পিয়ার গান । জন মার্টিন

  
    

পিয়া যে ঘারানার গান করলো- তা অনেকের কানে আনন্দের বন্যা বইয়ে দিবে না জানি। কিন্তু শুনতে ভালো লেগেছে তো। পিয়ার গায়কী, সা রে গা মা পা ধা নি স্বরগুলো নির্ভুলভাবে ছুঁয়ে যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা? ওর ঠাকুমা তো ঠিকই বলেছেন, ‘আগে গলা সাধো তারপর দেখবে যে কোন গান গাইতে পারবে’। আহারে … এই উপদেশ কচি বয়সে আমি কেন পেলাম না !

পিয়ার গলা এখন সুরেলা, মুহূর্তেই উঁচু থেকে নিচুতে ঘুরে আসতে পারে অনায়াসে। ও জানে – ও কি পারে আর কি পারে না। তাই গানগুলো তালিকায় হুড়মুড় করে যোগ দেয়নি। অবশ্য আমার এতে মন খারাপ হয়েছে। কারণ ও কয়েকটা গান রেকর্ড করে আমাকে শুনতে দিয়েছিল। আমি তো সেই গান শুনে ওকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেছি, ‘এইটা কি তুমি গেয়েছ? চাপা মারছো না তো?’
মেয়েটি হেসেই অক্কা পেয়েছে।
আমি আবার বলেছি, ‘সৌর তো সাউন্ডের অনেক কারসাজি জানে। ও কি কিছু মিক্স করেছে?’
এই মেয়ে আমার বাড়িতে এসে কয়েকবার গান শুনালো। আমি অশিক্ষিতের মত কাছ থেকে পিয়ার গান শুনলাম আর নিশ্চিত করলাম ও কোন সাউন্ডট্র্যাক বাজাচ্ছে না। এখন যে কি লজ্জা লাগছে। কিন্তু পিয়া জানে আমি ওকে অনেক ভালবাসি। তাই আমার এই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ও কেবল হেসেছে।
আজ ও আমাকে ভালভাবে উত্তর দিয়েছে। আমি চুপ করে মনে প্রশান্তি নিয়ে কেবল গিলেছি।
আহারে পিয়া…… আমি যে আবারও তোমার ভক্ত হয়ে গেলাম।
এইবার বলি যারা তোমাকে গান গাইতে সাহায্য করলো কিংবা  যারা তাঁদের কাজগুলো দেখালো তাঁদের কথা।
তবলা বাজানোর জন্য পরিবেশ দিতে হয়। আমি গান গাইলে তবলা যে ভাবে বাজবে আর তুমি গাইলে সেই একই তবলা বাজবে ভিন্ন ভাবে। এতে তবলা বা তবলা বাদকের কোন দোষ নেই। দোষ হচ্ছে আমার। তোমার গান তবলাকে কেমন উতলা করেছে – খেয়াল করেছ? পাশে বশে থাকা অভিজিৎ এবং উনার ছেলেকে কৃতিত্ব দিতে একটুও ভুলবো না।
কীবোর্ড নিয়ে বলার কিছু নেই। তবে ভাবছিলাম হাতের কাছে এমন একটি গ্রান্ড পিয়ানো থাকতে রাশনান কেন বার বার কীবোর্ডে ফিরে আসছিল? সিডনিতে আরো একজন ভাল শিল্পীকে দেখলাম। খুব ভাল লাগলো।
তবে গিটার আমাকে খুশি করেনি। উনি হয়তো খুব ভাল গিটার বাজান। এখানে কেবল কয়েকটি কর্ডের উপর সাধারন প্লাকিং মনে হয় তোমার গানের সাথে ঠিক বিচার হয়নি।
এবার বলি মঞ্চ সজ্জা নিয়ে।
শুরুর লাইট চমৎকার আবহাওয়া তৈরি করেছিল। কিন্তু তোমাদের চেহারা দেখার জন্য আমাদের যে অনেক……… অনেক….. অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে। তোমরা যেমন গানের স্বরলিপি অনুসরণ করো, ঠিক তেমনি উপস্থাপনারও একটি স্বরলিপি আছে। দর্শক অন্ধকারে বেশীক্ষণ বসে থাকতে চায় না। ওরা দেখতে চায় কে গান গাচ্ছে? তাঁদের মুখের অভিব্যাক্তি দেখতে চায়। ওই যে বড় বড় কনসার্টে বড় বড় স্ক্রিন দেখেছ? ওগুলো কেন দেয়?
কারণ দর্শক দেখতে চায় – তাঁদের প্রিয় শিল্পী কীভাবে গান গাচ্ছে, কীভাবে গিটার বাজাচ্ছে, কোথায় দম নিচ্ছে, কোথায় চোখের ইশারায় অন্য যন্ত্রীর সাথে কথা বলছে। দর্শক তো কোন রেকর্ডেড গান শুনতে যায়নি। ওরা লাইভ অনুষ্ঠান দেখছে। ওখানে হাসি হবে, কথা হবে, গান হবে, ভুল হবে – এগুলো সব দেখার জন্য দর্শক প্রস্তুত। আর এই দেখা দর্শকের স্মৃতিতে গেঁথে থাকবে।
আমরা তোমাদের অনুষ্ঠানে এগুলো দেখলাম কিন্তু তোমাদের মুখের অভিব্যাক্তি ঠিক দেখতে পেলাম না। কারন লাইটগুলো ঠিক মত এডজাস্ট করা হয়নি। তোমাদের শরীর যত উজ্জ্বল ছিল, মুখ তত নয়। কিন্তু দর্শক তোমাদের মুখের অভিব্যক্তি দেখতে চায় যে।
কিন্তু সাউন্ড চমৎকার ছিল। কানে কোন পীড়া দেয়নি।
এইবার শোন –
সবাই সব গান গাইতে পারেনা। তুমি এমন অনেক গান গাইতে পারো – যা অনেকেই গাইতে পারে না। অনেকই শুনতে চাইবে না। তাতে কি? তুমি তো জানো তুমি কি পারো? তোমার ঘারানা একা তালগাছের মত দাড়িয়ে থাকুক। সেই গাছ অন্য গাছগুলোকে ডিঙ্গিয়ে ঠিক মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকবে। সবাই যা করে – তোমাকেও তাই করতে হবে – কে বলল? তোমার শক্তি নিয়ে তুমি একা চল। সবাই তোমার গান শুনবে, পছন্দ করবে – এটা ভাবার কোন কারণ নেই। রবি ঠাকুর কি বলেছেন জানো? ভাল জিনিস যত কম হয় ততই ভাল। না হলে নিজেদের ভিড়েই হয়ে যাবে মাঝামাঝি।
তোমার জন্য অনেক শুভকামনা।
জন মার্টিন : নাট্যকার, নির্দেশক। সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। 
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments