পার্থে বাপি ও শাওলীর মনোজ্ঞ নজরুল ও রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন । নাদেরা সুলতানা নদী

  
    

আমাদের শৈশবকৈশোরে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য প্রভাব যাপিত জীবনে যেমনভাবে দেখেছি বলা যায়সেই সময়কে আমরা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছি

আমরা যতটুকু খোলা মন নিয়ে তাঁদের সাহিত্যকর্মকে জানার অবকাশ পেয়েছি বলাই বাহুল্য এই সময়ে এসে তা নেই। সাধারণের নজরুল কিংবা রবি যাই বলিনা কেন আমাদের ভাবনাপ্রকাশে অল্প অল্প করে ঢুকে গেছে ধর্মীয় এক আগ্রাসন! যা আমাদের অনেকের কাছে বিজাতীয় বা অচেনা। 

বাংলাদেশ আবহে এই সময় এসে আমাদেরকে এমন অমূল্য সাহিত্য কর্ম ঘিরেও প্রতিনিয়তই দেখতে হচ্ছে নানান কূট তর্কের অবতারণা। শুনতে হয় কোন কবি ছিলেন কতোটা ধর্মবিরোধী বা ধর্মভীরুতাঁদের অমর সাহিত্য মূল্যের আলোচনাকে পাশ কাটিয়ে আমাদের  দেখতে হয় ভীষণ নিম্ন মানের বিতর্কতাঁদের সাহিত্য কর্মকে একদম জানেননা এমন মানুষেরাও অবলীলায়  অবতারণা করেন সমালোচনা যারা কবি নজরুল বা কবিগুরুর সাহিত্যকে আকড়ে বাঁচি তাঁদেরকেই করে দেন নাকচ প্রচলিত সমাজে যেন এই মানুষেরাই ভীনদেশী

যারা বাংলাবাঙালী এই স্বত্বাকে করি ধারণ তাঁরা অনেকটাই কোনঠাসা কিছু অন্ধ বিশ্বাসের কাছে। আমাদের জীবনের নানান স্তরে আজও যারা খুঁজি এই দুই মহান সাহিত্যিকের সাহিত্য কর্মের আবেদনমুল্যবোধদর্শন এবং প্রেমতাঁদের কাছে তাই এই সময়ের বাংলাদেশের বেশীর ভাগ মানুষের যে জীবনদর্শন অনেকটাই অস্বস্থিকর এবং রীতিমত বেদনা নিয়ে আসে অনেক প্রকাশ।  

নানান রকম আলোচনায় যখন তাঁদের সাহিত্যমুল্যকে কাটাছেঁড়া করা হয়নি দৃষ্ট কোন এক আবহে এনে তখন আমাদের অনেকেই ভীষণ অসহায় হয়ে সেই কবিদের সাহিত্যকর্মেই খুঁজি আশ্রয়

বাংলাদেশ বলি বা আমরা যারা বাংলা ভাষাভাষি ছড়িয়ে আছি বিশ্বের আনাচে কানাচে দেশের এই বদলে যাওয়া সময়চিন্তা চেতনা আমাদের বুকে এসেও মারে ঘাই যখন তখন। 

নজরুলজয়ন্তী বা রবীন্দ্রজয়ন্তী দেশের প্রেক্ষাপটে জাতীয় গণমাধ্যমসহ অন্যান্য মিডিয়া এবং বিশেষ করে ছায়ানটের মতো প্রতিষ্ঠান আজও টিকে আছে বিধায় আমরা আজও জানাতে পারছি হৃদয়ের অর্ঘ্য। হয়তো সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই জানাই ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি নিজেদের সবটুকু প্রেম নিয়ে। 

বলতে বোধ হয় মানা নেই যেপ্রবাস জীবনে আমাদেরকে এখন পাল্লা দিতে হয় অন্যরকম এক বায়বীয় আবহকে যেকোন উৎসব আয়োজন বা উদযাপনে। আমরা চাইলেই আমাদের সন্তানদের পরিচয় করিয়ে দিতে পারিনা এমন সব সাহিত্যিক বা তাঁদের কর্মের। সবাই আগ্রহী নই আরওভাবে। 

 

কিন্তু যে বা যারা হৃদয় জুড়ে ধারণ করে বাংলাযারা বেঁচে থাকার আয়োজনে খুঁজি সাহিত্য, তাঁদের সেই সাহিত্যপ্রেমকে  ঘিরে নানা উদ্যোগকে আসলে থামিয়ে দেবার সাধ্য কারো নেই। যারা খুব নীরবে ভালোবেসে গায় ‘’তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম’’ তাঁদেরকে আসলে বিপরীত ধারা হোক যত শক্তিশালী তা রাখতে পারেনা দমিয়ে। 

একজন বাপি মজহার এবং শাওলী শহীদ দম্পতি। পরিবার নিয়ে স্থায়ী ভাবে বাস করছেন ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী পার্থে। বিশেষ করে বাংলা সংস্কৃতিকে লালন করা এক পরিবারতাঁদের দুই পুত্র সন্তান এবং তাঁরা আছেন সঙ্গীত ভালোবেসেই। 

এই দম্পতির উদ্যোগেই অনন্য এক ঘরোয়া আয়োজনে হয়ে গেল দুই কবিরজন্মজয়ন্তীর এক অসাধারণ অনুষ্ঠান। 

এই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া কয়েকজন অভিভাবক মায়ের সাথে কথা হচ্ছিলো এবং তাঁদের মাধ্যমেই আমি জানতে পারি এই অনুষ্ঠান আয়োজনটির কথা। 

শুরুর যে ভূমিকা দিচ্ছিলামআসলে আমার নিজের এক যুগেরও বেশী সময়ের প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতায় এমনটাই মনে হচ্ছে। নিজের যাপিত জীবনের নানান সীমাবদ্ধতায় আমি চাইলেও এমন কোন উদ্যোগে আর অংশীদার হতে পারছিনা। যে বা যারা নীরবে কাজটা করে যাচ্ছে তাঁদের তাই সুযোগ এলে সবটুকু কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগটা করিনা হাতছাড়া কিছুতেই। 

প্রশান্তিকা পাঠকদের জন্যে তাই এই আয়োজনটির অল্প বিস্তর নিয়ে এলাম আজ। আমি নিশ্চিত অনেকেই ভীষণ আপ্লূত হবেন জেনে এবং নিজেদের অজান্তেই বাপি মজহারশাওলী পরিবার এবং তাঁদের পাশে থাকা এই উদার সাংস্কৃতিক ধারার বাহকদের জন্যে রাখবেন শুভকামনা। 

ঘরোয়া এই আয়োজনে সকাল এগারোটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত পা ভাজ করে টানা হারমোনিয়াম বাজিয়েছেন শাওলী সকল অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গীত পরিবেশনায় অতক্ষণ ধরে তার হারমোনিয়াম সুরেই গান ধরেছে তার গানের স্কুলের বাচ্চারা। ভালোবেসে কন্ঠে তুলে নিয়েছে রবীন্দ্রনাথনজরুলের ছড়া আর কবিতা

এই সারাটা দিন তবলায় সহযোগিতা করেছেন নজরুল ইসলাম আর মন্দিরা বাজিয়েছেন সোহেলা সিলভী এবং বিভিন্ন পর্বের অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন কামরুল আহমেদটুলটুলী  অনিন্দিতা 

দুপুরে ঘন্টা খানেক সময় ছিল মধ্যাহ্ন ভোজ বিরতি। অংশগ্রহণকারী সকলের সাথে নিয়ে আসা খাবারের সাথে ওইটুকু সময়ের মধ্যে শাওলী আয়োজন করে ফেলে সাদা ভাত এবং অন্যান্য অনুসঙ্গের সকলে ঠিকঠাক মতন খাচ্ছে কিনা এই তদারকীটাও তিনি করেন সবটুকু আন্তরিকতা নিয়ে

অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব অনুষ্ঠিত হলো তাঁদেরই আঙিনায় আর দুপুরের পরের অংশ তাদের বৈঠকখানায়। 

বাপি মজহার এবং শাওলীবাচ্চাদের শেখানোর বিষয়টাতে সব সময় যে দরদ দেন এবং নির্ভুল করে শেখানোর চেষ্টা করেন তা শিখতে আসা বাচ্চাদের প্রায় সকল অভিভাবক স্বীকার করেন অবলীলায়। প্রবাসী শিশুদের দেশীয় সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য শেখানোর বিষয়ে এই মানিক জোড় যেন বদ্ধ পরিকর

একজন অভিভাবকের সাথে যখন আমার কথা হচ্ছিল এই আয়োজনের নেপথ্যের খুঁটিনাটি নিয়ে আমি প্রবলভাবে উপভোগ করছিলাম তার কন্ঠে উপচে পড়া কৃতজ্ঞতা এবং ভালোবাসাটুকু দেখে। 

ভীষণভাবে আবেগে আপ্লূত হচ্ছিলাম এই ভেবে যে শাওলী আমার প্রিয়বন্ধুদের একজন। আমার দেখা বা জানা শুদ্ধ আত্মার মানুষদের একজন। আমি তো সবটুকু গর্বিত হতেই পারি আমিও শাওলীর বন্ধুদের একজন। 

অভিভাবকটি বলছিলনদী আপা আমার পক্ষে  হয়তো এরচেয়ে বেশী তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছেনাতারপরও বলি,  ‘’একদম অনুষ্ঠান শেষে আমি বাপি ভাইকে ধন্যবাদ বললাম , শুধু মুখে কিন্তু মনে মনে বললাম ,”আপনাকে সৃষ্টিকর্তা আরও অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখুনসুস্থ রাখুন বাপি ভাই, শাওলী আপা পরের সন্তানকে আপনের মতো করে ভালোর শিক্ষা দেওয়ার যে ব্রত আপনারা দুজন নিয়েছেন তা অনেক কাল সজীব আর জীবন্ত থাকুক’’। 

তাঁর এই শুভ কামনার রেশ টেনেই বলিআমি বেঁচে থাকলে আশা করছি এই দম্পতির একটা লম্বা সাক্ষাৎকার পর্ব নিয়ে আসতে পারবো। এমন বিনয়ী দুজন মানুষের যদি সম্মতি থাকে। সেই পর্যন্ত আমিও সবটুকু শুভকামনা তো রাখতে চাইভীষণ করে চাই তাঁদের এই কর্মপ্রেমচাওয়া সুন্দর হোক, থাকুক পথচলা অব্যাহত। 

লিখতে লিখতে কী হলো যেন আমার জানিনা… ভীষণ গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে করছে- জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ

নাদেরা সুলতানা নদী : সহযোগী সম্পাদক, প্রশান্তিকা। মেলবোর্নঅস্ট্রেলিয়া। 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments