তৃণমূলকেই বেছে নেন। অপর হিন্দুদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার সমর্থক সকলে একযোগে ভোট দিয়েছেন বিজেপির অনুকূলে। এই দুইয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষীনকাঠ মোর্চা কারও ভাবনাতেই স্থান করে নিতে পারে নি বলেই তাদের এই বিপর্য্যয়, এটাই অনুমান। বস্তুত: আজ গভীরভাবে ভাবা দরকার-বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে প্রধান শত্রু কে? সেই প্রধান শত্রুকে পরাজিত করতে সকল শক্তি সম্মিলিতভাবে রাস্তায় দাঁড়ানোই সম্ভবত: ছিল সঠিক নীতি-যা চিহ্নিত করতে বাম ও কংগ্রেস সক্ষম হন নি। ফরে যে বিপর্য্যয় ঘটলো তার ফলে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা থেকেই গেল।
প্রয়োজন ছিল ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল বিরোধী দলের পশ্চিম বাংলার এই নির্বাচনের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে রাজ্য বিধান সভায় বৃহত্তম বিরোধী শক্তি হিসেবে মোর্চার আত্মপ্রকাশ। প্রয়োজন ছিল এ কারণে যে তা হলেই সরকারের নানা দুর্বলতার বিরুদ্ধে এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে বা সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে সোচ্চার একটি রাজনৈতিক শক্তির এবং বিদ্যমান পরিস্থিেিত বাম-কংগ্রেস আইএসএফ মোর্চাই হতে পারত তেমন একটি শক্তি।
প্রতি মুহুর্তে মনে রাখতে হবে, সাম্প্রদায়িক শক্তির মারাত্মক উত্থান ঘটেছে পম্চিম বাংলায়-যার প্রমাণ তারেদর ৭৪ আসনে অর্জিত ধানোতীর্থ বিজয়। বিরোধিদল হিসেবে সরকারের ওপর প্রভাব খাটানোর মত যথেস্ট শক্তি তারা অর্জন করেছে। এই স্থানে প্রয়োজন ছিল মোর্চার। তা না হওয়াতে সৃষ্টি হলো এক শূন্যতার যা ঐ প্রতিক্রিয়াশীল উগ্রধর্মান্ধ শক্তির ক্রমাগত উত্থানের সহায়ক হবে।
তাই সকল প্রগতিশীল শক্তি যদি হিন্দুত্ববাদী উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলনে নেমে তাদেরকে জন বিচ্ছিন্ন করতে পারেন তবেই মঙ্গল। এক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেসকে প্রধান কত্রু না ভেবে আংশিক মিত্র ভেবে ইস্যুভিত্তিক সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন পম্চিম বাংলার বাম-কংগ্রেস মহল বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন।

রণেশ মৈত্র
সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত
বাংলাদেশ।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments